সাইবার নিরাপত্তা আইনে মানুষকে হয়রানির সুযোগ রয়েছে

প্রতীকী ছবি

সাইবার নিরাপত্তা আইনে মানুষকে হয়রানির সুযোগ থাকছে উল্লেখ করে অংশীজনদের মতামত নিয়ে প্রস্তাবিত এই আইনে সংশোধন আনার দাবি জানিয়েছেন একদল অধিকারকর্মী। তাঁরা বলেছেন, সাইবার নিরাপত্তা আইনের বেশ কিছু ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে আইনটি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

এই আইন নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সাইবার সুরক্ষার বিষয় মাথায় রেখে প্রয়োজনীয় সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন অধিকারকর্মীরা। আর এর নাম সাইবার নিরাপত্তা আইনের পরিবর্তে সাইবার সুরক্ষা আইন করার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।

নিজেদের মুক্ত গণমাধ্যম ও ডিজিটাল অধিকারকর্মী পরিচয় দিয়ে ১২ জন অধিকারকর্মী আজ রোববার এক বিবৃতিতে এসব কথা বলেছেন। বিবৃতিদাতারা হলেন বাংলাদেশ মানবাধিকার সাংবাদিক ফোরামের আহম্মদ উল্লাহ, ভয়েসের আহমেদ স্বপন মাহমুদ, সাউথ এশিয়ান মিডিয়া সলিডারিটি নেটওয়ার্কের খায়রুজ্জামান কামাল, গণমাধ্যম অধিকারকর্মী মাইনুল ইসলাম খান, মানবাধিকারকর্মী ও গবেষক রেজাউর রহমান লেনিন, গ্লোবাল ভয়েসেসের রেজওয়ান ইসলাম,  আইনজীবী মো. সাইমুম রেজা তালুকদার, এফইএক্সবির সালিম সামাদ, মানবাধিকারকর্মী সাঈদ আহমেদ,  মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী শারমিন খান, উন্নয়নকর্মী শামীম আরা শিউলী এবং পেন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সৈয়দা আইরিন জামান।

৭ আগস্ট বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বদলে সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩–এর অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। ৯ আগস্ট আইনটির খসড়া প্রকাশ করে নাগরিকদের মতামত চাওয়া হয়েছে।  

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করার সিদ্ধান্ত এবং নাগরিকদের মতামত প্রদানের সুযোগকে সাধুবাদ জানানো হয়েছে বিবৃতিতে। তবে অধিকারকর্মীরা এও বলেছেন, অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা না করে, আন্তর্জাতিক আঞ্চলিক ও দেশীয় মানবাধিকারের ধারণার সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্য না রেখে, সাইবার অপরাধ, নিরাপত্তা ও পরিসরের বিষয় পরিষ্কার না করে, প্রশাসনিক ক্ষমতা ও দায়িত্বে বিচারিক পর্যবেক্ষণের আওতায় না এনে তড়িঘড়ি করে মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রস্তাবিত আইনটি অনুমোদন করা দুঃখজনক। এ ছাড়া এটি নাগরিক বান্ধব আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারায় অপরাধ নির্ণয় হবে দণ্ডবিধির ৪৯৯ ও ৫০০ ধারায় এবং শাস্তি হবে প্রস্তাবিত আইনে, যা প্রস্তাবিত আইনটির উদ্দেশ্য নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে। শাস্তি প্রদানের এই  তারতম্য সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ ছাড়া আরও কিছু ধারা জামিনযোগ্য করার সুযোগ রয়েছে।

প্রস্তাবিত আইনে সীমিত পরিবর্তন এসেছে উল্লেখ করে অধিকারকর্মীরা হতাশা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, প্রস্তাবিত আইনটিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রতিটি অধ্যায়ের ধারা, সংজ্ঞা, বর্ণনা, প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্পণ প্রায় একই রকম। এ ছাড়া প্রস্তাবিত আইনটির অনেক ধারা জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতি, নৈতিকতা ও মানদণ্ডের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ফলে আইনটি আগামী দিনে মানুষকে হয়রানির উদ্দেশ্যে সহজে ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া আইনটিতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে এখনো একধরনের অপরাধীকীকরণ করা আছে, যা জনগণের মৌলিক মানবাধিকার এবং স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করতে পারে।

অধিকারকর্মীরা মনে করেন, প্রস্তাবিত আইনের  ৮, ৯, ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২৪, ২৫, ২৮, ২৯ এবং ৩২ ধারাগুলো সংবিধান, মৌলিক মানবাধিকারের নীতি এবং আইনের শাসনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ ছাড়া আইনের ৪২ ধারাটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩ ধারার সঙ্গে খুব বেশি পার্থক্য না থাকায়, তা হয়রানিমূলক এবং নিবর্তনমূলক হয়ে ওঠার সুযোগ রয়ে গেছে, যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকারের নীতিমালাগুলোকে হেয়প্রতিপন্ন করার সুযোগ তৈরি করতে পারে।

অধিকারকর্মীরা বেশ কিছু দাবি জানিয়েছেন, সংসদে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিতকরণকল্পে প্রণীত আইন’ উত্থাপন করে আইনটি বাতিল করা। শিরোনামে সাইবার নিরাপত্তার আইনের পরিবর্তে সাইবার সুরক্ষা আইন করা। তথ্য  ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মৌলিক অধিকার চর্চা করার কারণে যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সেসব মামলা বাতিল করে বন্দীদের মুক্তি দেওয়া। এ জন্য নাগরিক বান্ধব বিচারিক তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।

এ ছাড়া অধিকারকর্মীরা আরও বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সামাজিক ও মানবিক মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সরকারকে রাজনৈতিকভাবে দায়বদ্ধ হতে হবে। প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা বজায় রেখে সাইবার সুরক্ষার বিষয় মাথায় রেখে প্রয়োজনীয় সংশোধন করতে হবে। এ ছাড়া আইনটি নিয়ে মতামতের জন্য ১৪ দিন যথেষ্ট নয় বলেও উল্লেখ করেন তাঁরা। পাশাপাশি সাইবার নিরাপত্তা আইনটি তড়িঘড়ি করে সংসদে উত্থাপন না করার আহ্বান জানিয়েছেন।