‘জলাবদ্ধতার কোনো সমাধান কি হবে না?’

বৃষ্টি ও জলজটে একাকার চট্টগ্রাম নগরের নিম্নাঞ্চল। রাতভর বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও অলি-গলি। সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুর এলাকায়
ছবি: জুয়েল শীল

‘বাসায় থাকুন। নালায় পড়ে মৃত্যু বরণ করলে কর্তৃপক্ষ দায়ী নহে। চট্টগ্রাম পানির নিচে। প্রয়োজন না হলে বাসা থেকে বের হবেন না। নিকট অতীতে নালাতে পড়ে মৃত্যুর রেকর্ড রয়েছে বেশ কয়েকটা।’

জলাবদ্ধতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের অ্যাকাউন্টে এভাবেই ক্ষোভ ঝাড়েন চট্টগ্রাম নগরের চকবাজারের বাসিন্দা কাইসার আলী চৌধুরী। জলাবদ্ধ এলাকার ছবি এবং লেখার সঙ্গে কান্নার ইমোজি জুড়ে দিয়ে তিনি আরও লেখেন, ‘এই কষ্ট, এই দুঃখ কি শেষ হবে না?’ এই পোস্টের নিচে মন্তব্য পড়েছে ৪৭টি। প্রণব কুমার চৌধুরী বড়ুয়া নামের এক ব্যক্তি মন্তব্য করেন, চট্টগ্রামের ভাগ্যই খারাপ। বৃষ্টি হলেই পানিতে সয়লাব। শারমিন নিলা নামের একজন পোস্টের নিচে প্রশ্ন করেন, কোনো সমাধান কি হবে না?

পরে কাইসার আলী চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বর্ষা এলেই পানিতে ডুবে যায় চট্টগ্রাম। উন্মুক্ত খাল-নালায় পড়ে প্রাণ হারান মানুষ। সে ক্ষোভ থেকে মানুষকে সচেতন করতেই তিনি এসব কথা লিখেছেন।

কাইসার আলী চৌধুরীর কথার সত্যতা পাওয়া যায় পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই। চট্টগ্রাম নগরের উন্মুক্ত নালা-খালে পড়ে শিশুসহ অন্তত ৫ জনের মৃত্যু হয় ২০২১ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে। তাঁদের মধ্যে সবজি বিক্রেতা ছালেহ আহমেদ পা পিছলে মুরাদপুরের চশমা খালে পড়ে তলিয়ে যান। ওই ঘটনা ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল। তাঁকে এখনো পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর নগরের আগ্রাবাদের মাজার গেট এলাকায় নালায় পড়ে যান আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়া। তিনি চশমা কিনে মামার সঙ্গে বাসায় ফিরছিলেন। ভাগনিকে উদ্ধারের জন্য মামা সঙ্গে সঙ্গে নালায় লাফ দেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। পরে শেহরীনের লাশ উদ্ধার করা হয়।

সর্বশেষ চলতি বছরের ৯ মার্চ সন্ধ্যায় লালখান বাজার সড়কের এক পাশে নালার খোলা অংশের মুখে থাকা রডে হোঁচট খেয়ে পড়ে যান ইমরুল কায়েস চৌধুরী নামের এক তরুণ। এরপর তিনি ভারসাম্য রাখতে না পেরে ছিটকে নালায় গিয়ে পড়েন। গুরুতর আহত অবস্থায় ইমরুল চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। তাঁর পাঁজরের দুটি হাড় ভেঙে গিয়েছিল। কিডনির কিছু অংশেও ক্ষতি হয়েছিল।

বৃষ্টির পানি ঢুকে পড়েছে দোকানে। তাই আসবাবপত্রগুলো সরিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। আজ বেলা সাড়ে ১১টায় চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাট বারই পাড়া।
ছবি: জুয়েল শীল

এসব ঘটনার পরও নগরের বেশ কিছু এলাকার নালা উন্মুক্ত থেকে গেছে। আবার খালের পাশেও বসেনি নিরাপত্তাবেষ্টনী। এ কারণে বর্ষা এলেই ভয়ে ভয়ে পথ চলেন পথচারীরা। নগরের মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, শুলকবহর, মেহেদিবাগ, চটেশ্বরী মোড়, ২ নম্বর গেট, রহমান নগর, মেয়র গলি, আলফালাহ গলি ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকার নালার বেশির ভাগ অংশে এখনো স্ল্যাব বসানো হয়নি। খালে নেই নিরাপত্তাবেষ্টনী।
সায়রা রোশনি নামের এক ফেসবুক ব্যবহারকারী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘পানি উঠেছে এমন পরিচিত রাস্তায়ও হাঁটবেন না। বাচ্চাদের পানিতে নামতেই দেবেন না। একটু ধৈর্য ধরেন।’

আরও পড়ুন

জলাবদ্ধতা নিয়ে ফেসবুকে ক্ষোভ

চট্টগ্রাম নগরের অর্ধশতাধিক এলাকা আজ পানিতে ডুবেছে। বাদ যায়নি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর বাড়ি। নগরের বহদ্দারহাট এলাকায় তাঁর বাড়ির উঠান ও গলিতে হাঁটুসমান পানি ছিল। এ নিয়ে অনেকেই ফেসবুকে লেখালেখি করেছেন। কেউ কেউ ছড়াও লিখেছেন।

আজ বেলা ১১টায় চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাট মেয়র বাসভবনে
ছবি: প্রথম আলো

