কেন নামের পেছনে খাঁ যুক্ত করতে চেয়েছিলেন রবিশঙ্কর

পণ্ডিত রবিশঙ্কর ছিলেন সেতারের কিংবদন্তি শিল্পীছবি: রাগ-অনুরাগ বই থেকে

পণ্ডিত রবিশঙ্কর ছিলেন সেতারের কিংবদন্তি শিল্পী। ‘সেতারসম্রাট’ বলা হতো তাঁকে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের ঐতিহ্যকে তিনি পরিচয় করিয়ে দেন সারা বিশ্বে। পাশ্চাত্য ও প্রতীচ্যের সংগীতের মেলবন্ধনে সৃষ্টি করেন এক নতুন জাগরণের। কিন্তু এই রবিশঙ্করকে তাঁর দীর্ঘ শিল্পীজীবনে একধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হয়েছিল। আজ ৭ এপ্রিল মহান এই শিল্পীর জন্মদিনে সেই বিষয়টিই এখনকার পাঠকদের জন্য পেশ করব।

এর আগে এই শিল্পীর জীবনের পাণ্ডুলিপিতে চোখ বুলিয়ে নিতে হবে। আমরা জানি, রবীন্দ্রশঙ্কর চৌধুরী বা রবিশঙ্করের পৈতৃক বাড়ি বাংলাদেশের নড়াইল জেলায়। তাঁর বাবা নড়াইল ছেড়ে চলে যান ভারতের উত্তর প্রদেশের বারানসিতে। এই শহরেই জন্ম রবিশঙ্করের, ১৯২০ সালের ৭ এপ্রিল। রবির বড় ভাই উদয়শঙ্কর এই উপমহাদেশের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী ছিলেন। তাঁর নাচের দল ছিল, যে দল নিয়ে তিনি সারা ইউরোপ ঘুরে ঘুরে অনুষ্ঠান করতেন। বালক রবিশঙ্কর দাদার (উদয়শঙ্কর) সঙ্গে থেকে নৃত্যে এবং সরোদে পাকা হয়ে ওঠেন।

দাদার সঙ্গে তিনি প্যারিস ভ্রমণ করেন। এখানেই রবিকে প্রথম দেখেন আলাউদ্দিন খাঁ, যিনি বৃদ্ধ বয়সে উদয়শঙ্করের দলের সঙ্গে জাহাজে করে ইউরোপ সফর করেন। পরে মধ্যপ্রদেশের মাইহার শহরে এসে আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন রবিশঙ্কর। শেখেন সেতার। এখানে তিনি পেয়ে যান ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের আরেক কিংবদন্তিসম ব্যক্তিত্ব ওস্তাদ আলী আকবর খাঁকে, যিনি আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের পুত্র।

১৯৫৪ সাল থেকে রবিশঙ্কর বিশ্বব্যাপী সংগীত নিয়ে ঘুরে বেড়ান যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ নানান দেশে। কাজ করেন সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘অপরাজিত’ সিনেমাতে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজনের মূল ব্যক্তি তিনিই ছিলেন। এসবই মোটামুটি আমাদের জানা।

কে সেরা

রাগ-অনুরাগ বইয়ের প্রচ্ছদ

রবিশঙ্করের ৯২ বছরের জীবন ছিল বৈচিত্র্যের রঙে রঙিন, এক মহাকাব্যের সমান। এ লেখায় আমরা আলোকপাত করতে চাই তাঁর সংগীতজীবনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি নিয়ে, যা তিনি নিজেই লিখে গেছেন আত্মজীবনী ‘রাগ-অনুরাগ’–এ।

সেই শিল্পী হলেন ওস্তাদ বিলায়েত খাঁ। বয়সে তিনি সাত বছরের ছোট ছিলেন এবং রবিকে দাদা বলে ডাকতেন। কিন্তু সে সময়কার সংগীতবোদ্ধাদের একটি অংশ মনে করেন, সেতারে বিলায়েত খাঁ অনেক এগিয়ে। এ নিয়ে রবিশঙ্করের মধ্যে বেশ উসখুস ছিল।

রবিশঙ্কর বিলায়েত খাঁকে প্রথম দেখেন ১৯৩৯ সালে, এলাহাবাদে একটা কনফারেন্সে। তখন বিলায়েতের বয়স মাত্র ১২ বছর। সে অনুষ্ঠানে সুরবাহার বাজিয়েছিলেন রবিশঙ্কর, আলী আকবর খাঁ সরোদ। সে অনুষ্ঠানের কথা স্মরণ করে ‘রাগ-অনুরাগ’–এ পণ্ডিতজি লিখেছেন, ‘তখন ছোট ছিল বিলায়েত। তালিম যা পাওয়ার তা তো পেয়ে গিয়েছিল। বেশ বাজাল, চমৎকার, বাপের (এনায়েত খাঁ) যেসব অঙ্গ ছিল—সাপাট তান; তা ছাড়া বাপের যে রকম ধরন ছিল—বেশ বাধা বাধা, বেশ সুন্দর সব বন্দিশ। ওর মা ওর পেছন থেকে যে কি রকম ওকে মেহনত করিয়েছিলেন সে কথা অনেকেই জানেন না।’

