শেখ এয়ার আহমেদ বা পেয়ার আহমেদ, পিয়ারু ভাই নামেই যিনি সমধিক পরিচিত
ছবি: মানসুরা হোসাইন

‘পিয়ারু ভাই’ ডাকের আড়ালে হারিয়ে গেছে শেখ এয়ার আহমেদ বা পেয়ার আহমেদ নামটি। তবে এ নিয়ে ৭০ বছর বয়সী এয়ার আহমেদের কোনো দুঃখ নেই। এই বয়সেও এখনো ভারী ক্যামেরার ব্যাগ নিয়ে পিয়ারু ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, কখনো ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ বা অন্য কোনো জায়গায় ছবি তুলতে ছুটে যান। ডিজিটাল এ যুগে মুঠোফোনের ক্যামেরায় ছবি তোলার সুযোগ বেড়েছে। তবে পিয়ারু ভাইকে দেখলে ছবি তুলতে তাঁর সামনে দাঁড়ান না বা একটা–দুটো হলেও তাঁর তোলা ছবি কেনেন না এমন ব্যক্তির সংখ্যা কমই আছে।

পুরান ঢাকার খাজা দেওয়ান প্রথম লেনে এয়ার আহমেদের বাড়ি। গত শনিবার দুপুরে এ বাড়ির আর্কাইভে বসে তাঁর সঙ্গে কথা হলো। জানালেন, এ জীবনে কত মানুষের কত লাখ ছবি তুলেছেন, তা তিনি নিজেও জানেন না। শখের বশে ছবি তোলা শুরু। ছবি তোলার এ নেশা একসময় পেশায় পরিণত হয়। ১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে ছবি তোলার শুরু। বললেন, ‘যত দিন শরীরে ক্যামেরার ব্যাগ বহন করার শক্তি থাকবে, তত দিনই ছবি তুলব।’

শেখ এয়ার আহমেদ বললেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় ছবি তুলতে গেলে এমন অনেকের সঙ্গে দেখা হয়, যাঁদের নানি এবং মা–ও নাকি তাঁর ক্যামেরায় ছবি তুলেছেন। আর ছবি তোলার পর নিজের ছবি দেখে কেউ যখন খুশি হয়ে হাসি দেন, সে হাসির কোনো মূল্য হয় না।

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের ছেলে শেখ এয়ার আহমেদ। জানালেন, ছোটবেলায় পড়ার খাতা, দেয়াল যেখানে একটু জায়গা পেতেন, সেখানেই ছবি আঁকতেন। ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে স্টুডিওতে গিয়ে নিজের ছবি তোলা আর সিনেমা দেখার শখের শুরু। পরিবার অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ছিল বলে মায়ের কাছ থেকে এ শখ পূরণের টাকা পেতেও খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।

বাড়িতে গড়ে তোলা সংগ্রহশালায় পিয়ারু ভাই
ছবি: প্রথম আলো

এয়ার আহমেদ বলেন, ‘স্টুডিওতে ছবি তুলতাম। নিজেকে সিনেমার নায়ক মনে হতো। চুলের স্টাইল ঠিক করে আবার ছবি তুলতে যেতাম। একসময় মনে হলো আমি নিজেও যদি ছবি তুলতে পারতাম। কিন্তু ক্যামেরা তো নেই। ১৯৬৫ সালে ভারত থেকে এক পরিবার এল। পরিবারটি একটি ক্যামেরা বিক্রি করবে। দাম চায় ৩০ টাকা। দামাদামিতে না মেলায় তা আর কেনা হয়নি। সেই আফসোস এখনো আছে। তখন ক্যামেরাটি পেলে হয়তো স্কুলজীবন থেকে ছবি তুলতে পারতাম।’

মায়ের ইচ্ছা ছিল এয়ার আহমেদ চিকিৎসক হন। ১৯৭৫ সালে এইচএসসি পাসের পরে প্রথমবার মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দেন। কিন্তু উত্তীর্ণ না হওয়ায় ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে জানতে পারেন, তাঁর এক বন্ধুর আত্মীয়ের একটি ক্যামেরা পড়ে আছে।

এয়ার আহমেদ বললেন, ‘ক্যামেরাটি যখন হাতে পেলাম, তখন মনে হয়েছিল আসমান হাতে পেয়েছি। নিজেকে ফটোসাংবাদিকও ভাবা শুরু করলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠানের অভাব নেই। ওই বন্ধু (অধ্যাপক মুজিবুর রহমান) আর আমি মিলে ছবি তোলা শুরু করি। এক বন্ধুর বোনের বিয়েতে ক্যামেরা নিয়ে গ্রামেও গেলাম। তখন সে কি কদর!’

এয়ার আহমেদ জানালেন, হাতে ক্যামেরা থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তন বা খেলার মাঠ, যেখানে অন্যদের প্রবেশ নিষেধ, সেখানেও অবাধে বিচরণ করা যেত। ক্যামেরার বন্ধুও জুটে গেল অনেক। মায়ের চাওয়া মেনে পরেরবারও মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা দেন। এবারও উত্তীর্ণ হতে পারলেন না। অগত্যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেল তাঁর ঠিকানা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে অংশ নেওয়াসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে জানালেন এয়ার আহমেদ। বললেন, এতে তাঁর পরিচিতি বাড়তে থাকে। নেতারাও ছবি তোলেন। সেই ছবি চান। সত্তরের দশকের শেষ দিকে ডাকসু নির্বাচনে জয়লাভ করতে না পারায় আবার ফটোগ্রাফিতে মনোযোগ দেন। এরপর একসময় ছবি তুলে ব্যবসার চিন্তা মাথায় আসে।

টিএসসির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আমানুজ্জামান খান এয়ার আহমেদকে পছন্দ করতেন। তাঁর ছবি তোলার নেশা দেখে ও তাঁর কাজে সন্তুষ্ট হয়ে টিএসসিতে একটি কক্ষ বরাদ্দ দেন ফটোগ্রাফির কাজের জন্য। টিএসসি থেকে বরাদ্দ সেই কক্ষে অন্যদেরও ফটোগ্রাফি শেখানোর অনুমতি পাওয়া গেল।

এয়ার আহমেদ স্মৃতিচারণা করে বললেন, ১৯৭৯ সালের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফজলুল হালিম চৌধুরী বক্তব্য দিচ্ছেন, এর মধ্যেই তাঁর ছবি তুলে ককশিটে টিএসসির ফটকে ভেজা ছবিই টানিয়ে দিলেন। বক্তব্য শেষ করে বের হওয়ার সময় নিজের তাজা ছবি দেখে অবাক হন উপাচার্য।

ছবি তোলার জন্য ডাক পেলেই এখনো ছুটে যান পিয়ারু ভাই
ছবি: প্রথম আলো

তখন টিএসসির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আমানুজ্জামান খান উপাচার্যকে এয়ার আহমেদের ছবি তোলার দক্ষতার বর্ণনা দেন। উপাচার্যকে বলেন, নিজের একটি ক্যামেরা থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছবি তুলতে পারবে সে। এরপর উপাচার্য তাঁকে এসএলআর ক্যামেরা কেনার টাকা দেন।

তত দিনে এয়ার আহমেদ নাম হয়েছে পিয়ারু ভাই। এ নামেই জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। টিএসসিতেই একটি কক্ষ পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডিও হিসেবে ঘটা করে তার উদ্বোধনও হয়। ২৫০ টাকা নামমাত্র মূল্যে ভাড়া দিতে হতো। এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আর কিছু দিতে হতো না।

এর মধ্যে গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফটোগ্রাফিক সোসাইটি। এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হলেন এয়ার আহমেদ। শ তিনেক শিক্ষার্থী ফটোগ্রাফি শিখতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং টিএসসির পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যবসায়ী হিসেবেও সফল হতে থাকেন এয়ার আহমেদ।

হাসতে হাসতে এয়ার আহমেদ বললেন, ‘এর মধ্যে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া রুবিনা জামান খানের সঙ্গে প্রেম হয়ে যায়। রুবিনা আমানুজ্জামানের (টিএসসির পরিচালক) মেয়ে। প্রথমে কিছুতেই এ সম্পর্ক পরিবার মেনে নেবে না। পরে অবশ্য সবাই মেনে নেয়। খাজা দেওয়ান প্রথম লেনের বাড়িটি শ্বশুরের দেওয়া। আমার এ পর্যন্ত যতটুকু পরিচিত, তার পেছনে বড় অবদান আমার শ্বশুর ও স্ত্রীর। দুই ছেলে, দুই ছেলের স্ত্রী, দুই মেয়ে পাশে আছে বলেই আমার পাগলামি চালিয়ে যেতে পেরেছি।’

পিয়ারু ভাই তখন তরুণ
ছবি: সংগৃহীত

এয়ার আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিফ ফটোগ্রাফার হিসেবেও চাকরি পেয়েছিলেন। তবে নানা টানাপোড়েনে চাকরি থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তখন এ নিয়ে নাকি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। টিএসসিতে যে ঘর ও কক্ষ পেয়েছিলেন, সেটিরও বরাদ্দ বাতিল হয়।

তবে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের অনুমোদনে রোকেয়া হলের সামনে অব্যবহৃত একটি যাত্রীছাউনিতে ভ্রাম্যমাণ দোকান বসানোর অনুমতি পেয়েছিলেন এয়ার আহমেদ। অবশ্য এর জন্য মাসিক আড়াই হাজার টাকা ভাড়াও দিতে হতো। তবে বিভিন্ন কারণে তা–ও বাতিল হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি জায়গা বরাদ্দ পাওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানালেন এয়ার আহমেদ।

এয়ার আহমেদ বললেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি না হারালে আমি একই জায়গায় ঘুরপাক খেতাম। একসময় অবসরে যেতাম। তাই এটাকে আমি আশীর্বাদ হিসেবেই মনে করি। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, নামীদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সম্মিলন, বিভিন্ন বিভাগের পুনর্মিলনীসহ অনেক অনুষ্ঠানে অনুমতি নিয়েই হাজির হই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীদের উপস্থিতিতে যেসব অনুষ্ঠান হয়, সেখানে বিশ্বের বিখ্যাত মানুষ উপস্থিত হন। এই বিখ্যাত মানুষদের ছবি তুলতে তুলতেই বলা যায় আমি কিছুটা খ্যাতি পেয়েছি।’

আঠারো শতকের একটি ক্যামেরা হাতে নিজের সংগ্রহশালায় পিয়ারু ভাই
ছবি: প্রথম আলো

এয়ার আহমেদ বলেন, ফটোসাংবাদিক তাঁর প্রয়োজন অনুযায়ী মেপে মেপে ছবি তোলেন। আর তিনি কোনো অনুষ্ঠানে গেলে হাজার হাজার ছবি তোলেন। প্রধানমন্ত্রী যদি কারও হাতে পুরস্কার তুলে দেন, একটু জড়িয়ে ধরেন—এই ছবিগুলো ওই ব্যক্তির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও আবেগের ছবি। তাই বাজারের ব্যাগ ভর্তি করে ফিল্ম নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাজির হতেন।

বর্তমানের এই ডিজিটাল যুগে পিয়ারু ভাইয়ের কদর কমল কি না, প্রশ্নের উত্তরে এয়ার আহমেদ বললেন, ‘পিয়ারু ভাইয়ের কদর কমলেও ছবি তোলা কমেনি। মানুষ আমার ক্যামেরার সামনে আগের মতোই আগ্রহ নিয়ে দাঁড়াচ্ছেন। তবে ব্যবসা কমেছে। আগে ১০ হাজার ছবি প্রিন্ট করলে আট হাজারই বিক্রি হয়ে যেত। এখন অনিশ্চয়তাটা থেকেই যায়। তাই এখন যদি প্রিন্ট করা ছবির অর্ধেকও বিক্রি হয়, তাতেই খুশি হই। প্রতিবছর কম করে হলেও তিন লাখের মতো ছবি তুলছি।’

খাজা দেওয়ান প্রথম লেনে এয়ার আহমেদের আর্কাইভে উই পোকার আক্রমণ হয়েছে। অনেক মূল্যবান নথি নষ্ট হয়েছে ও হচ্ছে। ২০০৯ সাল থেকে ডিজিটাল মাধ্যমে ছবি ও তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ নেন এয়ার আহমেদ।

কাজের স্বীকৃতি নিয়ে জানতে চাইলে এয়ার আহমেদ বললেন, ‘যাঁদের ছবি তুলেছি, প্রায় সবাই ঘরে যত্নের সঙ্গে তা রেখে দিয়েছে। কেউ কেউ ফেসবুকে ছবি পোস্ট দিয়ে দু–একটি ভালো লাগার কথা লেখেন। ডাকসু থেকে একবার শ্রেষ্ঠ ফটোগ্রাফারের স্বীকৃতি পেয়েছিলাম। তবে এর বাইরে কাগজে–কলমে তেমন কোনো স্বীকৃতি নেই। বড় বড় প্রতিষ্ঠান আমার কাছ থেকে ছবি নিয়ে বই বা ম্যাগাজিন প্রকাশ করে আমার নাম এমনকি সম্মানীও দেয় না। একটি সৌজন্য কপিও পাঠায় না।’

ফেসবুকে ‘পিয়ারু আর্কাইভ ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি পেজ খুলেছেন এয়ার আহমেদ। সেখানে নিজের তোলা ছবি পোস্ট করে সেগুলো সংরক্ষণ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানালেন।

এয়ার আহমেদের তোলা ছবি সংগ্রহের তদারকি করেন সোহেল রানা। স্বীকৃতি না পাওয়া বা উই পোকার সঙ্গে সংগ্রাম করে হিমশিম খেতে থাকা এয়ার আহমেদকে মাঝেমধ্যে সোহেল রানা সব কাজ বাদ দিয়ে দিতে বলেন। এয়ার আহমেদ বললেন, ভালোবাসার টানে তা করতে পারেন না।

এয়ার আহমেদ জানালেন, নিজের তোলা ছবি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জনের তোলা ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করছেন। এসব দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্ব ও স্থাপত্যবিষয়ক একটি বই প্রকাশ এবং ফটোগ্রাফি বিষয়ে একটি ইনস্টিটিউট করতে চান।