দেশে নির্বাচনী সহিংসতা বেড়েছে

২২ মে দুপুরে নরসিংদীর রায়পুরার পাড়াতলী ইউনিয়নে নির্বাচনী প্রচারণার সময় প্রতিপক্ষের হামলায় ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী সুমন মিয়া আহত হন। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে রায়পুরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেনছবি : সংগৃহীত

দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। এপ্রিল মাসের তুলনায় মে মাসে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। মে মাসের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) ও হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) প্রকাশিত পৃথক দুটি প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে। দুটি সংস্থাই আজ শুক্রবার এসব প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

এমএসএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এপ্রিল মাসের তুলনায় মে মাসে দেশে নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনা ও তাতে হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে। মে মাসে ৯৭টি নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনায় সাতজন নিহত এবং ৫০৮ জন আহত হয়েছেন। আর আগের মাস এপ্রিলে ১৭টি নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনায় পাঁচজন নিহত এবং ৮০ জন আহত হয়েছিলেন।

নির্বাচনী সহিংসতার আরও নাজুক পরিস্থিতি উঠে এসেছে এইচআরএসএসের প্রতিবেদনে। এই সংস্থা বলছে, মে মাসে ১৩৯টি নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনায় ১০ জন নিহত এবং অন্তত ৫৯১ জন আহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের সবাই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চার মাস পর উপজেলা পরিষদ নির্বাচন শুরু হয়েছে মে মাসে। এ অবস্থায় আগের নির্বাচনী সহিংস পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে।

এমএসএফের সভাপতি সুলতানা কামালের সই করা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তেমনি ক্ষমতাসীন দলের অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে সহিংসতা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

সংবাদপত্র, অনলাইন নিউজপোর্টাল এবং স্থানীয় মানবাধিকারকর্মীদের সহযোগিতায় সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে এমএসএফ। আর এইচআরএসএস ১২টি জাতীয় গণমাধ্যম এবং তাদের তথ্য অনুসন্ধানী ইউনিটের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করেছে।

নির্বাচনী সহিংসতা ছাড়াও এইচআরএসএসের প্রতিবেদনে রাজনৈতিক সহিংসতা, সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানি, শ্রমিক নির্যাতন, নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনসহ সহিংসতার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। তবে সংস্থাটির প্রতিবেদনে এপ্রিলের সঙ্গে মে মাসের তুলনামূলক পরিসংখ্যান নেই। এমএসএফের প্রতিবেদনে তা তুলে ধরা হয়েছে।

এমএসএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এপ্রিলের তুলনায় মে মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে। ২৯টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় মে মাসে গ্রেপ্তার কমলেও হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে। এই মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় ছয়জন নিহত এবং ৯৮ জন আহত হয়েছেন। এইচআরএসএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মে মাসে ১৭০টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ১৬ জন নিহত এবং অন্তত ৭৪৮ জন আহত হয়েছেন।

এমএসএফের তথ্যমতে, এপ্রিল মাসে দেশে নারী ও শিশু সহিংসতার ঘটনা ছিল ২৭৮টি। মে মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২৪টিতে। আর এইচআরএসএস বলছে, মে মাসে ১৪০ জন নারী ও কন্যা শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

সাংবাদিকদের প্রতি সহিংসতা এপ্রিলের তুলনায় মে মাসে কিছুটা কমেছে বলে এমএসএফ উল্লেখ করেছে। সংস্থাটি বলছে, মে মাসে ১৭টি ঘটনায় ৩৫ জন সাংবাদিক নির্যাতন, হামলা, আহত, হুমকি ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। আর এইচআরএসএস বলছে, মে মাসে অন্তত ২৬টি হামলার ঘটনায় ৪৮ জন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন।

মে মাসে দেশে ৩৪টি শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনায় ১০ জন নিহত এবং অন্তত ৫৪ জন আহত হয়েছেন বলে এইচআরএসএসের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। অবশ্য শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনা এমএসএফের প্রতিবেদনে আলাদাভাবে উঠে আসেনি। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নানা দিক এমএসএফের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

এমএসএফ বলছে, এপ্রিল ও মে মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গোলাগুলির ঘটনা একই রয়েছে, তবে মৃত্যু বেড়েছে। মে মাসে চারটি গোলাগুলির ঘটনায় ছয়জন মানুষ মারা গেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মে মাসে তিনজন মারা গেছেন, যা এপ্রিলের তুলনায় বেশি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনে মে মাসে পাঁচজন আহত হয়েছেন, এটিও বেশি। এপ্রিলের তুলনায় মে মাসে কারা হেফাজতেও মৃত্যু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ জনে।

সাইবার নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার-অপব্যবহারের ঘটনাও বেড়েছে উল্লেখ করে এমএসএফ বলছে, মে মাসে সাতটি ঘটনায় ছয়টি মামলা, দুজন গ্রেপ্তার এবং ৩৫ জন আসামি হয়েছেন।

সীমান্ত পরিস্থিতিরও অবনতি হয়েছে চলতি মাসে। মে মাসে সীমান্তে চারজন নিহত হয়েছেন।

মে মাসে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাও বেড়েছে। ছয়টি প্রতিমা ভাঙচুর, হামলা ও অগ্নিসংযোগ এবং দুটি ধর্ষণ/ধর্ষণ চেষ্টা/হত্যার ঘটনা ঘটেছে মে মাসে। এই মাসে অবশ্য গণপিটুনি ও অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের ঘটনা কমেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে এমএসএফের প্রতিবেদনে।

এইচআরএসএসের নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম প্রতিবেদনে বলেছেন, বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন করা জরুরি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এসব বিষয় বাস্তবায়ন করতে না পারলে দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাবে।