আমি তখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। থাকি নানাবাড়িতে।
একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখি, প্রচণ্ড উত্তেজনা। প্রথমে তো ভয়ে জড়োসড়োই হয়ে পড়লাম। পরে বুঝতে পারলাম, হট্টগোলের মূলে আমার খালামণি। বাড়ি থেকে তাঁর বিয়ে ঠিক করা হয়েছে, কিন্তু তিনি রাজি নন। তিনি অন্য একটা মানুষকে ভালোবাসেন। ভদ্রলোককে আমি দেখিনি। শুধু শুনতে পেলাম যে খালামণি বলে দিয়েছেন, ওই ছেলের সঙ্গেই যেন তাঁর বিয়ে হয়। বাড়ির একজনও খালামণির প্রস্তাবে রাজি নন। কারণ, খালামণি যে ছেলেকে পছন্দ করতেন, তাঁদের পরিবার আর্থিকভাবে মোটেই সচ্ছল নয়। খালামণির তীব্র জেদ আর হাজার ‘না’-এর পরও বাড়ির পছন্দ করা পাত্রের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের দিন খালামণিকে কে একজন পালিয়ে যাওয়ার বুদ্ধি দিয়েছিল। কিন্তু খালামণি সেটা করেননি। পরিবারকে তিনি অমর্যাদার মধ্যে ফেলে দিতে চাননি। বিয়ে করে খালামণি শ্বশুরবাড়ি চলে গেলেন।
বেশ কিছুদিন পর খালামণি বাবার বাড়িতে এলেন। দেখতে পেলাম, তাঁর হাত ভাঙা। কী কারণে স্বামী নাকি তাঁকে ধাক্কা দিয়েছিলেন। পড়ে গিয়ে তাঁর হাত ভেঙে যায়। খালামণি সেই যে এলেন, বেশ কয়েক মাস থেকে গেলেন বাবার বাড়িতে। লক্ষ করলাম, তাঁর স্বামী তাঁকে নিতে আসেন, কিন্তু তিনি মোটেই যেতে চান না।
অনেকে এসে খালামণিকে বোঝালেন, মেয়েদের তো একটু-আধটু ধৈর্য ধরতেই হয়। এভাবে বলতে বলতে খালামণি একসময় রাজি হয়ে আবার শ্বশুরবাড়ি চলে গেলেন। এবারে তিনি বেশ থিতু হয়ে রইলেন। দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর কেটে গেল। তাঁর ঘরে ফুটফুটে একটা মেয়ে এল। মেয়েটা হওয়ার পর খালামণির ওপর অত্যাচার এবার দৃশ্যমান হয়ে পড়ল। মেয়েটাকে বুকে আঁকড়ে ধরে খালামণি ধৈর্যভরে স্বামীর ঘরে টিকে থাকার চেষ্টা করলেন। কিন্তু না, ধৈর্যের সুতাটা ছিঁড়েই গেল একটা সময়। খালামণি শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এলেন। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন, নিজের জীবনের ভার নিজেই নেবেন। সেভাবেই চলতে লাগল।
ইতিমধ্যে পদ্মা নদী দিয়ে অনেক পানি বয়ে গেছে। একদিন আমি খালামণির সঙ্গে বসে আছি। কোত্থেকে এক ভদ্রলোক এলেন। দেখি, খালামণি আর সেই ভদ্রলোক দুজন দুজনের দিকে শুধু তাকিয়ে আছেন। তাঁদের মুখের ভাষা যেন হারিয়ে গেছে। একেবারে নীরবে অনেকটা সময় কেটে গেল। তারপর লোকটা চলে গেলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ও খালামণি, উনি কে?’ খালামণি কিচ্ছু বলবেন না। দেখলাম, খালামণির চোখের কোণে এক ফোঁটা পানি স্থির হয়ে আছে।
কিছুদিন পর এক বিকেলে আমরা সবাই একসঙ্গে বসে গল্প করছি। হঠাৎ দেখি সেই ভদ্রলোক কোথা থেকে এসে হাজির। এসে নাটকীয়ভাবে নানার হাত দুটো তিনি চেপে ধরলেন। বললেন, ‘আমার ওপর তো আস্থা রাখতে পারেননি। কার হাতে ওকে তুলে দিলেন! ওর জীবনটা দুঃখে ভরে গেল। আমাকে প্রথম আর শেষবারের মতো একবার বিশ্বাস করুন। আপনার মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিন।’
এবার বুঝতে পারলাম, আমি যা আন্দাজ করেছিলাম, তা-ই। ইনিই খালামণির সেই প্রেমিক। এতগুলো বছর বিয়ে না করেই তিনি একাকী জীবন কাটিয়ে দিয়েছিলেন।
তাঁর প্রস্তাবে সবাই হতবিহ্বল হয়ে চুপ করে রইলেন। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো, খালামণির বিয়ে হবে তাঁর তরুণ বয়সের পছন্দের সেই ছেলের সঙ্গেই।
এর পরের সবটাই রূপকথার উপসংহারের মতো। একটি ছেলে আর একটি মেয়েশিশু নিয়ে কী দারুণ এখন তাঁদের আনন্দের সংসার।
ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়