১২% বাড়িতে এডিস মশা

ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা। সরকারি উদ্যোগ ও নাগরিকের সচেতন আচরণ এডিস মশা কমাতে পারে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার ১৩ শতাংশ বাড়িতে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার লার্ভা বা শূককীট পাওয়া গেছে। এমন লার্ভা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে পাওয়া গেছে প্রায় ১২ শতাংশ বাড়িতে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার বর্ষাকালীন মশা জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে দেখা গেছে, দুই সিটি মিলিয়ে রাজধানীর ১২ শতাংশের বেশি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা আছে।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা বছরে তিনবার মশা জরিপ করে—প্রাক্‌–বর্ষা, বর্ষা ও বর্ষা–পরবর্তী জরিপ। আজ মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বর্ষাকালীন মশা জরিপের তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করার কথা রয়েছে।

জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে পড়ে থাকা বা ফেলে রাখা ভেজা পাত্রে বা ওয়েট কনটেইনারে। যেমন পানি জমে থাকা ঘর বা ভবনের মেঝে, প্লাস্টিকের ড্রাম বা প্লাস্টিকের নানা ধরনের পাত্রে লার্ভা পাওয়া গেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৬ শতাংশ এ ধরনের পাত্রে এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২২ শতাংশ পাত্রে মশার লার্ভা পাওয়া গেছে।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে। রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন গড়ে ৩০-৪০ জন পাওয়া যাচ্ছে।
ফজলে শামসুল কবির, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, ১১ থেকে ২৩ আগস্ট ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে এই জরিপ হয়েছে। জরিপে দুই সিটি করপোরেশনের ৩ হাজার ১৪৯টি বাড়ি পরিদর্শন করেন জরিপকারীরা। পরিদর্শনের সময় তাঁরা মশা বা মশার লার্ভা থাকতে পারে, এমন সব জায়গা ও পাত্র পরীক্ষা করে দেখেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এমন সময় এই জরিপের ফলাফল প্রকাশ করতে যাচ্ছে, যখন ডেঙ্গু প্রায় সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুবিষয়ক তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এ বছর ৫০টি জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। গতকাল সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যে তথ্য দিয়েছে, তাতে দেখা যায়, এ বছর এ পর্যন্ত ১২ হাজারের বেশি ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।

এর মধ্যে ৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে হাসপাতালে যত রোগী ভর্তি হচ্ছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। যেমন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে কক্সবাজার জেলায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১ হাজার ১০ জন। অন্যদিকে কক্সবাজার জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় জানিয়েছে, এ জেলায় ১৩ হাজারের বেশি মানুষের শরীরে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে।

পাত্রজাতীয় যেসব জিনিসপত্রে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়, সেগুলো ঘরের ভেতরের। বাসার ভেতরের এসব পাত্র পরিষ্কার রাখা প্রত্যেকের নিজের কাজ। তবে ডেঙ্গু মোকাবিলা একটি সমন্বিত কাজ।
গোলাম মোস্তফা সারোয়ার, ঢাকা উত্তর সিটির উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল

জরিপের ফলাফল

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপকারীরা নির্মাণাধীন ভবন, বাড়ি, বহুতলবিশিষ্ট ভবন, আধাপাকা বাড়ি, বস্তি এলাকা এবং ফেলে রাখা প্লটে মশার উপস্থিতি জানার চেষ্টা করেছেন।

যেসব জায়গায় বা পাত্রে তারা মশার লার্ভা দেখেছেন, তার মধ্যে আছে পানি জমে থাকা মেঝে, প্লাস্টিকের ড্রাম, প্লাস্টিকের নানা ধরনের পাত্র, প্লাস্টিকের বোতল, ব্যবহৃত টায়ার, ফুলের টব, পানির মিটারের গর্ত, সিমেন্টের পানির ট্যাংক, মাটির পাত্র, পলিথিন, অব্যহৃত কর্কশিট, ব্যাটারির খোসা, সিরামিকের পাত্র, ফ্লাগস্ট্যান্ডের গর্ত, যানবাহনের অংশ, নারকেলের খোলা, টিনের কৌটাসহ অনেক কিছু।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৬২টি ওয়ার্ডে তাঁরা মোট ১ হাজার ৮৩০টি বাড়ি পরীক্ষা করেছেন। এসব বাড়িতে তাঁরা মোট ১ হাজার ৩৩৭টি ভেজা পাত্র দেখেছিলেন। তাঁরা প্রায় ১২ শতাংশ বাড়িতে মশার লার্ভা পেয়েছেন। অন্যদিকে প্রায় ২২ শতাংশ ভেজা পাত্রে মশার লার্ভা ছিল। মশা ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে ৮ নম্বর ওয়ার্ড (কমলাপুর ও মতিঝিল), ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড ( নবাবপুর ও বংশাল) এবং ৪১ নম্বর ওয়ার্ডে (ওয়ারী ও নারিন্দা)।

এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে। রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন গড়ে ৩০-৪০ জন পাওয়া যাচ্ছে।

যা মোট রোগীর মাত্র ১০-১২ শতাংশ। এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে তারা যে ওয়ার্ডগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে দিয়েছিল, সেসব ওয়ার্ডে টানা এক সপ্তাহ বিশেষ অভিযান চালানো হয়েছে। অন্য ওয়ার্ডেও এডিস মশা নিধনের সব কার্যক্রম অব্যাহত আছে।

জরিপকারীরা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৪১টি ওয়ার্ডের মোট ১ হাজার ৩১৯টি বাড়ি পরীক্ষা করেছেন। এসব বাড়িতে তাঁরা মোট ৮৬১টি ভেজা পাত্র দেখেছিলেন। তাঁরা প্রায় ১৩ শতাংশ বাড়িতে মশার লার্ভা পেয়েছেন। অন্যদিকে প্রায় ৩০ শতাংশ ভেজা পাত্রে মশার লার্ভা ছিল। মশার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে ১৪ নম্বর ওয়ার্ড (সেনপাড়া পর্বতা, কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়া), ২১ নম্বর ওয়ার্ড (মহাখালী), ২৪ নম্বর ওয়ার্ড (বেগুনবাড়ি ও তেজগাঁও শিল্প এলাকা) ও ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে (আগারগাঁও)।

ঢাকা উত্তর সিটির উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম মোস্তফা সারোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, পাত্রজাতীয় যেসব জিনিসপত্রে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়, সেগুলো ঘরের ভেতরের। বাসার ভেতরের এসব পাত্র পরিষ্কার রাখা প্রত্যেকের নিজের কাজ। তবে ডেঙ্গু মোকাবিলা একটি সমন্বিত কাজ। শুধু নাগরিকদের বলা হলে, অথবা শুধু সিটি করপোরেশন কাজ করলে এটা সম্ভব নয়।

 ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ওই দুই কর্মকর্তা বলেছেন, এডিস মশার বেশির ভাগ উৎস মানুষের বাসার ভেতরে। বাড়ির বারান্দায় কিংবা ছাদবাগানের বিভিন্ন পাত্রে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। সিটি করপোরেশনের পক্ষে প্রত্যেকের বাসা, বারান্দা কিংবা ছাদবাগানে যাওয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, মানুষকে সচেতন করার উদ্যোগ আরও জোরদার করতে হবে। মানুষকে বলতে হবে, বাড়ির ভেতর, ঘরের ভেতর পানি জমতে দেওয়া যাবে না।