শহীদদের স্বপ্নপূরণের দায়িত্ব আমাদের

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের সঙ্গে মিশে আছে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীরও রক্ত। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মনিবেদনে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কী ভাবনা তাঁদের সন্তানদের? তাই নিয়ে এই আয়োজন।

গোলাম মোস্তফা

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা একটি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক দেশ গড়ার স্বপ্নে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁরা এমন একটি দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে মানুষের মৌলিক চাহিদার নিশ্চয়তা থাকবে, সবার কর্মসংস্থান হবে, সমাজে শোষণ ও বৈষম্য থাকবে না। কিন্তু তেমন দেশ গড়ার স্বপ্ন এখনো পূরণ হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধের পর রাষ্ট্রগঠন ও জনগণের ভাগ্যবদলের কাজ মসৃণ পথে এগোয়নি। নানা বাধা ও প্রতিবন্ধকতা এসেছে। রাজনৈতিক দৃশ্যপটের পরিবর্তন এবং ক্ষমতার পালাবদলে নানা উত্থান-পতন ঘটেছে। আবার এর মধ্যে বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে অনেক ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতিও ঘটছে। চরম দারিদ্র্য থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটেছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হয়েছে। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে অনেক বিকাশ হয়েছে। এসব উন্নতি আমাদের আশাবাদী করে। এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে।

আমার বাবা শহীদ বুদ্ধিজীবী এমলাক হোসেন ছিলেন মেহেরপুরের গাংনীর সাহারবাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এলাকায় সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নেতৃত্ব দিতেন। স্থানীয় জনগণের কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সম্মানীয়। বঙ্গবন্ধুর আহ্বান শোনার পর গ্রামের যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য তিনি সংগঠিত করতে থাকেন। প্রশিক্ষণের জন্য তাঁদের ভারতের নদীয়া জেলার শান্তিপুর এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। আমাদের তিন ভাইকেও তিনি ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে পাঠান। বাবা গ্রামে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, সহযোগিতা করতেন।

একাত্তরের ১৫ আগস্টের রাতে পাকিস্তানি সেনারা রাজাকারদের সহায়তা নিয়ে ট্রাকে করে এসে গাংনীর সাহারবাটি চারচারা মোড়ে আমাদের বাড়ি ঘিরে ফেলে। সদর দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে বাবাকে লাঠিপেটা করতে করতে ট্রাকে তুলে তাদের ভাটপাড়া ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে বাবা ও মেহেরপুরের আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা উজির মালিথাকে গুলি করে হত্যা করে লাশ ভাসিয়ে দেয় কাজলা নদীতে। তাঁদের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমরা তিন ভাই ভারতে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে বাবাকে হত্যার খবর পাই।

প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিই। আমি তখন দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার কারণে ওই সময়ের ছবিটা আমার বুকের মধ্যে গেঁথে রয়েছে। তখন পাকিস্তানি সেনারা একের পর এক ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে। সাধারণ মানুষকে সারিতে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করছে। তারা যখন যাকে ধরে নিয়ে যেত, তাদের আর খুঁজে পাওয়া যেত না। দেশের মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক।

বাবা সব সময় বলতেন, একদিন এই দেশ আমাদের নিজের হাতে আসবে। জাতি হিসেবে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে আমাদের দেশ। সুশাসন, ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন থাকবে—এমন একটি দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। আমরাও সেই লক্ষ্যেই অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছি।

এখন অনেক বড় আকারে স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস পালিত হয়। কিন্তু যে আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য বুদ্ধিজীবীরা আত্মদান করেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন জীবন বাজি রেখে, সে কর্তব্য তো অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। গণতন্ত্র থেকে আমরা ছিটকে পড়েছি। মানুষের অধিকার পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য এখন পাহাড়প্রমাণ। দেশের টাকা হরদম বিদেশে পাচার হচ্ছে। ঘুষের দৌরাত্ম্যে মানুষ অস্থির।

লাখো শহীদের রক্তের ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব বর্তেছে আমাদের ওপর। সে দায়িত্ব পালন করতে না পারলে তাঁদের আত্মত্যাগের ঋণ কোনোভাবেই শোধ করা যাবে না।

গোলাম মোস্তফা: বীর মুক্তিযোদ্ধা, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী এমলাক হোসেনের মেজ ছেলে