গণতন্ত্রের জন্য অব্যাহত সংগ্রাম

সহুল আহমদ

বাংলাদেশ নামে এই ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার এক পরম তৎপরতা ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। আধিপত্যশীল বয়ানে ১৯৪৭ ও ১৯৭১ সালকে পরস্পরবিরোধী ঘটনা হিসেবে দেখার রেওয়াজ চালু থাকলেও আমাদের জনগোষ্ঠীর লড়াইকে আমলে নিলে এটা স্পষ্টত প্রমাণিত হয়, যে মুক্তির বাসনা থেকে তাঁরা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন, ১৯৭১ সালের সশস্ত্র সংগ্রাম ছিল তারই ধারাবাহিক ও বিকশিত রূপ। পাকিস্তান আমলের যাবতীয় রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক তৎপরতায় গণতন্ত্রের প্রতি এই জনগোষ্ঠীর প্রবল ও দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা ফুটে ওঠে।

১৯৫৪ ও ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান প্রমাণ করে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য সব পন্থাই এস্তেমাল করা হয়েছে। সত্তরের নির্বাচনে জনগণের ভোটে বিজয়ী জনপ্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা না দেওয়ার উদ্দেশ্যে; অর্থাৎ অন্যভাবে বললে, জনগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে দমন করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী জেনোসাইড পরিচালনা করেছিল। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই থেকে রক্তাক্ত যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটেছিল ১৯৭১ সালে। ফলে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১—মাত্র ২৪ বছরের মধ্যে দুটি রাষ্ট্রের জন্মপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়াটা আদতে এই জনগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার স্ফুরণ। যে মুক্তির জন্য ১৯৪৭ সালে জনগোষ্ঠী তৎপর ছিল, সেই মুক্তির জন্যই একাত্তরে তাদের আবার রক্ত দিতে হয়েছে।

এটা একটা ট্র্যাজেডি, পাকিস্তান আমলের আন্দোলন-সংগ্রামে সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে থাকা গণতান্ত্রিক বাসনার বাস্তবায়ন পরবর্তী অর্ধশত বছরেও ঘটেনি। এমনকি যে জনগোষ্ঠী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইকে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার লড়াইয়ে রূপান্তর করেছিল, সেই জনগোষ্ঠী স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েও ৫০ বছরে টানা দুবার গণতান্ত্রিক কায়দায় শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের নজির দেখেনি।

একাত্তরের পর রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় গণতন্ত্র চর্চার উপাদানগুলোই বিভিন্ন শর্তের বেড়াজালে বন্দী হয়ে গেল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চা থেকেও জনগোষ্ঠীর সামূহিক তৎপরতা গৌণ হয়ে কেবল একজন ব্যক্তিকেই ইতিহাসের চালকের আসনে বসিয়ে দেওয়া হলো। যার ফলে মুক্তিযুদ্ধ থেকে গণতান্ত্রিক বাসনা আড়াল করে উল্টো মুক্তিযুদ্ধকেই বানানো হলো গণতন্ত্র হরণের হাতিয়ার। আওয়ামী শাসকশ্রেণির ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নামে মতাদর্শিক বয়ানের সঙ্গে গণমানুষের সংগ্রামের কোনো সম্পর্ক নেই। দুটোর গতি ও প্রকৃতি বরং ভিন্ন ও উল্টো।

সেই গণতান্ত্রিক বাসনা থেকেই তাই ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আবির্ভাব। একাত্তরে গণতন্ত্রের লড়াইকে দমন করার জন্য হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তৎকালীন স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া সরকার; চব্বিশে তেমনি স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই দমন করার জন্য আরেকটি হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। ৫০ বছরের ব্যবধানে গণতন্ত্রের জন্য এত বেশি রক্ত আর কোনো জনগোষ্ঠীকে ঝরাতে হয়েছে কিনা সন্দেহ।

১৯৪৭, ১৯৭১, ২০২৪—তিনটি ঘটনা এই জনগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক বাসনাকেই তুলে ধরেছে। ঘটনা তিনটিকে পরস্পরবিরোধী হিসেবে কল্পনা না করে বাংলাদেশের জনগণের সক্রিয়তা ও রাজনৈতিক তৎপরতার ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখা দরকার। তবেই আমরা প্রশ্ন করতে পারব, কেন আবারও রক্ত ঝরাতে হলো? কেন একাত্তরের মতো বিরাট ঘটনাও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পত্তন ঘটাতে ব্যর্থ হলো? কেন এবং কীভাবে খোদ ‘মুক্তিযুদ্ধ’ই হয়ে উঠেছিল গণতন্ত্রবিনাশী প্রকল্পের মতাদর্শিক হাতিয়ার? কেন আবারও ২০২৪ জরুরি হয়ে দেখা দিল?

এসব প্রশ্নই আমাদের দিশা দেবে এবং বুঝতে সাহায্য করবে, ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থান এই জনগোষ্ঠীর জীবনে কী বিরাট একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের যে ফসল বেহাত হয়েছিল, তা আবারও হাতে তোলার সুযোগ করে দিয়েছে চব্বিশ।

সহুল আহমদ: লেখক, অনুবাদক, অ্যাকটিভিস্ট। রাষ্ট্রচিন্তা জার্নালের সম্পাদনা পর্ষদের সদস্য।