ছেলেকে র‍্যাগ দিয়ে মেরে ফেলা কালপ্রিটদের চেহারা দেখতে চাই: ইরফানের মা

ইরফান সাদিকের ছোটবেলার ছবি হাতে কাঁদছেন মা শাহিদা আক্তার। পাশে ইরফানের বোন ওয়াজিহা নাওয়ার সুবাইতা
ছবি: মানসুরা হোসাইন

ছেলে নদীতে ডুবে মারা গেছে প্রথমে এমনটাই শুনেছিলেন বলে জানালেন মালয়েশিয়ায় পড়তে যাওয়া ইরফান সাদিকের মা শাহিদা আক্তার। তবে তারপর একটি ভিডিও ফুটেজ সব এলোমেলো করে দিয়েছে। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ছেলেকে প্রায় বিবস্ত্র করে র‍্যাগ দেওয়া হচ্ছে।

মায়ের প্রশ্ন, ‘আমার ছেলেকে কারা বিবস্ত্র করল? কারা র‍্যাগ দিল? বিবস্ত্র অবস্থায় ভিডিও করল, অথচ আমার বাচ্চাটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করল না। মা হিসেবে ছেলেকে র‍্যাগ দিয়ে মেরে ফেলা ওই কালপ্রিটদের চেহারা দেখতে চাই।’

শাহিদা আক্তার বলেন, ‘আমার বাচ্চাটা বেঁচে নেই। বিভিন্ন গণমাধ্যম বলছে, আমি নাকি ছেলের মানসিক অবস্থার কথা জানতাম। আমি বা আমার পরিবার ছেলেকে বাঁচানোর কোনো চেষ্টা করিনি। অপবাদ পাচ্ছি, আমি একজন ব্যর্থ মা।’

২১ বছর বয়সী ইরফান সাদিক মালয়েশিয়ার সারাওয়াক রাজ্যের কুচিং শহরে অবস্থিত সুইনবার্ন ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে হিউম্যান রিসোর্স অব ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন।

ছবিতেই এখন ইরফানকে খুঁজে বেড়ান মা শাহিদা আক্তার
ছবি: মানসুরা হোসাইন

গত ১৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, ইরফান মারা গেছেন, নদী থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ইরফানের লাশ দেশে পৌঁছায় ২৫ সেপ্টেম্বর। তবে লাশ দেশে পৌঁছানোর আগেই পরিবার নির্যাতনের ভিডিও ফুটেজটি হাতে পায়। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মগবাজারের বাসায় বসে ইরফানের মা ও বোনদের সঙ্গে কথা হয়। সেখানেই এসব কথা বলেন তিনি।

২০২২ সালের ৩ আগস্ট ইরফান মালয়েশিয়ায় যান। এর আগে এক বছর ছেলে অনলাইনে ক্লাস করেন। ইরফানের মা শাহিদা আক্তার জানালেন, ছেলে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পর নিয়মিতভাবে ভিডিও কলে কথা বলতেন। ছেলে মারা যাওয়ার সপ্তাহখানেক আগে থেকে মা বুঝতে পারেন ছেলের মানসিক অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। ছেলের কী হয়েছে, তা বারবার জানতে চান। কিন্তু ছেলে তা এড়িয়ে যান। শাহিদা আক্তারের দুটো জটিল অস্ত্রোপচার হয়েছে। হয়তো এ জন্যই ছেলে তাঁকে সব জানায়নি বলে ভাবছেন মা।

মালয়েশিয়ায় গিয়ে ছেলে প্রথম যে দুজন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সঙ্গে একই বাসায় থাকতেন তাঁদের ফোন করে মা ছেলের কথা জানতে চেয়েছেন। একজন বাংলাদেশি শিক্ষককেও ছেলের কথা জানিয়ে খোঁজ রাখতে বলেছিলেন।

ইরফানের মা ও তিন বোন
ছবি: মানসুরা হোসাইন

শাহিদা আক্তার ভয়েস মেসেজে পাঠানো ছেলের বলা কথাগুলো শোনান। বললেন, ‘এই সব কথা আর ছবি দেখে কি আপনার মনে হচ্ছে যে ছেলে দীর্ঘদিন ধরে মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল? আমার ছেলেটা দেখতে খুব সুন্দর ছিল। বরফে শক্ত হয়ে যাওয়া ছেলের যে লাশ দেশে এসেছে, তার সঙ্গে আমার ছেলের কোনো মিল ছিল না। কুচকুচে কালো হয়ে যাওয়া একটি লাশ দেশে পৌঁছেছে।’

