পাঠকের লেখা
জুলাই স্মৃতি ও আম্মার মৃত্যু
জুলাই-কথা শিরোনামে আমরা পাঠকের কাছে ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে লেখা চাওয়া হয়েছিল। গণ-অভ্যুত্থান সময়ের অভিজ্ঞতা, আন্দোলন ঘিরে প্রত্যাশা এবং আগামী বাংলাদেশের স্বপ্ন—এই তিন বিষয়ে পাঠকেরা লেখা পাঠিয়েছেন। সেখান থেকে বাছাই করা এ লেখাটি প্রকাশিত হলো।
গত বছরের ১৮ জুলাই ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি। আন্দোলন যেন গতি না পায়, সে জন্য সরকার ইন্টারনেট খুব স্লো করে দিয়েছিল। যতটুকু এক্সেস ছিল, তার মধ্যেই ফেসবুক ব্যবহার করছিলাম। ওই সময় আম্মার ক্যানসার ছিল লাস্ট স্টেজে। পরদিন অনেক কষ্টে আমাদের প্রাইভেট কার নিয়ে কিশোরগঞ্জ পৌঁছালাম। আম্মার শারীরিক অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে থাকল।
বিকেলে স্থানীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক দ্রুত ঢাকা ফেরত নিতে বললেন। ঢাকায় আম্মার চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতেই তিনি বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললেন। কারণ, সেখানে আইসিইউ সাপোর্ট আছে। অবশেষে আম্মাকে নিয়ে ঢাকায় রওনা দিই। রাস্তায় তখন ছাত্রদের ব্যাপক আন্দোলন চলছিল। কোনো গাড়ি, এমনকি অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত যেতে ঢাকায় যেতে চাইছিল না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটা অ্যাম্বুলেন্স যেতে রাজি হয়।
এদিকে ক্যানসারের ব্যথায় আম্মা ভীষণ কাতরাতে থাকেন। পরে অ্যাম্বুলেন্সে আম্মা ও ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা দিই। ওই সময় অ্যাম্বুলেন্স শাটডাউনের আওতামুক্ত ছিল। আমরা নরসিংদীর মনোহরদী এলাকায় পৌঁছালে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা অ্যাম্বুলেন্স ছেড়ে দেয়। তবে আমার প্রাইভেট কারের ড্রাইভার একটু ভয় পেয়ে অন্য রাস্তা ধরে যেতেই উত্তেজিত ছাত্র–জনতা গাড়িটি ভাঙচুর করে। আমি তখন আম্মার সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে ছিলাম। ওরা মনে করেছিল, আমার প্রাইভেট কারটি বোধ হয় অ্যাম্বুলেন্সবহরের বাইরে। পরে ভাঙা গাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্স নিয়েই ঢাকার দিকে ছুটলাম। জায়গায় জায়গায় মানুষ আর মানুষ। ঘড়িতে তখন ১০টার মতো বাজে। রাস্তায় খুব একটা গাড়ি নেই। জরুরি কিছু অ্যাম্বুলেন্স আর প্রাইভেট কার।
আমাদের গাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্স যখন ৩০০ ফিটের দিকে, তখন আত্মীয়স্বজন ফোন করে জানাল দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। বুঝতে পারছিলাম না কী করব! এদিকে আম্মা ব্যথায় অস্থির! তখন সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, হাসপাতাল পর্যন্ত যাওয়া যায় কি না, চেষ্টা করে দেখি। শেষ পর্যন্ত অনেক ভয় আর উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে রাত সাড়ে ১২টার দিকে ধানমন্ডিতে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছালাম। রাস্তা তখন বলা যায় জনমানবহীন। জায়গায় জায়গায় আগুনের কুণ্ডলী আর ধোঁয়া উড়ছে।
আমি ২০০০ সালে বুয়েটে ভর্তির পর অনেক আন্দোলন দেখেছি, কিন্তু জুলাই আন্দোলনের মতো এত তেজোদ্দীপ্ত আর বুলেটের সামনে ছাত্রদের বুক চিতিয়ে দেওয়া সাহসী আন্দোলন আর দেখিনি। কেন যেন আমার মনে বিশ্বাস জন্মেছিল যে এবার বুঝি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন হবে! আন্দোলনকারীদের হাতে আমার গাড়ি ভাঙচুরে মনে কোনো কষ্ট পাইনি। তবে আমি মনে করেছি, দেশের জন্য এটা আমার কন্ট্রিবিউশন। আম্মার ক্যানসারের কারণে জুলাই আন্দোলনে আমি সশরীর যোগ দিতে পারিনি। জরুরি অবস্থার দিনগুলোতে আম্মা হাসপাতালে ছিলেন।
সকালে বেশির ভাগ খাবারের দোকান ও হোটেল বন্ধ থাকায় ঠিকমতো নাশতা পাওয়া যেত না। পাশের ইবনে সিনা হাসপাতাল থেকে লাইন ধরে নাশতা আনতে হতো। ইন্টারনেট স্লো থাকায় আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে আপডেট নিতাম। যখনই ইন্টারনেট পেয়েছি, ফেসবুকে ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে অনেক লিখেছি। আম্মার হাসপাতাল গণভবনের খুব কাছে ছিল। ওই এলাকায় সেনাবাহিনীর টহল ছিল বেশি। সন্ধ্যা হতেই তারা ট্যাংক নিয়ে টহল দিত। ২৮ জুলাই সবাইকে অথই সাগরে ভাসিয়ে আম্মা আমাদের ছেড়ে চলে যান! ওই সময় আমাদের মানসিক অবস্থা ভয়াবহ খারাপ ছিল।
আমরা যে যেখানেই ছিলাম, সবার একটাই লক্ষ্য ছিল, তা হলো খুনি হাসিনার পতন! আম্মা হাসপাতালে নিয়মিত পেপার পড়তেন, তিনি রাজনীতিসচেতন মানুষ ছিলেন। সব সময় আমাদের বলতেন, একদিন হাসিনার নির্মম পতন হবে। তাই হলো! ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলেন। আর ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে অপরিসীম কষ্ট করে আম্মা চলে গেলেন স্রষ্টার ডাকে, পরপারে। আফসোস, তিনি ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন দেখে যেতে পারলেন না!
লেখক: প্রকৌশলী সালাহউদ্দিন আহমেদ রায়হান, ঢাকা