৯৯ সেতুর ৮৫টিরই উচ্চতা কম

বিআইডব্লিউটিএর জরিপে এই চিত্র উঠে এসেছে। কম উচ্চতার সেতু নৌপথ অকেজো করে দেয়। 

  • দেশে প্রায় ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ ছিল

  • টিকে আছে মাত্র সাড়ে ছয় হাজার কিলোমিটার।

  • ঢাকার চারপাশের নদী ও খালের ওপর নির্মিত ৩৬টি সেতুর ৩০টিরই উচ্চতা কম।

  • নৌপথ রক্ষায় সেতুর উচ্চতা নির্ধারণে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ১৯৬৫ সালেই।

  • বিধিমালা হয় ২০১০ সালে।

  • ২০১৮ সালে ৯৫ নৌপথের নাম উল্লেখ করে প্রজ্ঞাপন জারি হয়। 

সবচেয়ে কম উচ্চতার এই সেতু নির্মাণ করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। নাম দেওয়া হয়েছে এম এ মাজেদ সেতু, তবে এটি আশুলিয়া সেতু নামে পরিচিত। বর্ষা মৌসুমে পানি বৃদ্ধি পেলে তুরাগ নদের ওপর নির্মিত এই সেতুর কারণে নৌযান চলাচল করতে পারে না। সম্প্রতি তোলা
ছবি: খালেদ সরকার

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) দেশের ৯৯টি সেতুর ওপর জরিপ চালিয়ে দেখেছে ৮৫টিরই উচ্চতা কম। নিচু হওয়ার কারণে বর্ষা মৌসুমে এসব সেতুর নিচ দিয়ে বড় নৌযান চলাচল করতে পারে না। কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে নৌপথগুলো।

সাশ্রয়ী ও পরিবেশের জন্য কম ক্ষতিকর যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হয় নৌপথকে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কয়েক দশক ধরে নৌপথের উন্নয়নে যেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, তেমনি কম উচ্চতার সেতু নির্মাণ করে নৌপথকে অকেজো করে দেওয়া হয়েছে।

বিআইডব্লিউটিএর তথ্য অনুযায়ী, এসব কম উচ্চতার সেতু নির্মাণ করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ), স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), বাংলাদেশ রেলওয়ের মতো সরকারি সংস্থাগুলোই। এমনকি এখনো কম উচ্চতায় সেতু নির্মাণ চলছে। যেমন সম্প্রতি টঙ্গীতে তুরাগ নদের ওপর পুরোনো কামারপাড়া সেতুর পাশে সওজ-এর আরেকটি সেতু নির্মাণ করেছে, যেটি কম উচ্চতার। বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে উচ্চতা নিয়ে আপত্তি জানানোর পরও তা আমলে নেওয়া হয়নি। কম উচ্চতার টঙ্গী রেলসেতুর নির্মাণকাজও চলমান।

‘একই পণ্য সড়কপথের তুলনায় তিন ভাগের এক ভাগ খরচে নৌপথে পরিবহন করা যায়। টেকসই উন্নয়নে সারা বিশ্বেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় নৌপথ, এরপর রেলপথ ও সড়কপথ।
সামছুল হক, গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক
তুরাগ নদের ওপর নির্মাণাধীন টঙ্গী রেলওয়ে সেতু। এটির উচ্চতা কম হওয়ায় আপত্তি জানিয়েছিল বিআইডব্লিউটিএ, কিন্তু সেটি আমলে নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি তোলা
ছবি: আল-আমিন

সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, কম উচ্চতার সেতুগুলো ভেঙে ফেলে বাড়তি উচ্চতায় নতুন করে নির্মাণের চিন্তাও আছে। এতে বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় হবে।

বিষয়টিকে সমন্বয়হীনতা ও নৌপথকে গুরুত্ব না দেওয়ার ফলাফল হিসেবে দেখছেন পরিবহনবিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক সামছুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একই পণ্য সড়কপথের তুলনায় তিন ভাগের এক ভাগ খরচে নৌপথে পরিবহন করা যায়। টেকসই উন্নয়নে সারা বিশ্বেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় নৌপথ, এরপর রেলপথ ও সড়কপথ।

আমাদের দেশে উল্টো হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় করা প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নৌ, সড়ক ও রেলপথকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। পরে বিনিয়োগের ৯০ শতাংশই চলে যায় সড়কে। এটি পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে, যাতে বাংলাদেশে গাড়ির বাজার তৈরি হয়।

বিআইডব্লিউটিএর জরিপ

দেশের নৌপথগুলো দেখভালের দায়িত্ব বিআইডব্লিউটিএর। সংস্থাটির হিসাব বলছে, একসময় দেশে প্রায় ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ ছিল। এখন টিকে আছে মাত্র সাড়ে ছয় হাজার কিলোমিটারের মতো। নৌপথগুলোয় মোট কয়টি কম উচ্চতার সেতু আছে, তার পূর্ণাঙ্গ তথ্য বিআইডব্লিউটিএর কাছে নেই। সংস্থাটি ২০২১ সালে দেশের গুরুত্বপূর্ণ নৌপথে নির্মাণ করা ৯৯টি সেতু নিয়ে একটি জরিপ প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেয়। এই জরিপে ৮৫টি সেতুর উচ্চতা কম পাওয়া যায়।

বিআইডব্লিউটিএ জানিয়েছে, ২০১০ সালের আগপর্যন্ত সেতু নির্মাণের জন্য উচ্চতার ছাড়পত্র নেওয়ার কোনো বিধান ছিল না। তাই সারা দেশে মোট কয়টি সেতু মানদণ্ডের চেয়ে কম উচ্চতায় নির্মাণ করা হয়েছে, তার কোনো পূর্ণাঙ্গ তথ্য নেই। তবে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে এক হাজার সেতুর তথ্য সংগ্রহ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

অবশ্য নৌপথ রক্ষায় সেতুর উচ্চতা নির্ধারণে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ১৯৬৫ সালেই। বিআইডব্লিউটিএ বলছে, নৌপথে তখন ‘স্ট্যান্ডার্ড হাই ওয়াটার লেভেল’ বা পানির উপরিভাগের সর্বোচ্চ স্তর থেকে সেতুর নিচের কাঠামো পর্যন্ত ব্যবধান ঠিক করার কাজ শুরু হয়।

যদিও এ–সংক্রান্ত কোনো বিধিমালা হয়নি। পরে ২০১০ সালে এ–সংক্রান্ত একটি বিধিমালা হয় এবং তা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হয়। বিধিমালায় নৌপথের শ্রেণি ধরে সেতু নির্মাণের উচ্চতা ও দৈর্ঘ্য বলা হলেও পথের নাম উল্লেখ করা হয়নি। পরে ২০১৮ সালে গুরুত্বপূর্ণ ৯৫টি নৌপথের নাম উল্লেখ করে আবার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক প্রথম আলোকে বলেন, কম উচ্চতার সেতুগুলো চিহ্নিত করে পরবর্তী সিদ্ধান্তের জন্য সরকারের কাছে প্রতিবেদন পাঠানো হবে। সরকার পর্যায়ক্রমে কম উচ্চতার সব সেতু নতুন করে নির্মাণের চেষ্টা করবে। যদিও এটি ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। ২০২০ সালে সরকারের কাছে জমা দেওয়া এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ঢাকার চারপাশের ১৩টি কম উচ্চতার সেতু পুনর্নির্মাণ করতে ওই সময় প্রায় ৯০০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছিল।

কোন নৌপথে কম উচ্চতার সেতু

বিআইডব্লিউটিএর জরিপে দেখা যায়, ঢাকার চারপাশের নদীগুলো ছাড়াও পদ্মা, মেঘনা, ভৈরব, গোমতী, কুশিয়ারা ও তিতাসের মতো নদীতেও কম উচ্চতার সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।

যেমন সিলেট বিভাগের কুশিয়ারা নদীর ওপর নির্মিত ৫টি সেতুর প্রতিটির উচ্চতাই কম। কুশিয়ারা নদীর মৌলভীবাজার অংশে নির্মাণ করা শেরপুর সেতুর উচ্চতা হওয়ার কথা ১২ দশমিক ২০ মিটার। কিন্তু সেতুটির উচ্চতা ৭ দশমিক ৮১ মিটার।

পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত লালন শাহ সেতু, মেঘনা নদীর ওপর নির্মিত কামারগাঁও সেতু, ভৈরব রেলসেতু ১ ও ২, গোমতী নদীর ওপর নির্মিত দাউদকান্দি সেতু এবং তিতাস নদীর ওপর নির্মিত হোমনা ও রামকৃষ্ণপুর সেতুর উচ্চতা নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়ে কম।

ঢাকার চারপাশের নদী ও খালের মধ্যে ধলেশ্বরীতে ১০টি, বুড়িগঙ্গায় ২টি, তুরাগে ৫টি, টঙ্গী খালে ১০টি, বালু নদে ৫টি ও শীতলক্ষ্যায় ৪টিসহ মোট ৩৬টি সেতু নিয়ে জরিপ করে বিআইডব্লিউটিএ। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গা নদীর ২টি, শীতলক্ষ্যা নদীর ৩টি এবং ধলেশ্বরীতে মাত্র ১টি সেতু সঠিক উচ্চতায় নির্মাণ করা হয়েছে, ৩০টিরই উচ্চতা কম। কম উচ্চতার সেতুর কারণে ঢাকার চারপাশ ঘিরে বৃত্তাকার নৌপথ চালু করা যায়নি। যদিও এ নৌপথের দৈর্ঘ্য ১১০ কিলোমিটার।

জরিপে পাওয়া সবচেয়ে কম উচ্চতার সেতুটি হলো তুরাগ নদের ওপর নির্মিত বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ এম এ মাজেদ সেতু (আশুলিয়া সেতু)। সেতুটির উচ্চতা শূন্য দশমিক ৬৭ মিটার। অথচ এর উচ্চতা হওয়ার প্রয়োজন ছিল ৭ দশমিক ৬২ মিটার। সেতুটি নির্মাণ করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৮৮ সালের দিকে সেতুটি নির্মাণ করা হয়। ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়ক নির্মাণের সময় সেতুটি ভেঙে ফেলা হবে।

টঙ্গীতে কম উচ্চতায় রেলওয়ে সেতুর নির্মাণের বিষয়ে রেলওয়ের কর্মকর্তাদের ব্যাখ্যা হলো, সেতুর উচ্চতা বাড়াতে হলে পুরো রেললাইনের উচ্চতা বাড়াতে হবে। শুধু সেতু উঁচু হলে ট্রেন চলতে পারে না। অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, শুরুতেই পরিকল্পনা নেওয়া হলে নৌপথটি রক্ষা করা যেত, যে ১৪টি সেতু উচ্চতা মেনে নির্মিত হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে ধলেশ্বরী নদীর ওপর মুক্তারপুর সেতু, বুড়িগঙ্গার ওপর বুড়িগঙ্গা সেতু ১ ও ২, শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর নির্মিত সুলতানা কামাল সেতু, কাঁচপুর সেতু–২ ইত্যাদি। যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুও উচ্চতা মেনে নির্মিত হয়েছে।

এদিকে অভ্যন্তরীণ জলপথে ও এর তীরে কোনো স্থাপনা (সেতুসহ) নির্মাণ করার ক্ষেত্রে বিআইডব্লিউটিএ থেকে ছাড়পত্র (অনুভূমিক ও উল্লম্ব) নিতে হয়। বিআইডব্লিউটিএর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সেতু, বৈদ্যুতিক লাইনসহ ৩৩৮টি ছাড়পত্রের আবেদন পড়েছে। এর মধ্যে ৭৫টি ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে, ৯৭টি বাতিল হয়েছে।

ছাড়পত্র দেওয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, ছাড়পত্রের আবেদন করার পর বেশির ভাগ সময়ই স্থানীয় সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক নেতারা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ফোন করে সেতুর উচ্চতা কম রাখার জন্য তদবির করেন। এতে তাঁরা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। উচ্চতা–সংক্রান্ত জটিলতার কারণে পটুয়াখালীর লোহালিয়া নদীর ওপর সেতু নির্মাণের (লোহালিয়া সেতু) কাজ আটকে আছে বলেও তাঁরা জানিয়েছেন।

বুয়েটের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, নৌপথে কম উচ্চতায় সেতু নির্মাণ একবিংশ শতাব্দীর সস্তা ভুল। এ জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।