ওই সময়ে দিল্লির কার্জন রোডের বাড়িতে থাকতেন রবিশঙ্কর। পাশেই থাকতেন কিশোর বিলায়েত। রবিশঙ্কর লিখেছেন, ‘দিল্লিতে খুব ভাব হলো ওর সঙ্গে। খুব সম্মান করত আমাকে, দাদা বলে ডাকত; আর আমিও ওকে খুব স্নেহ করতাম। এক একদিন সকাল সকাল বিলায়েত চলে আসত। আমি হয়তো রেওয়াজ করছি, শুনত। কখনো বলত, দাদা এক সাথ চলিয়ে রিয়াজ কিয়া যায়। সাইকেলে চড়ে আসত। খুব ভালো লেগেছিল। এত হাসি, এত মজা, এত জীবন-ভারী চমৎকার ছেলে ছিল!’

বিলায়েত খাঁর সাত পুরুষ ছিলেন বাজিয়ে। তাঁর বেড়ে ওঠাটা নিজ চোখে দেখেছেন রবিশঙ্কর। সে কথা লিখেছেন এভাবে, ‘বিলায়েত খাঁর ক্রমবিকাশটা দেখলাম, এটা বেশ ইন্টারেস্টিং। ছোটবেলায় বাবা মারা গেলেন, মা ধরে ধরে রেওয়াজ করালেন, তারপর ওর আরও নানান অধ্যায় গেছে—মহম্মদ খাঁ, তারপর ওর দাদামশাই বন্দে হাসান খাঁ, তারপর আমির খাঁরও কিছুটা প্রভাব পড়ল ওর ওপর, কিছুটা আমাদের ঘরের; পরে মেহনত করে কি বিরাট বাজিয়ে হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলল।’

ওস্তাদ বিলায়েত খাঁ
ছবি: রাগ-অনুরাগ বই থেকে

সেতারে তরুণ বিলায়েত খাঁর প্রতিভা সম্পর্কে রবিশঙ্কর স্পষ্টভাবেই লিখেছেন, ‘বিভিন্ন পশ্চাৎপটের রস এবং বিদ্যা মিশিয়ে ও যে একটা নিজস্ব ব্যাপার করেছে, এর সত্যিই কোনো তুলনা হয় না। হি ইজ ফ্যান্টাস্টিক! মেহনত করে—চারদিকের সম্পদ, সেই সঙ্গে নিজের একটা—এসব মিলিয়ে ও সত্যি অসামান্য এক শিল্পী! বলতে পারেন আমি একজন ওর গ্রেটেস্ট অ্যাডমায়ারার।’

সে সময় রবিশঙ্কর ও বিলায়েত খাঁ দুজনেরই অসম্ভব জনপ্রিয়তা। এখন কে সেরা, কার বাজানো ভালো, সেই তর্ক উঠতে শুরু করল। রবিশঙ্কর ইঙ্গিত দিয়েছেন, বিলায়েতের ভক্ত ও শিষ্যরাই প্রথমে এ রকম কথাবার্তা বলতে শুরু করে। রবিশঙ্কর অবশ্য তাঁর শিষ্যদের বলে দিয়েছিলেন কোনো রকম অবান্তর কথাবার্তা না বলতে, ‘আমি তো সব সময় বলি লোকেদের যে আমার সামনে বসে বিলায়েত খাঁর নিন্দে করলে যে আমি খুশি হব তা মোটেই নয়।’

১৯৪৩ সালে বোম্বেতে ভারতীয় ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের একটা বড় আসর হয়েছিল। সেখানে আল্লদিয়া খাঁ সাহেব গেয়েছিলেন, গান করেছিলেন বড়ে গোলাম আলী সাহেব। বিলায়েত খাঁ ও বড়ে গোলাম আলীর গান ও বাজানোতে দারুণ হইচই পড়ে গেল। সেখানে দুজন ভীষণ নাম করলেন। শেষ মুহূর্তে জ্বর আসায় রবিশঙ্কর বাজাতে পারেননি। ওই অনুষ্ঠানের পর যেন এই বিতর্ক আরও সামনে এল। ‘রাগ-অনুরাগ’–এ রবিশঙ্কর লিখেছেন, ‘আমার আর বিলায়েত খাঁর মাঝখানে একটা ফ্রিকশন ক্রিয়েট করার চেষ্টা লোকের বহুদিন আগে থেকে দেখছি এবং সেটা যেন থামতে চায় না।’

বিলায়েত খাঁর গায়কি ও বাজনাতে বিশেষত্ব কি ছিল যে মানুষ একেবারে দিওয়ানা হয়েছিল? একজন বড় শিল্পীই পারে আরেকজন বড় শিল্পীর কাজের মূল্যায়ন করতে। আত্মজীবনীতে সে মূল্যায়নই করেছেন রবিশঙ্কর, ‘আমি একটা অদ্ভুত লিরিসিজম পাই ওর বাজনায়—একটা রোমান্টিক অ্যাপ্রোচ, একটা বয়ান্সি এবং ভিগার আছে। এই যে Combination of romanticism and buoyancy—এটাই আসল জোর ওর বাজনায়। টেকনিক্যালিও অপূর্ব। তার কারণ এত পরিষ্কার ওর হাত, তানগুলো এত স্পষ্ট, তানের সঙ্গে মিড়ের যোগ করে যেটাকে ও “গায়কি অঙ্গ” বলে প্রচার করে, তার এফেক্ট দারুণ সুন্দর হয়, বড় ভালো লাগে।

তারপর ওর বাবারও যেটা ছিল, ওরও আছে—ঝালা। অত্যন্ত স্পষ্ট ঝালা। ঝালা দিয়ে যেটা তৈরি করা যায়—একটা আবহাওয়া, একটা উত্তেজনা। ওর সম্বন্ধে একটা কথাই বলতে পারি—ও খুব বড় আর্টিস্ট।’

একবার এক অনুষ্ঠানে আলী আকবর খাঁ, বিলায়েত খাঁ ও রবিশঙ্কর একসঙ্গে বাজালেন। এ নিয়ে একটি ইংরেজি কাগজে খবর বেরোল, বাজনায় নাকি রবিশঙ্করকে হারিয়ে দিয়েছেন বিলায়েত খাঁ। এ ধরনের প্রতিবেদনে খুব দুঃখ পেয়েছিলেন পণ্ডিতজি। সে বিষয়টি কি ছিল? ‘রাগ-অনুরাগ’–এ সে বিষয়ে লিখেছেন তিনি, ‘তবে হ্যাঁ, ও যেখানে অতি দ্রুত তানে গেল, সেখানে আমি নাকি না পেরে তার অর্ধেকে তান বাজালাম, অথবা ও যখন ঝালায় চারটে টোকা দিল, আমি সেখানে অতগুলো না পেরে তিনটে টোকায় কাজ সারলাম। এ রকম ডাহা মিথ্যের কী প্রতিবাদ করব।’

সেতারে মগ্ন রবিশঙ্কর
ছবি: রাগ–অনুরাগ বই থেকে

তবে সংবাদপত্রের ওই রিপোর্টের পর সত্যি সত্যি চটে গিয়েছিলেন রবিশঙ্কর। সরাসরি বিলায়েতকে এক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান করেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানটি পরে হয়েছিল। শুরুতে রবিশঙ্করের রাগ ভাঙানোর পথে হাঁটেন বিলায়েত খাঁ, ‘দয়া করে লোকের কথায় কান দেবেন না দাদা, আপনি শান্ত হন। আমাদের এ রকম বাজনার লড়াই করা ঠিক না।’

যদিও তাদের নিয়ে ভক্তদের এমন লড়াই চলতে থাকে। রবিশঙ্কর লিখেছেন, ‘এরপরও কয়েকটি অনুষ্ঠান থেকে বিলায়েত নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেয়। কারণ আমাকে প্রোগ্রামের শেষ শিল্পী হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। তাঁর কারণ ওর দাবি যে সর্বশ্রেষ্ঠ সেতারি হিসেবে ওরই শেষে বাজানোর কথা।’

প্রসঙ্গত, বিলায়েত খাঁর পূর্বপুরুষ বাংলাদেশের মানুষ ছিলেন। বিলায়েতের জন্ম ময়মনসিংহের গৌরীপুরে। তবে জীবনের বড় অংশটি তিনি কাটিয়েছেন কলকাতায়।

রবিশঙ্কর থেকে রব্বন খাঁ

‘রাগ-অনুরাগ’ বইটি পড়লে বোঝা যায় কতটা অকপট ছিলেন রবিশঙ্কর। স্পষ্টই বলেছেন, যখন তাঁর সংগীতজীবন শুরু, সেই ১৯৪০-৪১ সালে, হিন্দুস্তানি সংগীতের ক্ষেত্রে একমাত্র কাশী, বিহার, মহারাষ্ট্র অঞ্চল বাদ দিয়ে, একেবারে মুসলমান শিল্পীদের প্রাধান্য ছিল। রবিশঙ্কর লিখছেন, ‘তাদের এবং তাদের ভক্তবর্গকে নিয়ে এমন একটা জোট ছিল চারদিকে যে তার মধ্যে দিয়ে গলে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো খুব মুশকিলের ব্যাপার ছিল কোনো হিন্দু শিল্পীর পক্ষে।’

যখন (১৯৭৯-৮০) এই আত্মজীবনী লিখছেন, তখনো এই ব্যাপারটি ছিল, ‘এখনো অনেকের মনে সেঁধিয়ে আছে সেই ধারণাটি যে মুসলমান শিল্পী না হলে বা নামের শেষে একটা খাঁ না থাকলে তাঁর গানবাজনায় সে জৌলুশ বা রং আসতেই পারে না।’

এসব ব্যাপার-স্যাপার দেখে রাগে-দুঃখে রবিশঙ্কর নাম পাল্টে রব্বন খাঁ ধারণ করার কথা ভেবেছিলেন পণ্ডিতজি। আজ জন্মদিনে মহান এই সংগীতস্রষ্টার প্রতি রইল অতল শ্রদ্ধা।