যে কারণে ‘অসুখী’ গন্ডারটি
দেশে বর্তমানে গন্ডার রয়েছে মাত্র একটি, যার অবস্থান মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানায়। পুরুষ সঙ্গী মারা যাওয়ার পর প্রায় এক দশক ধরে নিঃসঙ্গ রয়েছে মাদি গন্ডারটি। এত দিনেও আরেকটি পুরুষ গন্ডার আমদানি করা যায়নি। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, উপযুক্ত পরিবেশ নেই, তাই আমদানি করা যাচ্ছে না।
২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দুটি গন্ডার আনা হয়েছিল। যার একটি নারী, অন্যটি পুরুষ। তখন তাদের বয়স ছিল সাড়ে তিন বছর। ২০১৩ সালে মারামারি করে পুরুষ গন্ডারটি মারা যায়। চিড়িয়াখানার একজন কর্মকর্তার ভাষ্য, পুরুষ গন্ডারটি আত্মহত্যা করেছিল। শারীরিক সম্পর্ক করার জন্য যে পরিবেশ লাগে, তা চিড়িয়াখানায় ছিল না। পুরুষ গন্ডারটি প্রাচীরের সঙ্গে বারবার মাথা আঘাত করে মারা যায়।
দক্ষিণ আফ্রিকার মেনেস নামে এক ব্যক্তির ফার্ম থেকে আনা হয়েছিল গন্ডার দুটি। পুরুষ গন্ডারটি মারা গেলে মাদিটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার চিকিৎসার জন্য মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। কিন্তু চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছিল না প্রাণীটি। এরপর গন্ডারের মালিক মেনেসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকায় আসেন। মেনেস পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান, গন্ডারটি একাকিত্বে ভুগছে। তাঁর পরামর্শে সঙ্গী হিসেবে গন্ডারকে ভেড়া দেওয়া হয়েছিল। তবে এখন একাই থাকছে গন্ডারটি।
পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে প্রায় এক দশক হলো। এত দিনেও কেন সঙ্গী হিসেবে আরেকটি গন্ডার আনা হয়নি, জানতে চাইলে কর্মকর্তারা বলেন, গন্ডার অতি বিপন্ন প্রাণীগুলোর একটি। এটা সংগ্রহ করা কঠিন ও জটিল।
পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে প্রায় এক দশক হলো। এত দিনেও কেন সঙ্গী হিসেবে আরেকটি গন্ডার আনা হয়নি, জানতে চাইলে কর্মকর্তারা বলেন, গন্ডার অতি বিপন্ন প্রাণীগুলোর একটি। এটা সংগ্রহ করা কঠিন ও জটিল। যারা সরবরাহ করবে, তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে চায় চিড়িয়াখানায় গন্ডার পালনের মতো উপযোগী পরিবেশ আছে কি না। সেই সঙ্গে কোনো কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকেও আমদানির অনুমতি লাগে। এসব কারণে এত দিন গন্ডার সংগ্রহ করা যায়নি।
জাতীয় চিড়িয়াখানায় থাকা গন্ডারের নাম আফ্রিকান গন্ডার। যার বৈজ্ঞানিক নাম Ceratotherium Simum। এই প্রাণী দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, জিম্বাবুয়ে, মোজাম্বিক, জাম্বিয়া, তানজানিয়া, অ্যাঙ্গোলা, বতসোয়ানা, কেনিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে পাওয়া যায়। এদের দেহের রং হলুদ বেগুনি থেকে ধূসর বর্ণের হয়। ওজনে এরা ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ কেজির হয়ে থাকে। শরীরের তুলনায় পা ছোট থাকে। গন্ডার কাদাপানিতে গড়াগড়ি করতে পছন্দ করে। দৃষ্টির চেয়ে ঘ্রাণশক্তি প্রখর। ৩০ মিটার দূরের কোনো কিছু দেখতে পায় না।
