এরই নাম তো নন্দিনী ফুল
না–দেখা এই ফুলের নাম যখন জানলাম নন্দিনী, তখন নির্মলেন্দু গুণের ‘নন্দিনী ফুল’ কবিতাটির কথাই মনে পড়ল, ‘এই ফুল তুমি কোথায় পেলে?/ এই ফুল তো শতবর্ষে একটা মেলে।/ এর নামই তো নন্দিনী ফুল।’
ফুলটা দেখতে গোলাপের মতো হলেও আসলে সেটি গোলাপ নয়। ফুল দেখে ভুল হলেও গাছ-পাতা দেখে সে ভুল ভাঙে। ফুলটার ইংরেজি নাম ‘লিসিয়েনথাস’ হলেও বাংলায় ওটির নাম রাখা হয়েছে ‘নন্দিনী’। লিসিয়েনথাস নামটা এসেছে দুটি গ্রিক শব্দ ‘lissos’ ও ‘anthos’ থেকে। লিসোস অর্থ মসৃণ, অ্যান্থোস অর্থ ফুল। নন্দিনী ফুলের পাপড়ি মসৃণ। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এ এফ এম জামাল উদ্দিন ২০০৯ সাল থেকে এই ফুল নিয়ে গবেষণা করছেন, বাংলা নামটা তিনিই দিয়েছেন।
নতুন এই ফুলকে বাংলাদেশে পরিচিতি করিয়েছেন এ এফ এম জামাল উদ্দিন। তিনি জানান, জাপানে এই ফুলের ওপর নিজে পিএইচডি ডিগ্রির গবেষণা কাজ করেন। জাপান থেকে ২০০৪ সালে আসার সময় কিছু বীজ এনে দেশের মাটিতে সেই ফুল ফোটানোর চেষ্টা করেন তিনি। তবে পাঁচ বছর গবেষণার পরও সফল হতে পারেননি। ২০০৯ সালে জাপানে গিয়ে এই ফুলের ওপর আরও কিছু বিষয় শিখে এসে দেশে ফুলটি নিয়ে নতুন করে গবেষণা শুরু করেন তিনি। সাফল্য আসতে থাকে। একে একে তিনি এ দেশে চাষের উপযোগী ১৫টি জাত পেয়ে যান। অল্পসংখ্যক চারা তৈরি করে ২০১৫ সালে ২০০টি চারা চাষের জন্য তিনি যশোরের কিছু ফুলচাষিকে দেন। তাঁরা চাষ করে ফুল ফোটান। আগারগাঁওয়ে সেই ফুল বিক্রি করে বেশ ভালো দাম পান। তবে মুশকিল হচ্ছে, এর চারা তৈরি করা নিয়ে। সাধারণ কৃষকেরা এর চারা তৈরি করতে পারছেন না। বিশেষ পদ্ধতিতে জামাল উদ্দিন চারা তৈরি করছেন। গত বছর তিনি প্রায় পাঁচ হাজার চারা তৈরি করেছিলেন শুধু গবেষণার জন্য। এ বছর করছেন ১০ হাজার চারা। তিনি আশা করছেন, শিগগিরই এই ফুল দেশে ‘কাট ফ্লাওয়ার’ হিসেবে ব্যবহারের জন্য একটি প্রধান বাণিজ্যিক ফুল হয়ে উঠবে।
ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখার জন্য ফুলটা অপূর্ব। বিশেষ করে গোলাপ ফুলদানিতে রাখলে দু–এক দিনেই সেটির পাপড়ি ঝরে যায়; কিন্তু নন্দিনী ফুল ফুলদানিতে দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত সতেজ থাকে। কখনোই পাপড়ি ঝরে না। ফুলটি দেখতেও বেশ সুন্দর। তাই কাট ফ্লাওয়ার হিসেবে এদেশে নন্দিনী ফুল চাষের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে।
এই ফুলের গাছ দেখা যায় মেক্সিকো, ক্যারিবীয় অঞ্চল, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায়। নন্দিনীর উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Eustoma grandiflorum ও পরিবার জেনটিয়ানেসি। এ ফুলের গাছ খুব একটা বড় হয় না, লম্বায় ৬০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। বিরুৎ শ্রেণির গাছ, ডালপালা ও পাতা নরম। পাতা বল্লমাকার, কিনারা মসৃণ ও আগা চোখা, পাতা কিছুটা রসাল। গাছ ও পাতার রং নীলচে ধূসর–সবুজ। পাতা দেখলে মনে হয়, পাতার ওপরে কেউ মোমের প্রলেপ দিয়ে দিয়েছে। ডালের মাথায় এককভাবে অনেক ফুল ফোটে। এক ও দুই সারির পাপড়িবিশিষ্ট ফুল দেখা যায়। ফুলের পাপড়ির বিস্তার প্রায় দুই ইঞ্চি। একরঙা ও দোরঙা—দুই রকম ফুলই দেখা যায়। সাদা, বেগুনি ও সাদা–বেগুনির মিশেল রং—সাধারণত এদেশে এই তিন রকমের ফুল দেখা যায়। গোলাপি ও হলুদ রঙের ফুলও আছে। সারা বছর ফুল ফুটলেও বেশি ফোটে বসন্ত থেকে গ্রীষ্ম পর্যন্ত। ফুলে কোনো ঘ্রাণ নেই।
দেখতে সুন্দর হলেও নন্দিনী ফুলের চাষ খুব সহজ নয়। বিশেষ করে চারা তৈরি ও পরিচর্যার ব্যাপারে কিছু বিশেষ কৌশল নিতে হয়। মাটিতে বীজ পুঁতলে নন্দিনীর চারা গজাবে না, বীজ ফেলতে হয় মাটির ওপরে। আবার মাটিতে বীজ গজিয়ে ওঠার মতো রস থাকতে হবে। মাটি বেশি ভেজা থাকলে গাছ পচে যাবে। মাটিতে রস কম থাকলে চারা গজাবে না ও গাছও বাড়বে না।