‘মরবার আগে ছেলের সঙ্গে যদি একবার কথা বলতাম’

নিহত নবীর হোসেন
ছবি সংগৃহীত

মাদ্রাসার আলিম শ্রেণির শিক্ষার্থী নবীর হোসেন শিক্ষকদের বকাঝকা আর শাসন সইতে না পেরে পালিয়েছিলেন। কাজ নিয়েছিলেন বালু তোলার একটি বাল্কহেডের শ্রমিক হিসেবে। এ নিয়ে বাবা রাগ করে কথাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন নবীরের সঙ্গে। তবে অভিমানী ছেলেটি আর বাড়ি ফিরবেন না—এটা ভাবতে পারেননি বাবা মো. ইব্রাহিম।

আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের আকিলপুর সৈকত থেকে গাউছিয়া কমিটির স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় নবীরের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ছেলের লাশ নিতে এসে বাবা মো. ইব্রাহিম কিছুতেই শান্ত হচ্ছিলেন না। বারবার বলছিলেন, ‘মরবে জানলে একবার কথা বলতাম। হায়, ছেলের সঙ্গে একবার কেন কথা বলি নাই?’

নিহত নবীর হোসেন গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ডুবে যাওয়া বালু বহনকারী একটি বাল্কহেডের শ্রমিক ছিলেন। ওই নৌযানে নবীরসহ চার শ্রমিক নিখোঁজ হন। তাঁদের মধ্যে কেবল আজ নবীরের লাশ পাওয়া গেল। এর আগে বাল্কহেডডুবির ঘটনায় সীতাকুণ্ড থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিল নৌযানটির মালিক সৈয়দ জুনাইদুল হক।
নৌ পুলিশের কুমিরা ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মো. নাসির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আজ সকালে উপকূলে একটি লাশ পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয় লোকজন তাঁদের বিষয়টি জানান। পরে তাঁরা গাউছিয়া কমিটির সহযোগিতায় লাশটি উদ্ধার করেন।

সীতাকুণ্ড থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবু সাঈদ প্রথম আলোকে বলেন, ২৫ ফেব্রুয়ারি সন্দ্বীপ চ্যানেলে বালু বহনকারী একটি বাল্কহেড ডুবে যায়। সে সময় চার নৌশ্রমিক নিখোঁজ হন। এরপর ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল তাঁদের উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়েও উদ্ধার করতে পারেনি। গত মঙ্গলবার সীতাকুণ্ড থানায় এ–সংক্রান্ত একটি জিডি করেন বাল্কহেডের মালিক সৈয়দ জুনাইদুল হক।

সৈকতে ভেসে আসা বাল্কহেড নৌযানের শ্রমিক নবীর হোসেনের লাশ উদ্ধার করছেন গাউছিয়া কমিটির স্বেচ্ছাসেবক ও পুলিশ সদস্যরা। আজ আজ বেলা ১২টার দিকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের আকিলপুর সৈকতে
প্রথম আলো

জিডিতে উল্লেখ করা হয়, ২৫ ফেব্রুয়ারি বালুভর্তি বাল্কহেড সীতাকুণ্ড উপকূল থেকে সন্দ্বীপের দিকে যাচ্ছিল। বেলা দেড়টার দিকে ঢেউয়ের আঘাতে বাল্কহেডের পেছনের অংশ ডুবে যায়। এ সময় সামনে অংশ ওপরের দিকে উঠে যায়। ওই ঘটনায় বাল্কহেডে থাকা চার নৌশ্রমিক নিখোঁজ হন। নিখোঁজ নৌশ্রমিকেরা হলেন আবদুল মান্নান, আবদুল হান্নান, সোনা মিয়া ও নবীর হোসেন।

এর আগে গাউছিয়া কমিটির সদস্য মামুনুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, নিহত তরুণের গায়ে হলুদ রঙের টি-শার্ট রয়েছে। তাঁরা লাশ উদ্ধার করে নৌ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছেন। পরে পরিবারের সদস্যরা অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এসে লাশ নিয়ে যান।

দাদির পাশে হবে কবর

নিহত নবীর হোসেন লক্ষ্মীপুরের একটি মাদ্রাসায় আলিম শ্রেণিতে পড়াশোনা করতেন। সেখান থেকে পালিয়ে এসে সীতাকুণ্ডের একটি বাল্কহেডে চাকরি নেন। এ কারণে তাঁর বাবাও রাগ করে কথা বলতেন না নবীর হোসেনের সঙ্গে। ছেলের লাশ নিতে এসে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এ কথা বলেন নিহত নবীর হোসেনের বাবা।

মো. ইব্রাহিম প্রথম আলোকে বলেন, মাসখানেক আগে তাঁর ছেলেকে মাদ্রাসার শিক্ষকেরা বকাঝকা করেন এবং শাস্তি দেন। রাগে, ক্ষোভে, অভিমানে মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে পরিবারের কাউকে না জানিয়ে সীতাকুণ্ডে চলে আসেন নবীর। এরপর এখানে একটি বালু বহনকারী বাল্কহেডে শ্রমিকের কাজ নেন। এই অভিমানে তাঁর ছেলেকে প্রাণ দিতে হলো।

মো. ইব্রাহিম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘ছেলে পড়াশোনা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কারণে রাগ করে কথা বলতাম না আমি। সে তার মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিল। এখন ছেলের জন্য এত কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে, মরবার আগে একবার কেন ছেলের সঙ্গে কথা বলিনি? তার দাদি তাকে খুব আদর করত। তাই তাকে দাদির কবরের পাশে দাফন করব।’