আমরা এক ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে আছি: প্রধান বিচারপতি
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, ‘বিগত বছরগুলোতে বিচারপ্রক্রিয়ায় আমাদের বিচারবোধ এবং ন্যায়বিচারের মূল্যবোধকে বিনষ্ট এবং বিকৃত করা হয়েছে। সততার বদলে শঠতা, অধিকারের বদলে বঞ্চনা, বিচারের বদলে নিপীড়ন, আশ্রয়ের বদলে নির্যাতনকে স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত করা হয়েছে। অথচ এ রকম সমাজ–রাষ্ট্র আমরা চাই না।’
আজ রোববার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘সুশাসনের জন্য জনসম্পৃক্ত সংস্কার, সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষা’ শীর্ষক নাগরিক সম্মেলনে প্রধান বিচারপতি এ কথা বলেন। ইউএনডিপি এবং সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশনের সহযোগিতায় এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ।
দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমরা এক ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে আছি।...এই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে আমাদের নতুন করে যাত্রা শুরু করতে হবে। আমি ওপরে যেমন মূল্যবোধের বিনাশ, বিকৃতি ও দূষণের কথা উল্লেখ করেছি, সেগুলো আমাদের আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ অনেক বড়। আজ থেকে প্রতিটি শ্রেয়, শুভ ও কল্যাণকর কর্মে সকলেই গণমুখী, জনগণকেন্দ্রিক বিচার বিভাগকে আপনাদের পাশে পাবেন। আমরা সকলেই অবগত আছি, দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে ভগ্নদশা থেকে বিচার বিভাগও মুক্ত নয়। তবে এ পর্যায়ে আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাইছি, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণকল্পে বিচার বিভাগ প্রাতিষ্ঠানিক, কিছু প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়ে ইতিমধ্যে এক নতুন যাত্রা শুরু করেছে।’
আওয়ামী লীগের শাসনামলে আনুগত্য ছাড়া মেধার মূল্যায়ন হয়নি উল্লেখ করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো, এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘একটি শব্দ ব্যবহার করি, ক্লিপ্টোক্রেসি। অর্থাৎ কীভাবে চামচা পুঁজিবাদ চোরতন্ত্রে পৌঁছেছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা সেই সময়কালে আমাদের করেছে, সেটা হলো আনুগত্য ছাড়া মেধা এবং প্রতিভার স্বীকৃতি ছিল না। একমাত্র চাটুকার এবং অনুগত ব্যক্তিরা রাষ্ট্র, সরকার, সমাজের বিভিন্ন পদ, পেশাজীবীদের সংস্থা দখল করে রাখত। মেধা ও তাদের বিদ্যার কোনো স্বীকৃতি ছিল না। একটি জাতিকে পেছনে আটকে রাখার মতো, এর চেয়ে বড় অপরাধ আর হতে পারে না।’
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট মেধা এবং বিদ্যা অস্বীকৃতির জায়গা হয়ে উঠেছিল উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে বিগত সময়কালে সবচেয়ে মেধাবী একজন বিচারপতি যদি কেউ থেকে থাকেন, তিনি হলেন বিচারপতি রেফাত আহমেদ। অথচ পাঁচবার তাঁর পদোন্নতি আটকে দিয়ে জুনিয়রদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। তবে ৫ আগস্টের পর কাকে প্রধান বিচারপতি বানাতে হবে, এ নিয়ে কোনো চিন্তাই করতে হয়নি। প্রধান বিচারপতিকে যোগ্য ব্যক্তি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যদি ইতিহাস কোনো সময় আমাদের শিক্ষা দেয়, সেই শিক্ষাটা হলো বিদ্যা, মেধার ধৈর্য ধরতে হয়। জনগণ একসময় তাঁকে ঠিক বেছে নেবে।’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি-বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) আবাসিক প্রতিনিধি স্টিফেন লিলার এবং বাংলাদেশে সুইজারল্যান্ডের দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স করিন হেনচোজ পিগনানি বক্তব্য দেন।
‘সুশাসনের জন্য জনসম্পৃক্ত সংস্কার, সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষা’ শীর্ষক নাগরিক সম্মেলনের উদ্বোধনী সেশন ছাড়াও তিনটি সেশনে আলোচনা হয়। প্রথম সেশনে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান। দ্বিতীয় সেশনে সভাপতিত্ব করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন। তৃতীয় সেশনে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন।