এবার বিলবোর্ড বসবে, মেলাও হবে 

পুরোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নতুন চুক্তি। বাড়তি সময় পেল ১০ বছর।

বিপ্লব উদ্যানে আগে থেকেই আছে দোকান। এখন আরও নতুন স্থাপনা করার অনুমতি পেল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। গত মঙ্গলবার দুপুরে
জুয়েল শীল

চট্টগ্রাম নগরের দুই নম্বর গেটের বিপ্লব উদ্যানে ‘সবুজ ধ্বংসের’ আরও সুযোগ করে দিচ্ছে সিটি করপোরেশন।  এ জন্য আগে দোকান তৈরি করা দুই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটির সঙ্গে নতুন চুক্তি করেছে সিটি করপোরেশন। চুক্তি অনুযায়ী, উদ্যানে স্থাপন করা যাবে বিলবোর্ড। আয়োজন করা যাবে মেলা বা উৎসব। এসব করার জন্য ভেঙে ফেলা হবে বিদ্যমান গ্লাস টাওয়ার ও পানির ফোয়ারা। 

রিফর্ম কনসোর্টিয়াম নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এসব কাজ করার অনুমতি দিয়ে আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে চুক্তি করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। এই চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিকে কার্যত উদ্যানে আরও বেশি ব্যবসা করার সুযোগ করে দিল সিটি করপোরেশন।  

জনমতকে উপেক্ষা করে এখন আবার স্থাপনা করার জন্য নতুন করে চুক্তি করেছে সিটি করপোরেশন। উদ্যানকে উদ্যানের মতো রাখতে হবে। সেখানে কেন বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলবে? সিটি করপোরেশনের অবশ্যই এই চুক্তি বাতিল করা উচিত।
মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান, সভাপতি, চট্টগ্রাম চ্যাপ্টার, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স 

এর আগে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর ২০ বছর মেয়াদি চুক্তি হয়েছিল রিফর্ম ও স্টাইল লিভিং আর্কিটেক্টস লিমিটেড নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। পাঁচ বছরের মধ্যে পুরোনো চুক্তি সংশোধন করে নতুনভাবে করা হয়। আগের চুক্তি ২০৩৮ সালে মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন তা হবে ২০৪৮ সালে; অর্থাৎ সংশোধনের সুযোগে ১০ বছর বাড়তি সময় পাচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি। অবশ্য এবারের চুক্তি থেকে সরে দাঁড়িয়েছে স্টাইল লিভিং আর্কিটেক্টস লিমিটেড। শুধু রিফর্ম কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে চুক্তি হয়। 

চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রিফর্ম কনসোর্টিয়ামকে স্থাপনা ও সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাঁদের মনে হয়েছে, উদ্যানের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য এগুলোর দরকার আছে। এতে উদ্যানের পরিবেশ নষ্ট হবে না। 

ইমারত বিধিমালা অনুযায়ী, উদ্যানে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশের বেশি কংক্রিট অবকাঠামো থাকতে পারবে না। আর আন্তর্জাতিকভাবে ২ শতাংশও অনুমোদন করে না। কিন্তু চট্টগ্রাম নগরের ২ নম্বর গেটের বিপ্লব উদ্যানের কংক্রিট অবকাঠামোর পরিমাণ অন্তত ৫৫ শতাংশ। 

১৯৭৯ সালে চট্টগ্রাম শহরের গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম ২ নম্বর গেট গাছগাছালিতে ভরা ২ একরের এই উদ্যান গড়ে তোলা হয়। 

ভেঙে ফেলা দোতলা আবার হবে 

২০১৮ সালে সৌন্দর্যবর্ধনের দায়িত্ব পাওয়া দুটি প্রতিষ্ঠান উদ্যানের পূর্ব পাশে দোতলা ভবন নির্মাণ করেছিল। নিচতলায় খাবার দোকান করা হয়। ওপরেও একই ধরনের দোকান করার কথা ছিল। 

কিন্তু চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করার কারণে ২০২০ সালের অক্টোবরে দোতলার স্থাপনা ভেঙে দিয়েছিলেন সিটি করপোরেশনের তৎকালীন প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম। ওই সময় উদ্যানে স্থাপন করা বসার আসনের একটি সারিও অপসারণ করা হয়েছিল। 

নতুন চুক্তিতে ভেঙে দেওয়া দোতলায় আবার স্থাপনা নির্মাণ করা হবে। দোতলায় চট্টগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংবলিত জাদুঘরসহ প্রদর্শনী কেন্দ্র থাকবে। 

সেখানে কফি শপ করতে পারবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি। আর এই কেন্দ্র হবে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে আর্থিক সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতায়। দ্বিতীয় তলার ছাদে করা যাবে কিডস বা গেমিং জোন। 

শুধু তা-ই নয়, খোরশেদ আলমের সময় বসার একটি সারি অপসারণ করা হয়েছিল। উন্মুক্ত স্থানটিতে এখন ২০০ ফুট দীর্ঘ ও ৫০ ফুট প্রস্থের কাঠামো নির্মাণ করা হবে। এটি স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি হবে। এই স্থাপনা নির্মাণের সুযোগে কাঠামোর ওপর, নিচ ও দুই পাশে পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠানের লোগো প্রদর্শন করতে পারবে। 

ভাঙা হবে টাওয়ার আর ফোয়ারা 

উদ্যানে নতুন করে স্থাপনা নির্মাণের জন্য বিদ্যমান ফোয়ারা ও গ্লাস টাওয়ার ভাঙা হবে বলে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এই চত্বরে অনুষ্ঠান করার জন্য অস্থায়ী উন্মুক্ত মঞ্চের ব্যবস্থা করবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি। 

শুধু তা-ই নয়, নতুন চুক্তি অনুযায়ী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি উদ্যানে বিলবোর্ড, মেগা সাইন, এটিএম বুথ, কিয়স্ক, প্রদর্শনী কেন্দ্র, কিডস এক্সপেরিয়েন্স বা গেমিং জোন ইত্যাদি স্থাপন করতে পারবে। 

এ ছাড়া উদ্যানে দুটি স্টিলের কাঠামোর ভেতরে গেমিং জোন থাকবে, যার আয়তন ১ হাজার ৩০০ বর্গফুট করে। চুক্তিতে প্রস্তাবিত এলাকা সবার জন্য উন্মুক্ত রাখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কিডস, গেমিং জোন, স্থায়ী ও অস্থায়ী কিয়স্ক থেকে টাকা আদায় করতে পারবে রিফর্ম। কফি শপও ভাড়া দিতে পারবে। 

সিটি করপোরেশনের অনাপত্তি সাপেক্ষে বিভিন্ন অবকাশ দিবস এবং জাতীয়, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিভিন্ন উৎসবে চত্বর ও হাঁটার জায়গায় কিয়স্ক স্থাপন করে উদ্যোক্তাদের অনুপ্রাণিত করতে পারবে। এতে মেলার আয়োজন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে বলে জানান সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা। 

এদিকে আগের চুক্তিতে সিটি করপোরেশনকে বার্ষিক এক লাখ টাকা রাজস্ব দেওয়া হতো। এখন দিতে হবে বছরে ১০ লাখ টাকা করে।

রিফর্ম কনসোর্টিয়ামের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল হক প্রথমে চুক্তির বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী উদ্যানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চট্টগ্রামের ঐতিহ্য নিয়ে জাদুঘর করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, যাতে শিশুরা উপকৃত হয়। আর চুক্তি করলেও এই মুহূর্তে কার্যকর করার বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই বলে দাবি করেন আশরাফুল হক। 

শহরের অন্যতম উদ্যানটির পরিবেশ রক্ষায় সিটি করপোরেশনকে এই চুক্তি থেকে সরে আসার অনুরোধ জানিয়েছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রাম নগরে এমনিতেই প্রয়োজনের তুলনায় উন্মুক্ত উদ্যান ও পরিসরের স্বল্পতা রয়েছে। সেখানে নাগরিক সমাজের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে বিপ্লব উদ্যানকে বাণিজ্যিকভাবে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তবে সাবেক প্রশাসক যখন কিছু স্থাপনা অপসারণ করেছিলেন, তা তাঁদের আশাবাদী করেছিল। কিন্তু জনমতকে উপেক্ষা করে এখন আবার স্থাপনা করার জন্য নতুন করে চুক্তি করেছে সিটি করপোরেশন। উদ্যানকে উদ্যানের মতো রাখতে হবে। সেখানে কেন বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলবে? সিটি করপোরেশনের অবশ্যই এই চুক্তি বাতিল করা উচিত।