রাশিয়ার কিস্তি পরিশোধে জটিলতা খুলতে মস্কো যাবে প্রতিনিধিদল

রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজেফাইল ছবি

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য দেওয়া রাশিয়ার ঋণের কিস্তি কীভাবে পরিশোধ করা যায়, সেই উপায় বের করতে এবার মস্কো যাচ্ছে সরকারের একটি প্রতিনিধিদল। দুই দেশের নীতিনির্ধারকেরা কয়েক দফায় ভার্চ্যুয়াল বৈঠক করেও ঋণের সুদ পরিশোধের উপায় বের করতে পারেননি। জটিলতা নিরসনে তাই সরকারের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল শিগগিরই রাশিয়া সফরে যাবে। আজ বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়েছে।

২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে সরকারের প্রথম ঋণচুক্তি হয় ২০১৩ সালে। ৫০ কোটি ডলারের। ওই টাকা দিয়ে বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিস্তারিত সমীক্ষাসহ প্রাথমিক কাজ করে সরকার। ওই ঋণের সুদ পরিশোধ শুরু হয় ২০১৮ সাল থেকে। এখন পর্যন্ত আট কিস্তিতে ৪০ কোটি ডলার পরিশোধ হয়েছে। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে অভিযান চালানোর পর থেকে কিস্তি পরিশোধ বন্ধ রয়েছে।

বৈঠক সূত্রে জানা যায়, বাকি ১০ কোটি ডলার ঋণ দ্রুত পরিশোধে তাগিদ দিচ্ছে রাশিয়া। দেশটি চাইছে, তাদের মুদ্রা রুবলে পরিশোধ করতে। যদিও সরকার জানিয়েছে, রুবলে ঋণের কিস্তি পরিশোধ সম্ভব নয়। রাশিয়ার যেসব ব্যাংক পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বাইরে রয়েছে, সেসব ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশের কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে যাতে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞায় পড়তে না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। প্রতিনিধিদল রাশিয়া সফরে গিয়ে মূলত ঋণ পরিশোধের পদ্ধতি ঠিক করবে।
দেড় ঘণ্টার বৈঠকে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র ঘিরে তৈরি হওয়া বহুমাত্রিক জটিলতা নিয়ে আলোচনা হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকায় বড় ধরনের প্রভাব পড়তে শুরু হয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় এই অবকাঠামো প্রকল্পের নির্মাণকাজে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যেসব দেশ থেকে ভারী যন্ত্রপাতি আসার কথা, সেগুলো আসছে না। ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।

বৈঠক সূত্র বলছে, করোনা মহামারির পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের গতি কমে যায়। এ কারণে গত তিন অর্থবছর এই প্রকল্পের যে টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল, তা পুরোপুরি খরচ করতে পারেনি বাস্তবায়নকারী সংস্থা। রাশিয়ার সঙ্গে ঋণচুক্তির শর্ত অনুযায়ী, অব্যবহৃত টাকার ওপর কমিটমেন্ট ফি বা জরিমানা গুনতে হবে। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, রাশিয়া সফরে গিয়ে কমিটমেন্ট ফি বা জরিমানা মওকুফের অনুরোধ জানানো হবে।

বৈঠকে অন্যদের মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব জিয়াউল হাসান, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব শরিফা খান, রূপপুরের প্রকল্প পরিচালক শৌকত আকবরসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে বের হওয়ার পথে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রীর কাছে আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না।’

পরে ইআরডি সচিব শরিফা খানের কাছে বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে রূপপুরের জন্য নেওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ বন্ধ রয়েছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে ঋণ পরিশোধ করা যাচ্ছে না। কোন পদ্ধতিতে ঋণ পরিশোধ করা যায়, তার পথ বের করতে একটি প্রতিনিধিদলের রাশিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের রূপপুর প্রকল্পটি ২০২৫ সালে শেষ হওয়ার কথা। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে রাশিয়ার কাছ থেকে ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। এ ঋণের কিস্তি শুরু হবে ২০২৭ সাল থেকে। বৈঠকে আলোচনা হয়, ওই সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। কারণ, বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সুইজারল্যান্ড ও জার্মানি থেকে যেসব ভারী যন্ত্রপাতি আসার কথা, সেগুলো আসছে না। ফলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বিকল্প উৎস খুঁজতে হচ্ছে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা থাকায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরঞ্জাম খালাস না করে ভারতের জলসীমা ছেড়ে গেছে রুশ জাহাজ ‘উরসা মেজর’। প্রায় দুই সপ্তাহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পণ্য খালাসের অপেক্ষা করেছিল জাহাজটি। এখন সেসব ভারী সরঞ্জাম কার্গো করে আনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এসব কারণে প্রকল্পের কাজে গতি কমে গেছে। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ না হলে দুই দেশের মধ্যে ‘আর্থিক ঋণচুক্তি’ সংশোধন করতে হবে। প্রতিনিধিদলের রাশিয়া সফরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে বলে বৈঠক সূত্রে জানা যায়।