মাদকাসক্তদের কাজ দিই তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে

মাদকাসক্তদের খুঁজে খুঁজে কাজ দেন এবং তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সহায়তা করেন পাওয়ার প্রোপার্টি কেয়ার সার্ভিস নামের একটি পরিচ্ছন্নতা প্রতিষ্ঠানের মালিক মোস্তফা রনি। তিনি নিজে একসময় ছিলেন কারওয়ান বাজারের আড়তকর্মী। নিজের প্রতিষ্ঠানে এখন পর্যন্ত ১৫০ জন মাদকাসক্তকে কাজ দিয়েছেন। মোস্তফা রনির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল হোসাইন

মোস্তফা রনি

প্রশ্ন :

মাদকাসক্তদের কাজ দেওয়ার বিষয়টি কেন মাথায় এল?

মোস্তফা রনি: কারওয়ান বাজারে কাজ করার সময় দেখতাম মাদকাসক্তরা ঘুরে বেড়ায়। ফুটপাতে পড়ে থাকে। মানুষের জীবনের এমন অবস্থা দেখে কষ্ট হতো। তখনই মনে হতো, তাদের জন্য কিছু করি।

প্রশ্ন :

আপনি কারওয়ান বাজারে কিসের আড়তে কাজ করতেন?

মোস্তফা রনি: ডাবের আড়তে। যখন বয়স ১২-১৩ বছর, তখন থেকে কাজ শুরু করি।

প্রশ্ন :

এত কম বয়সে কাজে যোগ দিতে হলো কেন?

মোস্তফা রনি: আমার ছোটবেলায় বাবা মারা যান। তখন মা আমি ও আমার দুই বোনকে নিয়ে সংকটে পড়ে যান। সংসার চালাতেই কাজ শুরু করতে হয়।

প্রশ্ন :

ডাবের আড়তে কত টাকা পেতেন?

মোস্তফা রনি: মাসে আট হাজার টাকার মতো। সারা রাত ট্রাক থেকে ডাব নামাতে হতো। কাজে অনেক কষ্ট ছিল।

প্রশ্ন :

বিদেশ গেলেন কীভাবে?

মোস্তফা রনি: মা তাঁর বাবার বাড়ি থেকে কিছু টাকা এনে আমাকে সৌদি আরবে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। সেখানে দুই বছর ছিলাম। এরপর দেশে আসি। পরে আবার দুবাই যাই।

প্রশ্ন :

বিদেশে কী করতেন?

মোস্তফা রনি: পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করতাম।

প্রশ্ন :

ফিরলেন কেন?

মোস্তফা রনি: দুবাইয়ে পরিচ্ছন্নতার সব সরঞ্জাম চালানো শিখেছিলাম। নিজে কিছু সরঞ্জাম কিনেছিলাম। কিন্তু ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় সবকিছু রেখে ফিরে আসতে হয়।

প্রশ্ন :

দেশে কোম্পানি খোলার টাকা কি দুবাই থেকে নিয়ে এসেছিলেন?

মোস্তফা রনি: না। আমি অনেকটা খালি হাতে ফিরি।

প্রশ্ন :

তারপর?

মোস্তফা রনি: তখন ২০০৯ সাল। আমার ঘটনাটি কোনোভাবে আমাদের আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান খানের (বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) কানে যায়। তিনি দুস্থদের ভ্যানগাড়ি দিয়ে সহায়তা করতেন। আমাকেও একটা ভ্যানগাড়ি দেন। ওনার স্ত্রী আমাকে ১৬ হাজার টাকা দিয়েছিলেন।

প্রশ্ন :

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি আপনার পূর্বপরিচিত ছিলেন?

মোস্তফা রনি: আমার মাকে তিনি চিনতেন।

প্রশ্ন :

ভ্যানগাড়ি ও টাকা পেয়ে কী করলেন?

মোস্তফা রনি: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর স্ত্রীর দেওয়া টাকা দিয়ে পুরোনো একটি পরিচ্ছন্নতার যন্ত্র কিনি। ভ্যানগাড়ি ও সেই যন্ত্র নিয়ে গুলশান-বনানীতে ঘুরে ঘুরে বাসাবাড়িতে কাজ শুরু করি। প্রথম কাজের মজুরি ছিল ৬০০ টাকা। টয়লেট (শৌচাগার) পরিষ্কারের কাজ।

প্রশ্ন :

কাজ কি নিয়মিত পেতেন?

মোস্তফা রনি: না। শুরুতে অনেক অপমান-অপদস্থের শিকার হতে হয়েছে। বাসাবাড়িতে কাজের খোঁজে গেলে অনেকে বিরক্ত হয়েছে। দারোয়ানরা গালিগালাজও করেছে। আমি ভেবেছি, আমার কাজ পেতেই হবে, অন্য কিছু মাথায় নিইনি।

প্রশ্ন :

বড় কাজ পেতেন?

মোস্তফা রনি: চট্টগ্রামের আজিজ গ্রুপের একটি কাজ পাই ২০১০ সালের দিকে। চট্টগ্রামে আগ্রাবাদে ৩২ তলা ভবনের বাইরের কাচ ও ভেতরে পরিষ্কার করতে হবে। এক মাসের কাজটিতে তারা ১০ লাখ টাকা দিয়েছিল। ওই গ্রুপের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে কিছু সরঞ্জাম কিনেছিলাম।

প্রশ্ন :

এখন আপনার কোম্পানি কী কী কাজ করে?

মোস্তফা রনি: আমরা কার্পেট, সোফা, বাসা পরিষ্কার করি। কীটপতঙ্গ দমন করি। উঁচু ভবন পরিষ্কার করি। ভবনমালিকদের সঙ্গে চুক্তি থাকে। কোনো কোনো ভবন বছরে দুবার পরিষ্কার করতে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা নিই। আমার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দেড় শ ভবনের চুক্তি আছে।

প্রশ্ন :

এখন তো আপনি সচ্ছল ব্যক্তি। পরিচ্ছন্নতার কাজ নিয়ে মনোভাব কী?

মোস্তফা রনি: গর্ববোধ করি। এটা আমার রুটি-রুজি।

প্রশ্ন :

মাদকাসক্তদের কীভাবে রাজি করান?

মোস্তফা রনি: আমি তাদের সঙ্গে মিশতাম। ভালো খাবার রান্না করে তাদের দাওয়াত দিতাম। ভালো সম্পর্ক হওয়ার পর চাকরির কথা বলতাম। এখন দরিদ্র পরিবারগুলোই তাদের মাদকাসক্ত সদস্যদের আমার কাছে নিয়ে আসে।

প্রশ্ন :

সবাই কি মাদক ছেড়ে দেয়?

মোস্তফা রনি: কাউকে কাউকে দেখি কাজ শেষে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে গিয়ে আবার মাদক গ্রহণ শুরু করে। তখন কারও কারও পরিবারের সঙ্গে কথা বলে বিয়ের ব্যবস্থা করেছি। খরচ নিজে দিয়েছি। সংসার হওয়ার পর কেউ কেউ আর মাদকের পথে যায়নি।

প্রশ্ন :

মাদকাসক্তরা কাজে ফাঁকি দেয় না?

মোস্তফা রনি: চুক্তিতে কাজ হয়। কারও ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই।

প্রশ্ন :

এই যে আপনি মাদকাসক্তদের চাকরি দেন, এটা কেন?

মোস্তফা রনি: মনের শান্তির জন্য। আবার তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর চেষ্টা থাকে। যখনই ছোট্ট একটা ভালো কাজ করি, তখনই আমার জীবনের সফলতা চলে আসে।