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড চট্টগ্রামের সাবেক সচিব অধ্যাপক আবদুল আলীম তাঁর অ্যাকাউন্টে জলাবদ্ধতার ছবি দিয়ে একটি ছড়া লেখেন। ছড়ার একটি অংশে তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের ছোট নদী রাস্তায় এল/ কেমনে অফিস যাব সব এলোমেলো। নালা সব ভরে গেছে পলিথিন দিয়ে/ রাজনীতি ব্যস্ত ক্ষমতাকে নিয়ে। জলাশয় কেড়ে নিয়ে উঠেছে দালান/ রাস্তার পানি তাই হয় না চালান।’

অধ্যাপক আবদুল আলীম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বাসাটি কাজীর দেউড়ি এলাকায়। পানির কারণে তিনি বাসা থেকে বের হতে পারেননি। জলাবদ্ধতার কারণে তাঁর পরিচিত অনেকেই দুর্ভোগে পড়েছেন।

আবদুল হামিদ নামের চকবাজার এলাকার এক বাসিন্দা জলাবদ্ধতার ছবি ও ভিডিওর সঙ্গে লিখেছেন, ‘কাজী অফিস, পশ্চিম বাকলিয়া, ডি সি রোড, চকবাজারের অফিস, বাসাবাড়ি, দোকান; সবকিছুই পানিতে ডুবে গেছে। পরে হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, খাল ও নালার আবর্জনা পরিষ্কার করা হয় না। এ কারণে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ পোহাতে হয় নগরবাসীকে।

আরও পড়ুন

৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টি, ১২ ঘণ্টার জলাবদ্ধতা

টানা বৃষ্টিতে আজ শুক্রবার আবার তলিয়ে গেছে নগরের অন্তত ৫০টি এলাকা। আজ সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুর এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

ভারী বৃষ্টি হলেই ডোবে চট্টগ্রাম নগরের বেশির ভাগ এলাকা। এবারও তা–ই হয়েছে। টানা বৃষ্টিতে আজ শুক্রবার আবার তলিয়ে গেছে অন্তত ৫০টি এলাকা। এর সঙ্গে পূর্ণিমার জোয়ার যুক্ত হয়ে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা স্থায়ী হয় জলাবদ্ধতা। কোথাও কোমরসমান, কোথাও হাঁটুপানিতে ভোগান্তিতে পড়ে নগরবাসী।

চলতি বছর বর্ষা শুরু হওয়ার পর এ নিয়ে অন্তত আটবার জলাবদ্ধতা হলো নগরে। তবে আগে এক–দুই ঘণ্টার মধ্যে পানি নেমে যায়। এবার ধকলটা বেশি। বারবার জলাবদ্ধতার জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ও সিটি করপোরেশনসহ সরকারি সংস্থার সমন্বয়হীনতাকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

চট্টগ্রামে গত বৃহস্পতিবার রাত ১২টার পর প্রবল বেগে বৃষ্টি শুরু হয়। এই বৃষ্টি চলে আজ বেলা ১১টা পর্যন্ত। আবহাওয়া অফিসের হিসাবে, গত বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে আজ সকাল ৯টা পর্যন্ত ৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির কারণে নগরের টাইগারপাসে পাহাড়ের একটি অংশ এসে পড়ে চলন্ত মাইক্রোবাসের ওপর। অল্পের জন্য রক্ষা পান গাড়িচালক।

জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সকাল ৬টার পর থেকে পানি ওঠা শুরু হয়। সকাল ১০টার দিকে তা তীব্র আকার ধারণ করে। পরে বিকেল চারটা থেকে পানি নামতে শুরু করে। বেশির ভাগ এলাকার পানি সন্ধ্যা সাতটার দিকে নেমে যায়। তবে কিছু কিছু এলাকার পানি নামে রাত আটটার পর।

৬ / ১২
টানা বৃষ্টিতে নগরের অনেক বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও পানি ঢুকেছে

যে কারণে জলাবদ্ধতা

চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার কারণ অনুসন্ধানে গত বছর চার সদস্যের একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। কমিটিতে প্রধান করা হয়েছিল সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসকে। ওই কমিটি জলাবদ্ধতার কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে অন্যতম কর্ণফুলী নদীতে পূর্ণিমার সময় অতিরিক্ত জোয়ার, নগরের ভেতরে খালের পরিধি কমে আসা, খাল ও নালা-নর্দমা বেদখল ও নিয়মিত খাল-নালার মাটি উত্তোলন না করা। কারণ চিহ্নিত করলে এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি সংস্থাটি। সিটি করপোরেশনও এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়নি।

টাইগারপাস এলাকায় চলন্ত মাইক্রোবাসের ওপর পাহাড়ের একাংশ ধসে পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। সড়ক যান চলাচলের উপযোগী করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।চট্টগ্রাম, ৪ আগস্ট
ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ১০ হাজার ৯২১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪টি প্রকল্পের কাজ চলছে। সিডিএ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। একটি প্রকল্পও নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে পারেনি সংস্থাগুলো।

এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। রিং হলেও তিনি সাড়ে দেননি। অন্যদিকে সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি মোবারক আলী বলেন, সিডিএর প্রকল্প চলমান থাকায় অনেক জায়গায় সিটি করপোরেশনের কিছু করার নেই। তবে খাল-নালা নিয়মিত পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করা হয়।  

সরকারি সংস্থার কাজের সমন্বয় না থাকায় বারবার জলাবদ্ধতা হচ্ছে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্প নেওয়ার পর আশাবাদী হয়েছিল নগরবাসী। কিন্তু প্রকল্পের কোনো সুফল এখনো পাওয়া যায়নি। এ কারণে প্রতিবছর বর্ষা এলেই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।