১৯ মাস বন্ধ থাকার পর মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির আবেদন নেওয়া শুরু হয়েছে। ১২ জানুয়ারি থেকে সারা দেশে নতুন ভাতাভোগী নিতে অনলাইনে আবেদন নেওয়া শুরু হয়েছে। এ–সংক্রান্ত পরিপত্র জারি হয়েছে ১১ জানুয়ারি।
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের এই কর্মসূচির আওতায় দরিদ্র অন্তঃসত্ত্বা মায়েরা গর্ভধারণ থেকে সন্তান জন্মদানের পর তিন বছর পর্যন্ত মাসে ৮০০ টাকা ভাতা পান। নতুন তালিকায় প্রথমবারের মতো সিটি করপোরেশনের সব কটি ওয়ার্ডে নির্দিষ্টসংখ্যক দরিদ্র নারী তালিকাভুক্ত হবেন।
এর আগে এই কর্মসূচিতে দীর্ঘদিন ধরে নতুন তালিকাভুক্তি বন্ধ থাকা নিয়ে গত ২৫ অক্টোবর প্রথম আলোতে ‘মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি: নতুন তালিকা বন্ধ ১৬ মাস’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। বড় পরিসরে অনলাইন নিবন্ধনের মাধ্যমে কর্মসূচি শুরু করতে গিয়ে ঢিলেঢালা কাজের কারণে দীর্ঘ সময় ধরে তালিকা তৈরির কাজ বন্ধ থাকে।
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের কর্মসূচি পরিচালক (মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি) রুবিনা গনি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সারা দেশে এখন অনলাইনে নিবন্ধনের মাধ্যমে কর্মসূচির আওতায় আবেদন করতে পারছেন ভাতা নিতে ইচ্ছুক দরিদ্র অন্তঃসত্ত্বা মায়েরা। সেসব আবেদন যাচাই–বাছাইয়ের মাধ্যমে চূড়ান্ত ভাতাভোগী নির্বাচন করা হবে। একজন মা ৩৬ মাস পর্যন্ত প্রতি মাসে ৮০০ টাকা ভাতা পাবেন। অনলাইনে নিবন্ধন হওয়ায় ভাতাপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও নির্ভুল হবে।
মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির উদ্দেশ্য হচ্ছে, মাতৃগর্ভ থেকে শিশুর জীবনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ এক হাজার দিন (৩ বছর) গর্ভবতী মা ও শিশুর স্বাস্থ্য উন্নয়ন এবং বয়সের তুলনায় কম উচ্চতার ও কম ওজনের শিশুর সংখ্যা কমিয়ে আনা। দেশে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতায় শিশুপুষ্টির এটিই সবচেয়ে বড় কর্মসূচি।
গ্রামীণ এলাকায় ২০০৭-০৮ অর্থবছরে চালু ‘মাতৃত্বকালীন ভাতা’ এবং শহর এলাকায় ২০১০-১১ অর্থবছরে চালু ‘কর্মজীবী মায়েদের জন্য ল্যাকটেটিং ভাতা’ কর্মসূচিকে মিলিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে নতুন করে ‘মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি’ চালু করা হয়। এ অর্থবছর (২০২২-২৩) থেকে দুই লাখ ভাতাভোগী বাড়িয়ে মোট ১২ লাখ ৫৪ হাজার মাকে ভাতা দেওয়ার ঘোষণা রয়েছে। যে নতুন দুই লাখ ভাতাভোগী বাড়ানোর ঘোষণা রয়েছে, তার মধ্যে এ অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ভাতাভোগীদের একটি অংশকে নির্বাচন করে একবারে ছয় মাসের বকেয়া ভাতা দেওয়া হবে। আর জানুয়ারি মাস থেকে যাঁরা তালিকাভুক্ত হচ্ছেন, তাঁরা ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ভাতা পাওয়া শুরু করবেন। অন্তঃসত্ত্বা মা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার ও তথ্য আপার মাধ্যমে ইউনিয়নে পরিষদে গিয়ে বা বাড়িতে বসে নিজে আবেদন করতে পারবেন।
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার ২ নম্বর বাকিলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজ মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা ফোনে কর্মসূচি আবার শুরুর বিষয়ে জানান। কাল (মঙ্গলবার) তাঁর সঙ্গে এ নিয়ে বৈঠক আছে। তখন বিস্তারিত জানতে পারব’। তিনি বলেন, মা ও শিশু সহায়তা কার্ডের প্রচুর চাহিদা রয়েছে তাঁর এলাকায়। যখন বন্ধ ছিল, তখন প্রায়ই নারীরা এসে জানতে চাইতেন, কবে চালু হবে।
ঢাকার কেরানীগঞ্জের তারানগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গত রোববার (১৫ জানুয়ারি) তিনি মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি চালুর বিষয়ে পরিপত্র পেয়েছেন। তাঁকে এখন ১১৮টি আবেদন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর প্রতি মাসে তাঁর ইউনিয়ন থেকে ১০ জন নতুন অন্তঃসত্ত্বা মা তালিকাভুক্ত হতে পারবেন।
সারা দেশে আবেদন শুরুর আগে ডিসেম্বর মাসজুড়ে সাত উপজেলায় ভাতাভোগীদের পরীক্ষামূলকভাবে ডেটা এন্ট্রির কাজ করা হয়েছে। উপজেলাগুলো হচ্ছে—বান্দরবানের থানচি, সিলেটের গোয়াইনঘাট, বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, রংপুরের গঙ্গাচড়া এবং বাগেরহাটের চিতলমারী। এসব উপজেলায় পরীক্ষামূলকভাবে কাজ চলেছে।
এবারই প্রথম সিটি করপোরেশন এলাকার সব ওয়ার্ডে এই কর্মসূচি চালু হলো। ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রতি ওয়ার্ডের জন্য মাসে পাঁচটি করে কার্ড বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৭৫টি এবং উত্তর সিটি করপোরেশনে ৫৪টি ওয়ার্ড রয়েছে। এর আগে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কল্যাণপুর এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে এই কর্মসূচি চালু হয়েছিল।
এবার দক্ষিণ সিটির ৭৫টি ওয়ার্ডে এক বছরে সাড়ে ৪ হাজার জন এবং উত্তরের ৫৪টি ওয়ার্ডে ১ বছরে ৩ হাজার ২৪০ জন এ সুবিধা পাবেন।
সাতক্ষীরার তালা উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা নাজমুন নাহারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, তাঁর উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন থেকে ১২ থেকে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে অনলাইনে আবেদন নেওয়া শেষ হয়েছে। এখন এ–সংক্রান্ত ইউনিয়ন পরিষদ কমিটির মাধ্যমে আবেদনগুলো যাচাই–বাছাই করা হবে। এ অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ভাতা দেওয়ার জন্য ৬০৬ জনকে তালিকাভুক্ত করবেন। তবে আবেদন জমা পড়েছে এক হাজারের ওপর। আর জানুয়ারি থেকে প্রতি মাসে প্রতি ইউনিয়ন থেকে ৬ থেকে ৯ জন নতুন ভাতাভোগী তালিকাভুক্ত হবেন।
মহিলা অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, ‘খানা আয়–ব্যয় জরিপ ২০১০’ এবং ‘বাংলাদেশ ইন্টিগ্রেটেড হাউসহোল্ড সার্ভে (বিআইএইচএস) ২০১৫’—এই দুটো জরিপের ওপর ভিত্তি করে মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির ভাতাভোগীদের আর্থসামাজিক সূচক ঠিক করা হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির ‘উপজেলা দারিদ্র্য মানচিত্র ২০১৬’ এবং বিবিএস ও ইউনিসেফের ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯’ (মিকস) অনুযায়ী দারিদ্র্য এবং অপুষ্টি বিবেচনায় বিভিন্ন এলাকায় ভাতাভোগী ঠিক করা হয়েছে। আবেদন করার সময় নির্দিষ্টসংখ্যক প্রশ্নের উত্তরের মাধ্যমে ভাতাভোগী দরিদ্র কি না, তাঁর প্রথম বা দ্বিতীয় গর্ভধারণ কি না (যেকোনো একবার) (সন্তান জীবিত থাকলে তৃতীয় গর্ভধারণ হলে তালিকা থেকে বাদ পড়বেন) এবং গর্ভাবস্থায় সেবা নেওয়ার (এএনসি) কার্ড অনুযায়ী কত মাসের অন্তঃসত্ত্বা, সেসব দেখা হবে। এরপর সরকারি প্রতিনিধি ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত স্থানীয় কমিটি সেসব তথ্যের সত্যতা যাচাই করে বরাদ্দ অনুযায়ী চূড়ান্ত তালিকা করবেন। এখন থেকে প্রতি মাসের ১ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত আবেদন নেওয়া হবে। ২০ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত ইউনিয়ন কমিটির মাধ্যমে আবেদন যাচাই করা হবে। ২৫ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত ভাতাভোগীদের তালিকা চূড়ান্ত করবেন মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা।