এসিআই-ইয়ানমার রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার: চারা রোপণে কৃষকের আস্থার সহযোগী

কৃষি যান্ত্রিকীকরণের অন্যতম যন্ত্র ‘এসিআই-ইয়ানমার রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার’ছবি: সংগৃহীত

‘তীব্র শীতে গতবার অনেকেরই চারা নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু আমি তো চারা সংরক্ষণের নিয়ম জানি। কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে আমি মানসিক শান্তি অনুভব করতে পারি। আমি অন্য কৃষকদেরও মানসিক যন্ত্রণা কমিয়ে দিয়েছি।’

নিজের সফলতার গল্প বলতে গিয়ে এভাবেই বলছিলেন নীলফামারী সদর উপজেলার রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার ব্যবসায়ী আলামিন হোসেন।

প্রচলিত পদ্ধতিতে চারা প্রস্তুতের খরচ বাদেই হাতে চারা রোপণে চাষিদের বিঘাপ্রতি খরচ হতো দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা। এতে অর্থের সঙ্গে সময়ও বেশি যায়। সে অনুযায়ী লাভও পান না চাষিরা। এমনই সব সমস্যার সমাধান করেছে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের অন্যতম যন্ত্র ‘এসিআই-ইয়ানমার রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার’, যার কল্যাণে আলামিনের মতো লাভের মুখ দেখছে মোস্তাফিজুর রহমান ও আশিক বিল্লাহও। তাঁরা নিজেরাই চাষিদের চাহিদামতো জাতের ধানের চারা তৈরি এবং রোপণ করে দেন। এ ক্ষেত্রে চাষিদের চারা তৈরি এবং চারা রোপণ বাবদ বিঘাপ্রতি খরচ হয় ১ হাজার ২০০ টাকা।

ধানের বীজ সংরক্ষণ ও রোপণ করতে গিয়ে অনেকে আবাদই নষ্ট করে ফেলেন। কিন্তু ‘সমলয় চাষাবাদ’ কৌশলের কল্যাণে চারা রোপণ ও সংরক্ষণের সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে চাষিরা জানতে পেরেছেন। এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার মেশিনের সাহায্যে চারা থেকে চারার দূরত্ব সঠিকভাবে রাখায় পোকামাকড় কম লাগে, আলো-বাতাস সারির ভেতরে প্রবেশ করে, সার ব্যবস্থাপনা ভালোভাবে করা যায়। এ ছাড়া ফসল পাঁচ থেকে সাত দিন আগেই কাটা যায়। যান্ত্রিকভাবে চারা রোপণের উপকারিতার প্রমাণ পাওয়ায় আরও অনেক চাষি তাঁদের এই রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার প্রযুক্তিতে ধানের চারা রোপণে আগ্রহ প্রকাশ করেন।

২০২০-২১ সালের সমলয় চাষাবাদ থেকে প্রথম রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার সম্পর্কে জানতে পারেন তাঁরা। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার মাধ্যমে ২৮ দিনের ট্রেনিংপ্রাপ্ত হন। পরবর্তী সময়ে ‘আরএডিএআরডিপি’ প্রকল্প থেকে উদ্যোক্তা হিসেবে ইয়ানমার রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার সরবরাহ পান এবং এটি নিয়ে কাজ শুরু করেন। শুরুর দিকে সমলয় চাষাবাদের উপকারিতা সম্পর্কে গ্রামের চাষিদের বোঝাতে শুরু করেন। তাঁদের এ চেষ্টা বিফলে যায়নি, চাষিরা বুঝতে সক্ষম হন।

‘নতুন কিছু করতে গিয়ে আবার ক্ষতি হয় যদি—এই ভেবে প্রথমে খুব ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু পরে দেখলাম, লাভই হয়েছে। যেমন আগে যে পরিমাণ জমিতে চারা রোপণ করতে সাত–আটজন শ্রমিক ও সারা দিন লেগে যেত, তা এখন দুই ঘণ্টায় হয়ে যায়। আগে খরচ লাগত ছয়–সাত হাজার টাকা, এখন দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকার মধ্যে হয়ে যায়।’ এসিআই-ইয়ানমার রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টারের সুবিধা সম্পর্কে জানান এক চাষি।

এ সাফল্যের ধারাবাহিকতায় চলতি বোরো মৌসুমে তাঁরা নীলফামারী সদরের ৭২ চাষির মোট ৪০০ বিঘা জমিতে ইয়ানমার রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টারের মাধ্যমে চারা রোপণ করেছেন। আল আমিন ও তাঁর সহকর্মীরা পরবর্তী বোরো মৌসুমের জন্য দুই হাজার বিঘা জমিতে চারা রোপণ করে দেওয়ার জন্য আগ্রহী চাষিদের সঙ্গে এখনই চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। চাষিরা বিঘাপ্রতি ২০০ টাকা অগ্রিম দিয়ে উদ্যোক্তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। এ ছাড়া সামনের আউশ ও আমন মৌসুমেও চারা রোপণের অর্ডার রয়েছে এই কৃষি উদ্যোক্তাদের কাছে।

জাপানিজ ইয়ানমার ব্র্যান্ডের রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টারের বিশেষত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে উদ্যোক্তা আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘এতে একরপ্রতি দেড় লিটার তেল খরচ হয়, যেখানে অন্যান্য ব্র্যান্ডের ট্রান্সপ্ল্যান্টারে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ তেল খরচ বেশি হয়। ইয়ানমার রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টারে মাত্র ১ ঘণ্টায় ৫০ শতক জমিতে চারা রোপণ করা যায়, যা অন্য ব্র্যান্ডের মেশিনের ক্ষেত্রে অসম্ভব।’

মেশিনের কার্যকারিতা প্রসঙ্গে আরেক উদ্যোক্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘স্বল্প পুঁজি নিয়ে মেশিনটি নিয়েছি। এটি যদি টেকসই না হতো, তাহলে বারবার এর পেছনে অর্থ খরচ করতে হতো। কিন্তু ইয়ানমারের মেশিনটি খুবই শক্তিশালী ও টেকসই। এ ছাড়া এর অপারেটিং সিস্টেম এত সহজ যে বুঝতে অসুবিধা হয়নি।’

সর্বোপরি যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চারা রোপণের ক্ষেত্রে আলামিন হোসেন, মোস্তাফিজুর রহমান ও আশিক বিল্লাহ নীলফামারী সদরের সফল উদ্যোক্তা। সময়মতো সার্ভিস ও প্রশিক্ষণ প্রদান, স্পেয়ার পার্টস সরবরাহ—এসব কাজের মাধ্যমে তাঁদের পাশে ছিল এসিআই মটরস। আশিক, আলামিন ও মোস্তাফিজের মতো শিক্ষিতরাও যদি কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে আসে, কৃষি খাত ছাড়িয়ে যাবে বর্তমানের সব সফলতাকে—এমনই প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।