১৮ সেপ্টেম্বর ইরফান তাঁর এক খালুকে ফোন করে বাঁচানোর জন্য আকুতি জানিয়েছিলেন। এর আগের দিন (১৭ সেপ্টেম্বর) মাকে জানিয়েছিলেন, ধার দেওয়া টাকা ইরফান ফেরত পাাচ্ছেন না। কেউ তাঁর মাথার চুল অল্প একটু কেটে দিয়েছিল। ছেলে তখন রাগ করে মাথার চুল একেবারে ছোট করে ফেলেছিল। কেউ ছেলেকে জিন–ভূতের ভয় দেখায়। রাতে ঘুমাতে দেয় না। তাই ছেলে মসজিদে থাকে। এসব বলেছিল।

ওই দিনই ইরফান জানিয়েছিলেন, তাঁকে কেউ মাটিতে শুইয়ে মেরেছে। তাই ছেলে এর বদলা নেওয়ার জন্য জিমে ভর্তি হয়েছে। মা ছেলেকে বলেছিলেন, যত বড় সমস্যাই হোক, তা যাতে ছেলে বাবা–মাকে জানায়। বাবা–মা ভালো পরামর্শ দিতে পারবেন।

সুইনবার্ন ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে হিউম্যান রিসোর্স অব ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন ইরফান সাদিক
ছবি: সংগৃহীত

ইরফান সাদিকের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। মে মাসে ভিসা নবায়নের জন্য ৫৫ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন শাহিদা আক্তার। শাহিদা আক্তার বলেন, ‘আমি ছেলে মারা গেছে শোনার পর চাইনি ছেলের শরীরটা কাটাছেঁড়া করা হোক। তাই ময়নাতদন্ত চাইনি। কিন্তু নির্যাতনের ভিডিও দেখার পর ছেলে কেন মারা গেল, কীভাবে মারা গেল, কারা ছেলেকে র‍্যাগ দিল, তার তদন্ত চেয়েছি। এ তথ্যগুলো কি আমার জানার অধিকার নেই?’

ভিডিও ফুটেজ হাতে পাওয়ার পর তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে তদন্তের আবেদন করে ইরফানের পরিবার। ২৩ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা বিষয়টি দেখছে।

শাহিদা আক্তার বলেন, ‘প্রথমেই যদি ভিডিওটা হাতে পেতাম তাহলে শুরু থেকেই ছেলে হত্যার বিচার চাইতাম। এখন ছেলে হত্যার বিচার চাই। আমার ছেলে তো আর নিজে নিজের জামাকাপড় খুলে ফেলবে না। বাসায় মেহমান এলেও ছেলে কখনো খালি গায়ে থাকত না।’

মায়ের সঙ্গে ভিডিও কলে ইমরান সাদিক
ছবি: সংগৃহীত

শাহিদা আক্তার বলেন, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী হিসেবে ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন কাউন্সেলর থাকার কথা। ছেলের মানসিক অবস্থা খারাপ হয়ে থাকলে ওই কাউন্সেলর কী ভূমিকা পালন করেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কী পদক্ষেপ নিল? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এর দায় এড়াতে পারে না। এই মা বললেন, ‘আমার ছেলের তো আত্মহত্যা করার কথা না। যদি আত্মহত্যা করে থাকে এর পেছনে কারা দায়ী, তা জানতে চাই।’

দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম কথা না বলে নিজেদের মতো করে লিখে দিচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন শাহিদা আক্তার। শাহিদা আক্তার জানালেন, তাঁর ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয়। ছেলেকে পেটে নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেন। এরপর বাংলায় স্নাতকোত্তর করেন।

শাহিদা আক্তার বলেন, ‘বলতে গেলে ছেলে আর আমি একসঙ্গে বড় হয়েছি। ছেলে ছিল আমার বন্ধুর মতো। আমি চাই না আর কোনো মায়ের বুক খালি হোক।’

