পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসের খোঁজে

সুমনকুমার দাশ

একুশকে কেবল একটি ঐতিহাসিক তারিখ হিসেবে বিবেচনা করলে ভুল হবে। বাঙালি জাতিসত্তা মূলত সুপ্রতিষ্ঠিত হয় একুশের হাত ধরেই। একুশ বাঙালির আত্মশক্তি আর অহংবোধকে তুলে ধরে। একুশ মানেই গণতান্ত্রিক, উদারনৈতিকতা ও প্রগতিভাবাপন্ন রাষ্ট্র এবং সুষম সমাজ গড়ার শপথ। ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতিকে মর্যাদা দেওয়াও একুশের চেতনার মধ্যেই পড়ে। তাই একুশ নিয়ে অহংকার করতে চাইলে ভাষা আন্দোলনের চেতনাকেও ধারণ করতে হবে। একুশের মূল চেতনাই হচ্ছে ভাষাকে সম্মান প্রদর্শন, সেটা হোক নিজের বা অন্যের।

১৯৫২ সালে শহর থেকে গ্রাম—সর্বত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার দাবিতে সবাই যে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন, এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলেন প্রয়াত বাউলসাধক শাহ আবদুল করিম। ১৯৫২ সালে তিনি ছিলেন ৩৬ বছরের তরুণ। সে সময় করিম নেত্রকোনা অঞ্চলে গান গাইতে যান। সেখানে থাকা অবস্থায়ই তিনি ঢাকার রাজপথে সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতদের শহীদ হওয়ার ঘটনা জানতে পারেন। অন্য অনেকের মতো তিনিও এ ঘটনায় বিমর্ষ ও ক্ষুব্ধ হন।

নেত্রকোনা থাকা অবস্থায়ই সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের ধল গ্রামের তরুণ বাউল-গীতিকার শাহ আবদুল করিম লেখেন, ‘মুখের বোল কাড়িয়া নিবে/ রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে/ ঘোষণা করিল যখন/ যারা বাংলা মায়ের ছেলে/ পরিষ্কার দিলো বলে/ মানবো না থাকিতে জীবন/ রাখতে বাংলা ভাষার মান/ অকাতরে দিলো প্রাণ/ আমরা যে বাঁধা ঋণে।’

তাৎক্ষণিকভাবে রচিত এ গান করিম তখন বিভিন্ন মঞ্চে পরিবেশনও করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি গানটি পরিমার্জন করে তাঁর ভাটির চিঠি (১৯৯৮) বইয়ে সংকলিত করেন।

শুধু করিমই নন, তাঁর নিজ উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের কামাল উদ্দিনসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক বাউল-গীতিকার ভাষা আন্দোলনের সময়টাতে গান রচনা করে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বিকশিত করতে কাজ করেছেন। যদিও এসব গ্রামীণ গীতিকারের অবদানের বিষয়টি ইতিহাসে কমই ঠাঁই পেয়েছে।

এমনকি মফস্‌সলে যেসব শিক্ষক-শিক্ষার্থী কিংবা রাজনীতিসচেতন ব্যক্তি ভাষা আন্দোলনের দাবিকে সমর্থন করে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তার হদিসও ভাষা আন্দোলন-সম্পর্কিত ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে খুব একটা মেলে না। ভাষা আন্দোলন-সম্পর্কিত ইতিহাসের প্রায় পুরোটাই দখল করে আছে রাজধানী ঢাকা ও বড় জেলা শহরগুলো। এর বাইরে গ্রামীণ পর্যায়ে ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক তৎপরতার বিষয়টি তেমন আলোচনায় আসেনি।

গ্রামীণ পর্যায়ে অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তি ও শিক্ষার্থী ভাষা আন্দোলনে মিছিল-সমাবেশে তৎপর থাকলেও সেসব ইতিহাস সংরক্ষণে রাষ্ট্রীয়ভাবে সেভাবে উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। বইপুস্তক প্রকাশ বা স্মৃতিচারণাধর্মী লেখার মাধ্যমে সে সময়কার ঘটনা অনেকে লিপিবদ্ধ করেছেন। তবে তা তত ব্যাপক নয়। এমনকি ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে গ্রামীণ চারণকবিরা গান রচনা করে মানুষজনকে উজ্জীবিত করলেও বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া সেসব ব্যক্তির অবদান সবিস্তার কোথাও উপস্থাপিত হয়নি। ফলে দুই বছর আগে ভাষা আন্দোলনের সাত দশক পেরিয়ে গেলেও বস্তুত তখনকার ইতিহাস পূর্ণাঙ্গরূপে এখনো প্রচারের আলোয় আসেনি। অথচ একুশের পরিপূর্ণ ইতিহাস ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যই গ্রামীণ সাধককবিদের রচনা দ্রুত সংরক্ষণ করা জরুরি।

সংরক্ষণের বিষয়টি মাথায় রেখেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাধককবিদের জীবন এবং ভাষা আন্দোলন–সম্পর্কিত তাঁদের রচনা এক মলাটে ঠাঁই দিতে একটা গবেষণার কাজ করছি এক দশক ধরে। শিগগির তা বই হিসেবে মুদ্রণের উদ্যোগ নেওয়া হবে এবং এটা প্রকাশের মধ্য দিয়ে হয়তো একুশের চেতনা বিকাশে ভূমিকা রাখা সাধককবিদের অবদান কিছুটা হলেও আদরণীয় হবে।

সুমনকুমার দাশ: গবেষক ও প্রাবন্ধিক