কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষক লাঞ্ছিত: ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে তদন্ত এগোচ্ছে না

ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১০ জানুয়ারি ছাত্রলীগ সভাপতির নেতৃত্বে নেতা–কর্মীরা তিন শিক্ষিকাকে লাঞ্ছিত করেন। এরপর বিষয়টি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত গণতান্ত্রিক শিক্ষক ফোরামের (একাংশ) নেতারাফাইল ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নেতা–কর্মীদের হাতে তিনজন শিক্ষিকা লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনার পর দেড় মাসেও তদন্তে কোনো অগ্রগতি হয়নি। বরং এর মধ্যে তদন্ত কমিটিতে দুবার পরিবর্তন আনা হয়েছে বলে জানা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির এই তদন্ত কমিটির প্রধান সুকুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেছেন, কমিটি দুবার পরিবর্তন করার কারণে তাদের তদন্তে কিছুটা দেরি হচ্ছে।

গত ১০ জানুয়ারি ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বর্তমান একজন নেতা ও তাঁর সমর্থকদের হাত থেকে সংগঠনটির সাবেক একজন নেতাকে বাঁচাতে গিয়ে তিনজন শিক্ষিকা লাঞ্ছিত হন। তাঁরা তিনজনই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত শিক্ষক ফোরামের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

তাঁদের একজন আওয়ামী লীগ সমর্থিত গণতান্ত্রিক শিক্ষক ফোরামের একাংশের সাধারণ সম্পাদক পূর্বা ইসলাম প্রথম আলোকে বলেছেন, বিচার পাওয়া নিয়ে তাঁদের এখন সন্দেহ তৈরি হয়েছে। কারণ, তাঁরা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ কয়েকজন নেতাকে ঘটনা সম্পর্কে জানিয়েছেন। কিন্তু ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ তাঁরা দেখছেন না। অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তদন্তেও অগ্রগতি নেই। এমন পরিস্থিতিতে ঘটনার শিকার শিক্ষিকারা হতাশায় ভুগছেন।

এ ঘটনায় শুরু থেকেই তদন্ত কমিটি গঠনের ব্যাপারেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গড়িমসি ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. ছাইফুল ইসলাম গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার পরপর তাঁরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। কিন্তু যে শিক্ষিকারা লাঞ্ছিত হওয়ার অভিযোগ করেছেন, তাঁদের আপত্তির কারণে তদন্ত কমিটির সদস্যদের দুবার পরিবর্তন করতে হয়েছে।  

আরও পড়ুন

কী ঘটেছিল সেদিন

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক প্রথম আলোর প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন, আফতাব দুর্বার নামের ভেটেরিনারি অনুষদের এক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আগের কমিটিতে ছিলেন। সাবেক এই নেতার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ছাত্রলীগ সভাপতি খন্দকার তায়েফুর রহমানের বিরোধ ছিল। যে কারণে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আফতাব দুর্বার ক্যাম্পাসে আসতে পারতেন না। তবে গত ১০ জানুয়ারি আফতাব দুর্বার একটি পরীক্ষায় অংশ নিতে ক্যাম্পাসে আসেন। ওই দিন বিকেলে ভেটেরিনারি অনুষদের লেভেল–৪–এর সেমিস্টার–২–এর পরীক্ষায় আফতাব দুর্বার অংশ নিলে কিছু ছাত্রলীগ কর্মী তাঁকে পরীক্ষা হলেই মারধর করতে উদ্যত হন।

সে  সময় পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন করা একজন শিক্ষক বিষয়টি ভেটেরিনারি বিভাগের শিক্ষক গণতান্ত্রিক শিক্ষক ফোরামের একাংশের সাধারণ সম্পাদক পূর্বা ইসলামকে জানান। পূর্বা ইসলাম দ্রুত বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্বপাপ্ত শিক্ষকদের জানালে কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রক্টর ও শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ঘটনাস্থলে যান। তখন প্রক্টর এবং শিক্ষক সমিতির নেতাসহ অন্য শিক্ষকেরা আফতাব দুর্বারকে শিক্ষিকা পূর্বা ইসলামের কক্ষে নিয়ে যান। কিন্তু সেখানেই তাঁকে মারধর এবং তিনজন শিক্ষিকাকে লাঞ্ছিত করার ঘটনা ঘটে।

আরও পড়ুন

ঘটনা সম্পর্ক বিশ্ববিদ্যালয়টির একাধিক শিক্ষকের বর্ণনায় জানা যায়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সভাপতির উপস্থিতিতেই ছাত্রলীগ কর্মীরা আফতাবকে শিক্ষকদের সামনে ওই কক্ষেই মারধর শুরু করেন। তখন শিক্ষিকা পূর্ব ইসলামসহ আরও কয়েকজন শিক্ষক আফতাব দুর্বারকে মারধর থেকে রক্ষার চেষ্টা করেন। ওই সময় ছাত্রলীগ নেতা–কর্মীরা শিক্ষিকা পূর্বা ইসলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর আফরিনা মুস্তারীসহ তিনজন শিক্ষিকাকে লাঞ্ছিত করেন। তাতে পূর্বা ইসলাম ও আফরিনা মুস্তারী আহত হন। তাঁরা এখনো পুরোপুরি সুস্থ হননি।
 
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি খন্দকার তায়েফুর রহমান শিক্ষিকাদের লাঞ্ছিত করার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। গতকাল তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে তাঁর কাছে লিখিত জবাব চাওয়া হয়েছিল। তিনি সময়মতো জবাব দিয়েছেন।

আরও পড়ুন

তদন্ত এগোচ্ছে না কেন

ঘটনার শিকার শিক্ষকদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রথমে তদন্ত কমিটি গঠনেই গড়িমসি করেছিল। পরে শিক্ষকদের দাবির মুখে তদন্ত গঠন করা হলেও সেই কমিটি দুবার পরিবর্তন করা হয় এবং পুনর্গঠিত কমিটির তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. ছাইফুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনার পরপর আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। তবে পূর্বা ইসলামসহ গণতান্ত্রিক শিক্ষক ফোরাম (একাংশ) তদন্ত কমিটি নিয়ে আপত্তি করে। তাঁদের আপত্তির কারণে দুবার কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সুকুমার সাহাকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি চূড়ান্ত হয়। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের অষ্টম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। এ জন্য তদন্ত কমিটি কিছু দিন সময় চেয়েছে।’

তদন্ত কমিটির প্রধান সুকুমার সাহা বলেন, শুরু থেকে দুবার এ তদন্ত কমিটি পরিবর্তন হয়েছে। তিনি শুরু থেকেই কমিটিতে আছেন। শুরুর দিকে তদন্ত কাজ কিছুটা এগোনোর পর আবার কমিটির সদস্য পরিবর্তন হওয়ার কারণে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের জন্য তদন্ত কাজ কিছুটা দেরি হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে দুটি সভা করেছি। দ্রুত এ তদন্ত কাজ শেষ করা চেষ্টা রয়েছে।’

তবে শিক্ষিকা পূর্বা ইসলামের অভিযোগ, তাঁদের লাঞ্ছিত ও আহত করার ঘটনার প্রায় দেড় মাস হয়ে গেলেও তদন্তে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। তিনি গতকাল শনিবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ আমাদের কোনো খোঁজও নেয়নি। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ও আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছেও বিচার চেয়েছি। তবে এখন পর্যন্ত কোনো বিচার পাইনি।’