ইরফানের বাবা মো. ইসমাইল ব্যবসা করেন। ইরফানের তিন বোন। ওয়াজিহা নাওয়ার আর ওয়ালিয়া নাওয়ার যমজ। তারা দশম শ্রেণিতে পড়ছে। দিয়ানা জাহিন পড়ছে পঞ্চম শ্রেণিতে। তিন বোনের একমাত্র ভাই, বোনদের সঙ্গেও ইরফানের বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিল।

ইরফানের মৃত্যু নিয়ে যা বলেছে মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশন

মায়ের সঙ্গে ভিডিও কলে শেষ কথা হয় ইরফানের
ছবি: সংগৃহীত

মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশন ২৬ সেপ্টেম্বর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, এই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর খবর জানার পর মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. গোলাম সারোয়ার অফিসের কাউন্সেলর পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তাকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঘটনাস্থলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। ওই কর্মকর্তা শিক্ষার্থীর মারা যাওয়ার স্থান পরিদর্শন করেন এবং তিন দিন অবস্থান করেন। মৃত শিক্ষার্থীর পরিবারের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে লাশের ময়নাতদন্ত এবং পরবর্তী তদন্ত না করার জন্য আবেদন করা হয়। তাই ময়নাতদন্ত না করে লাশ বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর অনুমতি দেয় কর্তৃপক্ষ।

লাশ দেশে পাঠানোর দাপ্তরিক ও বিভিন্ন আনুষঙ্গিক জটিল প্রক্রিয়া শেষে পরিবারের পক্ষ থেকে আরেকটি চিঠি দিয়ে মৃত্যুর ঘটনাকে তদন্ত করে দেখার কথা বলা হয়। তবে তখন আর কোনো সুযোগ ছিল না। পরিবারকে প্রয়োজনে বাংলাদেশে পৌঁছানোর পর লাশের ময়নাতদন্ত করে প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য মৌখিকভাবে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যাতে প্রয়োজনে মালয়েশিয়ায় তদন্তের জন্য পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা যায়।

মায়ের সঙ্গে ইমরান
ছবি: সংগৃহীত

তবে এ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, মৃত শিক্ষার্থী কয়েক মাস ধরে মানসিক ট্রমা বা বিষণ্নতায় ভুগছিলেন বলে জানা যায়। ইরফান পরিবারকে এর আগেও তাঁর মানসিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত করেন, এমনকি আত্মহত্যা করবেন বলেও তাঁর মাকে জানান। তাঁর এমন অস্বাভাবিক আচরণ সম্পর্কে পরিবার এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবগত ছিলেন বলে জানা গেছে। কিন্তু কেউই তাঁকে এ মানসিক অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য যথেষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করেনি, যা খুবই দুঃখজনক।

হাইকমিশনের সংগৃহীত ভিডিওতে দেখা যায়, মৃত শিক্ষার্থী ঘটনাস্থলে মসজিদের বারান্দা থেকে নদীতে লাফ দেন। সেখানে বহু মানুষ, এমনকি সারওয়াক  পুলিশও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কেউ তাঁকে বাঁচানোর জন্য দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি।

বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রথম সচিব (প্রেস) সুফি আব্দুল্লাহিল মারুফের পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ইরফান মারা যাওয়ার পর এখন পরিবারের পক্ষ থেকে হাইকমিশনকে দোষারোপ করা হচ্ছে, যেখানে হাইকমিশন মারা যাওয়ার পরে বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হয়েছে।

তা ছাড়া ঘটনা ঘটেছে মালয়েশিয়ার মূলভূমি থেকে হাজার কিলোমিটার দূরে অন্য একটি রাজ্যে। শিক্ষার্থীর মানসিক অস্থিরতা জানার পরও এর আগে পরিবারের পক্ষ থেকে হাইকমিশনের কোনো সহায়তা চাওয়া হয়নি। শিক্ষার্থীর দীর্ঘদিন ধরে চলমান মানসিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা জানার পর অথবা দুঃখজনক মৃত্যুর পরও পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ ঘটনাস্থলে যাননি।

তবে ইরফানের মা শাহিদা আক্তার বলেন, মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনকে পরিবারের পক্ষ থেকে দোষারোপ করা হয়নি। ভিডিও ফুটেজ হাতে পাওয়ার পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তদন্তের আবেদন জানানো হলে হাইকমিশন থেকে জানানো হয়েছিল, তখন আর ময়নাতদন্ত করা সম্ভব না।