ওদের জন্য আজও প্রাণ কাঁদে

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]

তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। সাল ১৯৮৩। ঘরকুনো ছিলাম। বাসায় একটা পুরোনো প্রাণিবিদ্যার বই পড়ে ছিল। আমি সেটা নেড়েচেড়ে ‘কুনো ব্যাঙের ব্যবচ্ছেদ’ বিষয়টায় আকৃষ্ট হই। বরিশাল শহরের করিম কুটির এলাকায় আমাদের টিনের ঘরের আনাচকানাচে অনেক কুনো ব্যাঙ।

একদিন সাহস করে একটা ব্যাঙ ধরে বই দেখে ব্যবচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিই। কলাগাছের খোলে চার পায়ে পিন পুঁতে ব্যাঙটাকে চিত করে শুইয়ে শুরু করলাম কাজ! কোনো অজ্ঞান করার দ্রব্য ছিল না। বলাকা ব্লেড দিয়ে সযত্নে কেটে ভেতরের ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড, যকৃৎ, অন্ত্র দেখে অবাক হলাম। হুবহু বইয়ের মতো। ব্যাঙটার কোনো অঙ্গ নষ্ট করিনি, তাই বেঁচে ছিল। শেষে কী করব, ভেবে পাচ্ছিলাম না। মায়ের সুই-সুতার ডিব্বা থেকে একটা সোনামুখী সুই আর সুতা নিয়ে সেলাই করে ছেড়ে দিলাম তাকে। সে দিব্যি লাফিয়ে চলে গেল। পরে আর তার দেখা পেলাম না। কিন্তু মনটা খচখচ করছিল।

পরে যা করলাম তা হলো, খাটের নিচ থেকে আরেকটা ব্যাঙ ধরে একটা বড় টিনের কৌটায় ভরে জামাই আদরে পালন করতে লাগলাম। টিনের কৌটার মধ্যে মাটি, ঘাস-পাতা দিলাম। মুখ ফুটো করে দিলাম। রাখলাম গাছের আড়ালে। নিয়মিত খাবার ও পানি দিতে লাগলাম। স্কুল থেকে ফিরে কেঁচো ধরে খেতে দিতাম। সে গপাগপ খেত। মাঝেমধ্যে মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে ছোট চিংড়ি চুরি করে তাকে দিতাম।

বেশ কিছুদিন এভাবে পালন করার পর মনে হলো, তাকে ছেড়ে দেওয়া দরকার। একদিন ছেড়েও দিলাম। সে মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু পরদিন স্কুল থেকে ফিরে যা দেখলাম, তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। দেখি, ওই গাছের আড়ালে সেই ব্যাঙটা! স্পষ্ট বুঝলাম, সে আমার সঙ্গে ভাববিনিময় করতে চাইছে, যাচ্ছে না। আমি তার জন্য কয়েকটা কেঁচো খুঁজে আনলাম। মহা উৎসাহে খেলো এবং এ ঘটনা নিয়মিত ঘটতে থাকল। স্কুল থেকে ফিরে তার জন্য খাবারের ব্যবস্থা, তারপর আমার আহার। কত দিন এভাবে চলেছিল, ঠিক মনে নেই। তবে একটা কুনো ব্যাঙ আর ঘরকুনো মানুষের মধ্যে যে এ রকম সখ্য হতে পারে, তা ভেবে আজও রোমাঞ্চিত হই।

২.

২০০৮ সালে বিড়ালটি প্রথম আমাদের বাসায় আসে। আমার এক ভাইপো নিয়ে আসে। অল্প দিনেই আমার সঙ্গে ভাব হলো। কিন্তু বাসার অন্যরা তাকে তেমন পছন্দ করল না। তার জন্য আলাদা কোনো খাবারের বরাদ্দ নেই। মাছের কাঁটা-উচ্ছিষ্টই ভরসা। অসম্ভব সুন্দরী ছিল সে। পাড়ার ছোকরারা তাকে ভালো ভালো খাবারের প্রলোভন দেখিয়ে নিতে চাইত; কিন্তু আমাদের বাসার স্বল্প আপ্যায়নই তার পছন্দ। অল্প দিনেই আমার স্ত্রী তার শত্রু হয়ে উঠল। কারণ, তিনি বিড়াল ভয় পান। তাই বিড়ালটি খুব একটা তার সামনে পড়ত না। আমার রুমের ভেতরেও কখনো ঢুকত না। তখনো তার গলায় একটা রশি ছিল।

একদিন গভীর রাতে তার কান্না শুনি। কেমন অস্বাভাবিক লাগল। গিয়ে দেখি, মাচার ওপর কোনো কিছুতে তার গলার রশিটা আটকে আছে আর সে ফাঁসির আদলে ঝুলে আছে। হয়তো আরেকটু হলে শ্বাসরোধে মারাই যেত। আমি তাকে ছাড়িয়ে দিলাম। সেই থেকে সে আমার ভক্ত হয়ে গেল। দুপুর ও রাতের খাবারের আগমুহূর্তে রুমের বাইরে আমার স্যান্ডেলের ওপর বসে অপেক্ষা করত। আমি বের হয়ে ডাইনিংয়ে বসলে সে পায়ের কাছে বসে থাকত খাবারের অপেক্ষায়। তাকিয়ে থাকত, কিন্তু আমি তাকালেই মুখটা নিচের দিকে নামিয়ে নিত। ডাইনিংয়ে খাবার খোলা থাকলেও কখনো মুখ দিত না। মজার ব্যাপার হলো, রোজার সময় দিনের বেলা সে খাবারের জন্য আসত না।

একবার আমার জ্বর হলো, আমি কাঁথা গায়ে শুয়ে থাকলাম। বিড়ালটাকে দেখলাম, আমার খাটে এসে পায়ের কাছে গোল হয়ে শুয়ে আছে। সেদিন আর সে আমার স্ত্রীর ভয়ে পালাল না।

২০১২–তে আমি সিরাজগঞ্জের খাজা ইউনূস আলী মেডিকেল কলেজে ছয় মাসের জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণে যাই। দু–তিন সপ্তাহ পরপর বরিশালের বাসায় আসতাম। সে তো আমাকে ভুলতই না; বরং আমাকে পেলে দীর্ঘক্ষণ আমার শরীরে গা ঘষত।

২০১৬–তে আমাদের টিনের ঘর ভেঙে দালান তৈরির জন্য কিছুদিনের জন্য ভাড়া বাসায় উঠতে হয়। তখন সে হারিয়ে যায়। আর তাকে খুঁজে পাইনি। আজও খুঁজছি। আজও হলুদ-সাদা-ছাই রঙের কোনো বিড়াল দেখলে বুকটা কেঁপে ওঠে।

আ ন ম মঈনুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ, বরিশাল