গণমাধ্যমে সব লিঙ্গ ও বৈচিত্র্যের মানুষ সমানভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। যতটুকু হচ্ছে তার বেশির ভাগই নেতিবাচক খবরের কারণে। গণমাধ্যমে কাজের ক্ষেত্রেও এসব মানুষের উপস্থিতি কম। এর জন্য পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বাধার পাশাপাশি মানসিকতাও দায়ী। সুসাংবাদিকতা করতে হলে সব লিঙ্গ ও বৈচিত্র্যের মানুষকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাঁদের সম হওয়ার সুযোগ তৈরি করতে হবে।
আজ মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) আয়োজিত এক সেমিনারে এসব কথা উঠে আসে। আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ উপলক্ষে ‘সংবাদমাধ্যমে নারী’–বিষয়ক এ সেমিনার হয়। বাংলাদেশে অবস্থিত সুইডেন ও নেদারল্যান্ডস দূতাবাস, ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (এমআরডিআই) এবং ইউল্যাব এ সেমিনারের আয়োজন করে।
সুইডেনের রাষ্ট্রদূত অ্যালেক্স বার্গ ফন লিন্ডে বলেন, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য প্রতিদিনের বাস্তবতা। বিশ্বে প্রতি তিনজন নারীর একজন নারী কোনো না কোনোভাবে সহিংসতার শিকার হন। নারী ও প্রান্তিক মানুষ যদি সমানভাবে উপস্থাপিত না হয়, তাহলে গণমাধ্যমের উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। জেন্ডার অসংবেদনশীল সাংবাদিকতা খুবই নিম্নমানের সাংবাদিকতা। নারীরা গণমাধ্যমে কীভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে, তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। নারীদের কথা উঠে আসতে হবে।
গণমাধ্যম মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করছে। নতুন প্রজন্ম এখন গণমাধ্যমের কাছ থেকে আরও বেশি শিখছে। এখানে নির্দিষ্ট কিছু মানুষের কথাই সবাই শুনছে, দেখছে জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বলেন, গণমাধ্যমে সব লিঙ্গের মানুষের উপস্থিতি দরকার। তাঁদের সংখ্যা যত বাড়বে, তত বেশি তাঁদের কণ্ঠ জোরালো হবে। এর জন্য প্রশিক্ষণ, শিক্ষা দরকার।
সাংবাদিক, গবেষক ও প্রশিক্ষক কুররাতুল-আইন-তাহমিনা বলেন, জেন্ডার বলতে শুধু নারী, পুরুষ বা হিজড়াই নয়, সমাজে নানা বৈচিত্র্যের মানুষ আছে, যারা কোণঠাসা। তাদের উপস্থাপন এবং বৈচিত্র্যতার মধ্য দিয়ে একটি ভালো সমাজ গড়ে ওঠে। এই ভালো সমাজ গড়ে তুলতে গণমাধ্যমের দায়িত্ব আছে। এটা সাংবাদিকতার মৌলিক দায়িত্ব। সমাজে যত স্তরের মানুষ আছে, তাদের সবার গণমাধ্যমে একটি ন্যায্য হিস্যার প্রয়োজন। সমাজের সব অংশকে গুরুত্ব দিলে ভালো সাংবাদিকতা হবে এবং সাংবাদিকতাও টিকে থাকবে। সমাজের সব বৈচিত্র্যের মানুষকে সমতা ও সম হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে।
ফোয়ো-এমআরডিআই ৭ থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের ৫টি দৈনিক, ২টি অনলাইন এবং ৩টি টেলিভিশনের প্রায় সাড়ে চার হাজার সংবাদ পর্যালোচনা করে। এ পর্যালোচনা উপস্থাপন করেন এমআরডিআইয়ের কর্মকর্তা সারওয়াত তারান্নুম। তাতে দেখা যায়, নারীদের নামে ছাপা হওয়া প্রতিবেদনের সংখ্যা মাত্র ৮ শতাংশ। এ ছাড়া গণমাধ্যমে নারীর উপস্থিতি ১৪ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। যার বেশির ভাগই উদ্ধৃতি। জেন্ডার বিষয়ে এ সময়ে কোনো সম্পাদকীয় ছিল না। নারী সাংবাদিকের চেয়ে নারী উপস্থাপক বেশি। এ ছাড়া নারীরা উপস্থাপিত হচ্ছে দুর্বল হিসেবে বা নেতিবাচক কোনো ইস্যুতে। এ ছাড়া বিনোদন ও ফিচার অংশে নারী সাংবাদিক ও নারীকেন্দ্রিক খবরের পরিমাণ বেশি। কিন্তু এর ঠিক উল্টো চিত্র দেখা যায় খেলাসহ মূলধারার সংবাদে।
সেমিনারে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, জেন্ডার ইস্যুতে গণমাধ্যমের আচরণ ও ধারণা বদলাতে হবে। তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। নারীর প্রতি আচরণ ও ধারণা বদলানোর জন্য জাতীয়ভাবে কোনো ক্যাম্পেইন দেখা যায় না।
নারী সংবাদকর্মীদের কাজের ক্ষেত্রে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পারিবারিক বাধার কিছু উদাহরণ তুলে ধরেন বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের সদস্য ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল। তিনি বলেন, গণমাধ্যমে লিঙ্গসমতা আনার বিষয়ে প্রতিষ্ঠান একা পারবে না। এর সঙ্গে সমাজ, সংস্কৃতি, মানবাধিকার সংস্থা, নারী অধিকারকর্মীসহ সবাইকে যুক্ত হতে হবে।
অভিজ্ঞ পুরুষ সাংবাদিক দেখা গেলেও অভিজ্ঞ নারী সাংবাদিক কম দেখা যায় জানিয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম বলেন, পুরুষ সাংবাদিকের যখন চুল পেকে যাচ্ছে, বয়স বাড়ছে, তখন তিনি তত অভিজ্ঞ সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন। কিন্তু নারীর যখন চুল পেকে যায়, তখন তিনি সাংবাদিকতায় থাকতে পারেন না। তিনি বলেন, গণমাধ্যমের অভ্যন্তরীণ জেন্ডার সংবেদনশীলতা ও সবাইকে ধারণ করার প্রবণতা না এলে তাদের সংবাদেও তার প্রতিফলন আসবে না।
সাংবাদিকদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষিত করে তোলার ওপর জোর দেন ঢাকা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক রিয়াজ আহমেদ।
ডেইলি স্টারের এডিটরিয়াল টিমের সদস্য সুপ্রভা তাসনীমের সঞ্চালনায় সেমিনারে আলোচনায় অংশ নেন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের নির্বাহী সম্পাদক তালাত মামুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক নীনা গোস্বামী, উইমেন জার্নালিস্ট নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের সমন্বয়ক আঙ্গুর নাহার মন্টি, ডিবিসি চ্যানেলের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ইশরাত জাহান। সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সের হেইজ উডস্ট্রা, ইউল্যাবের মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের ডিন জুড উইলিয়াম হেনিলো, এমআরডিআই নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমানসহ প্রমুখ।