মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার স্মারক ‘৭১–এর গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি’

দুই অংশে বিভক্ত ভাস্কর্যটির একদিকে তুলে ধরা হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যার বিষয়টিছবি: প্রথম আলো

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক পেরিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে প্রথমেই চোখে পড়বে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তানি হানাদারদের চালানো গণহত্যার স্মারক হিসেবে নির্মিত একটি ভাস্কর্য। খ্যাতনামা শিল্পী ভাস্কর রাসার নির্মিত দুই অংশে বিভক্ত ভাস্কর্যটির নাম ‘৭১–এর গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি’। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের সহযোগী আলশামস, আলবদর ও রাজাকারদের ঘৃণ্যতম কর্মকাণ্ড উঠে এসেছে ভাস্কর্যটিতে।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষকে ধরে এনে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের ভেতরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতো। এরপর লাশগুলোকে গণকবর দেওয়া হতো। পরবর্তী সময়ে সেই বর্বর হত্যাযজ্ঞের স্মারক হিসেবেই গণকবরের ওপর এই ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়। ১৯৮৮ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০০৮ সালের ৩১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য সিরাজুল ইসলাম ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন।

ভাস্কর্যটি দুটি অংশে বিভক্ত। এক অংশে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি অপর অংশে হানাদার বাহিনীর নির্মম গণহত্যার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ভাস্কর্যের নিচের অংশে রয়েছে পানি, যা দিয়ে নদীমাতৃক বাংলাদেশ বোঝানো হয়েছে। আর পানির ভেতরে রয়েছে বাংলা বর্ণমালা, যা দিয়ে ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে তুলে ধরা হয়েছে। বাংলার মাটি, মানুষ ও ভাষা একাকার হয়ে আছে ভাস্কর্যটিতে।

ভাস্কর্যটির যে অংশে হানাদার বাহিনীর নির্মম গণহত্যার চিত্র ফুটে উঠেছে, সেখানে সবচেয়ে দুর্ভাগ্য ও বেদনার জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ২৫ মার্চের কালরাতকে। এ অংশে দেখানো হয়েছে, ইয়াহিয়া খান মাতাল অবস্থায়, পাকিস্তানি হানাদাররা হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, অন্তঃসত্ত্বা মায়ের পেট চিরে গর্ভের সন্তানকে বের করে আনা হচ্ছে, লাশ ফেলে রাখা হয়েছে যত্রতত্র। ভাস্কর্যের অংশ হিসেবে রয়েছে একটি পত্রশূন্য বৃক্ষ। তার ওপর বসে আছে শকুন। এতে ওই সময়ের শ্মশান হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের প্রতীক বোঝানো হয়েছে।

ভাস্কর্যের এক অংশে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

অপর অংশে তুলে ধরা হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির চিত্র। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কামার, কুমার, জেলে, কৃষিজীবী মানুষসহ সর্বস্তরের মানুষ একত্র হয়ে দা, বঁটি, খুন্তি, কোচ, বর্শা যে যা পেরেছে, তা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। যেখানে রয়েছে সব বয়সী নারী-পুরুষ। পরিপূর্ণ যুদ্ধের জন্য গেরিলা কৌশল, মাঝারি আকারের অস্ত্রের ব্যবহার শিখছেন তাঁরা।

ভাস্কর্যের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে প্রশিক্ষণ নেওয়া সাহসী এক কৃষকের ছেলে। তাঁর চোখে যুদ্ধজয়ের নেশা। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিতে সবার চোখে প্রতিশোধের আগুন। ভাস্কর্যে সবার মাথা সোজা ও লাল বর্ণের। অন্যদিকে গণহত্যার দৃশ্যের রং ধূসর, যা আমাদের বেদনাদায়ক স্মৃতি।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষা এবং নতুন প্রজন্মের সামনে ইতিহাসের নির্মম অধ্যায় তুলে ধরার জন্য এই ভাস্কর্য মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকলেও তা অসম্পূর্ণ। শিল্পী ভাস্কর রাসা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে পাঁচটি ভাগে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ছাড়াও ঘাতক, মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ ও বিজয়ের বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন তিনি। বর্তমানে ভাস্কর্যে দুটি বিষয়ই তুলে ধরা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ভাস্করের পরিকল্পনা অনুযায়ী দ্রুত এর পূর্ণাঙ্গ নির্মাণকাজ করবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।