মাটির চুলার ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণে কম ওজনের শিশু জন্মের ঝুঁকি কমে ৩৭%
গ্রামাঞ্চলে খোলা জায়গায় বা রান্নাঘরে মাটির চুলায় রান্নার চল বহু পুরোনো। অন্তঃসত্ত্বা নারীরাও রান্নার কাজে এসব চুলাই ব্যবহার করেন। তবে মাটির চুলায় ব্যবহৃত জ্বালানি কাঠ, খড়ি, তুষ, গোবর, পাতা ইত্যাদির আগুনে সৃষ্ট ধোঁয়ায় অন্তঃসত্ত্বার পাশাপাশি ক্ষতি হয় তাঁর গর্ভের সন্তানেরও। ধোঁয়ার ক্ষতিকর প্রভাবে জন্ম নিতে পারে কম ওজনের শিশু।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ-আইসিডিডিআরবির এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে।
গবেষণায় দেখানো হয়েছে, মাটির চুলার পরিবর্তে কংক্রিটের চুলা ব্যবহার করে ক্ষতিকর ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এতে কম ওজনের শিশু জন্মের ঝুঁকি ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব। এ গবেষণায় কংক্রিটের তৈরি উন্নতমানের চুলাসহ মডেল রান্নাঘর নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে গত ৩ জানুয়ারি মেডিকেল সাময়িকী দ্য ল্যানসেট রিজিওনাল হেলথ-সাউথইস্ট এশিয়ায়। এটির শিরোনাম-‘ইফেক্ট অব লো-কস্ট কিচেন উইথ ইমপ্রুভড কুকস্টোভ অন বার্থওয়েট অব নিওন্যাটস ইন শাহজাদপুর, বাংলাদেশ: এ ক্লাস্টার-র্যানডোমাইজড কন্ট্রোল্ড ট্রায়াল’(জন্মের সময় শিশুর ওজনের ওপর কম খরচের উন্নত নকশার রান্নাঘরসহ চুলার প্রভাব)।
২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার ১ হাজার ২৬৭ অন্তঃসত্ত্বা নারীর ওপর গবেষণাটি করা হয়েছে। ওই নারীদের ১২ সপ্তাহের বা তিন মাসের কম সময়ের গর্ভাবস্থা ছিল এবং তাঁরা মাটির চুলায় রান্না করতেন। তাঁদের মধ্যে ৬২৮ জনের বাড়িতে মডেল রান্নাঘর স্থাপন করা হয়। অন্য ৬৩৯ জন প্রচলিত মাটির চুলাতেই রান্না চালিয়ে যান। গর্ভাবস্থায় নারীদের রক্তে কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণ এবং প্রসবের পর ৭২ ঘণ্টার মধ্যে নবজাতকদের ওজন মাপা হয়।
আইসিডিডিআরবির করা গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির মা ও শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের প্রকল্প সমন্বয়কারী আনিসউদ্দিন আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুটি দলের মায়েদের শিক্ষা, আর্থিক, সামাজিক অবস্থাসহ ঝুঁকির অনুপাত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রচলিত চুলা ব্যবহার করা অন্তঃসত্ত্বা নারীদের তুলনায় মডেল রান্নাঘর ব্যবহার করা নারীদের কম ওজনের শিশু জন্মদানের ঝুঁকি কমেছিল ৩৭ শতাংশ।
ধোঁয়ার ক্ষতিকর প্রভাব
২০১৯ সালে ল্যানসেটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর ২ কোটি ৫ লাখ শিশু জন্মায় কম ওজন নিয়ে। গর্ভের শিশুর ৩৮ থেকে ৪২ সপ্তাহের মধ্যে জন্ম নেওয়াকে স্বাভাবিক ধরা হয়। এই সময়ে ২ হাজার ৫০০ গ্রামের নিচে জন্ম নেওয়া শিশুদের কম ওজনের বলা হয়। বৈশ্বিকভাবে প্রায় ১৬ শতাংশ নবজাতক মৃত্যুর কারণ কম ওজন নিয়ে জন্ম নেওয়া।
আর ২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে কম ওজনের শিশু জন্মের হার ২৩ শতাংশ।
গবেষক আনিসউদ্দিন আহমেদ জানান, আইসিডিডিআরবির অপর একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, গ্রামাঞ্চলে খোলা জায়গায় ৩৫ শতাংশ নারী রান্না করেন। গ্রামীণ শক্তির বন্ধু চুলার মডেলটি অনুসরণ করে ‘১০০ ডলারের’(গবেষণার সময়ে ৮ হাজার টাকা) একটি মডেল রান্নাঘরের নকশা করা হয়। কারণ, খোলা জায়গায় শুধু চুলা স্থাপনের মাধ্যমে ধোঁয়ার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের রক্ষা করা সম্ভব নয়। এর জন্য যথাযথ নকশার রান্নাঘরও প্রয়োজন।
আনিসউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রচলিত মাটির চুলায় রান্নার জন্য কাঠ, পাটখড়ি, তুষ, গোবর, শুকনা পাতা ইত্যাদি জ্বালানি ব্যবহার করা হয়। এই ধরনের জ্বালানির ধোঁয়ায় বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের পাশাপাশি বায়ুতে আরও অনেক ধরনের দূষিত কণার সৃষ্টি হয়।
এই গবেষক আরও বলেন, একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীকে তাঁর নিজের জন্য ও গর্ভের সন্তানের জন্য শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন গ্রহণ করতে হয়। এ জন্য ওই নারী গভীরভাবে শ্বাস নেন।
প্রচলিত মাটির চুলায় রান্না করা অবস্থায় সেই জ্বালানি থেকে উৎপন্ন কার্বন মনোক্সাইডও নিশ্বাসের সঙ্গে অন্তঃসত্ত্বা নারীর শরীরে প্রবেশ করে। ফলে মায়ের রক্তে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয় এবং গর্ভের সন্তানও অক্সিজেন কম পায়। এর ফলে জন্ম হতে পারে কম ওজনের শিশুর। জন্মের সময় শিশুর ওজন কমে যাওয়ার পেছনে এটি একটি বড় কারণ।
দূষণমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে
আইসিডিডিআরবির গবেষণায় দেখানো হয়েছে, কংক্রিটের উন্নত চুলাসহ ৩৬ বর্গফুটের মডেল রান্নাঘরে তিনটি জানালা ও একটি দরজা থাকে, মেঝে পাকা। ছাদ ও দেয়াল বাঁশ, খড় ও চাটাইয়ের। এই চুলার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, চুলার ভেতরে মাঝখানে জ্বালানিসামগ্রী রাখার একটি ঝাঁজরি থাকে। চুলার পেছনে একটি ফুটো থাকে, যার মধ্য দিয়ে বাতাস চলাচল করতে পারে এবং জ্বালানি উপকরণগুলো পরিপূর্ণ আগুন পেয়ে পুরোপুরি পুড়ে যায়। চুলায় একটি চিমনি রয়েছে, যাতে ধোঁয়া রান্নাঘরের ভেতর আটকে না থেকে চিমনি দিয়ে বাইরে চলে যায়। এতে নিশ্বাসের সঙ্গে দূষিত বায়ু অন্তঃসত্ত্বা নারীর দেহের ভেতরে যাওয়ার আশঙ্কা কমে।
গবেষণার তথ্য বলছে, অন্তঃসত্ত্বা নারীদের যে দলটি মডেল রান্নাঘর ব্যবহার করেছিলেন, তাঁদের গর্ভকালীন ৬ মাস ও ৯ মাসের সময়ে একটি ইলেট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখা যায়, রক্তে কার্বন মনোক্সাইডের মাত্রা দেড় শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৯ শতাংশে। অপর দিকে প্রচলিত মাটির চুলা ব্যবহার অব্যাহত রাখা অন্তঃসত্ত্বা নারীদের রক্তে এই মাত্রা ছিল অপরিবর্তিত, প্রায় সাড়ে ১১ শতাংশ।
শিশু জন্ম নেওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ওজন নিয়ে দেখা গেছে, ওই নারীদের কম ওজনের শিশু জন্ম নেওয়ার হার ছিল প্রায় ৩৬ শতাংশ এবং মডেল রান্নাঘর ব্যবহার করা নারীদের মধ্যে এ হার ২৩।
বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্যজরিপ ২০২২-এর তথ্য অনুসারে, দেশে ১ হাজার জীবিত শিশু জন্মের মধ্যে ২০ জন নবজাতক (জন্ম থেকে ২৮ দিন বয়সী) মারা যায়। ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে খর্বকায়, ক্ষীণকায় ও কম ওজনের হার যথাক্রমে ২৪, ১১ ও ২২ শতাংশ।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকার মাতুয়াইলে শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের নবজাতক নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রের (এনআইসিইউ) প্রধান সহযোগী অধ্যাপক মো. মজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মৃত্যুঝুঁকির পাশাপাশি কম ওজন নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা, উচ্চতা ও বুদ্ধিমত্তা কম হওয়ার ঝুঁকি থাকে। অ্যাজমা ও হৃদ্যন্ত্র-সম্পর্কিত অসুস্থতার ঝুঁকি থাকে।
মজিবুর রহমান আরও বলেন, অপরিণত ও কম ওজনের শিশু জন্ম প্রতিরোধে বাল্যবিবাহ বন্ধ, ঘন ঘন সন্তান জন্ম না দেওয়া, মায়ের পুষ্টি, বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি দূষণমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। মাটির চুলা, ইটভাটা, সিগারেটের ধোঁয়ার বড় ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মায়েদের মুক্ত রাখতে হবে।