সবুজ ঘাস ও শাকসবজি গন্ডারের প্রিয় খাদ্য। স্ত্রী গন্ডার ছয় থেকে সাত বছরে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়। ১৬ থেকে ১৮ মাস গর্ভধারণের পর একটি বাচ্চা দেয়। গন্ডারের গড় আয়ু ৩৫ থেকে ৪০ বছর।
সম্প্রতি এক দুপুরে দেখা যায়, চিড়িয়াখানার ঝিলপাড়ে গন্ডারের বাসস্থান। ধূসর বর্ণের প্রাণীটি সবুজ ঘাস খাচ্ছিল। শরীরের কয়েকটি জায়গায় আঘাতের চিহ্ন। একজন কর্মকর্তা বললেন, গন্ডারের চামড়া সব সময় খসখসে থাকে। কারণ, এরা গায়ে কাদা মাখায়। এতে চামড়া টানে ও চুলকানি হয়। এ চুলকানি সারানোর জন্য ভেতরে থাকা দুটি তালগাছের সঙ্গে গন্ডারটি শরীর অনবরত ঘষে। এতে চামড়া কোথাও কোথাও উঠে যায়। কোথাও চামড়া উঠে গেলে সেখানে অ্যান্টিবায়োটিক স্প্রে করা হয়। পটাশ দেওয়া হয়। তাই গন্ডারটির গায়ে হালকা নীল রঙের দাগ।
মানুষের মতো প্রাণীও সঙ্গী ছাড়া বাঁচতে পারে না। গন্ডারটি শারীরিক সম্পর্ক করতে পারে না, এমনকি স্বজাতি অন্য গন্ডারও দেখে না। এতে সে মানসিকভাবে অস্থির থাকে। এ অবস্থায় তার অসুখ-বিসুখ হওয়ার আশঙ্কা বেশি।অধ্যাপক মোহাম্মদ ফিরোজ জামান,প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ওই দিন কেরানীগঞ্জ থেকে চিড়িয়াখানায় ঘুরতে এসেছিলেন স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মো. ওমর ফারুখ। গন্ডারের আবাসস্থলের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি বলছিলেন, গন্ডারটির আরও যত্ন নেওয়া উচিত। কারণ, এটিই একমাত্র অবশিষ্ট আছে।
গন্ডারের জন্য যতটা জায়গা ও যে ধরনের পরিবেশ দরকার হয়, তা বর্তমানে চিড়িয়াখানায় নেই, স্বীকার করলেন জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার। তাঁর কথা, গন্ডার কেনার জন্য চিড়িয়াখানায় ফাঁকা জায়গা, ঢাল, বিশেষ পানির আধারসহ বেশ কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। চিড়িয়াখানার জন্য যে মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে, সেখানে গন্ডারের যে আবাসস্থল তৈরি করা হবে, তাতে সেসব শর্ত পূরণ হবে। তখন গন্ডার আনা যাবে। সেই মহাপরিকল্পনা অনুমোদন হয়েছে। কিন্তু তা বাস্তবায়নের জন্য যে প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে, তা এখনো পাস হয়নি।
ভিন্নমত দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ ফিরোজ জামান। এই প্রতিবেদককে তিনি বললেন, মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হতে দেরি হলেও চিড়িয়াখানার বার্ষিক বাজেট থাকে। সেটা শুধু খাওয়াদাওয়ার জন্য নয়, ব্যবস্থাপনার জন্যও। সেখান থেকেও অর্থ বরাদ্দ নিয়ে গন্ডারের জন্য প্রয়োজনীয় আবাস তৈরি করা যায়। গন্ডারটির অসুখী হওয়ার কারণ জানালেন তিনি, মানুষের মতো প্রাণীও সঙ্গী ছাড়া বাঁচতে পারে না। গন্ডারটি শারীরিক সম্পর্ক করতে পারে না, এমনকি স্বজাতি অন্য গন্ডারও দেখে না। এতে সে মানসিকভাবে অস্থির থাকে। এ অবস্থায় তার অসুখ-বিসুখ হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
ফিরোজ জামানের মতে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সেই দায়িত্ব পালন না করতে পারলে তাঁদের কাজ ছেড়ে দেওয়া উচিত।