‘মুখে দাগ নিয়ে এত কুৎসিত ছবি ফেসবুকে দিয়েছেন কেন’

নারী উদ্যোক্তা সানজিদা লিমা
ছবি সংগৃহীত

মুখে দাগ নিয়ে এত কুৎসিত ছবিটা ফেসবুকে কেন দিয়েছেন; এ ধরনের ছবি দিয়েছেন সমবেদনা পাওয়ার জন্য? পণ্য বিক্রি করবেন, পণ্যের ছবি দেন, সিম্প্যাথি বা সমবেদনা পাওয়ার প্রয়োজন হলে পণ্যের প্রচার বাদ দিয়ে দান বা সদকা চান; আপনার এমন ছবি দেখে তো ভয় পেয়ে গেছি; মন্তব্য সহ্য করতে পারেন না, তাহলে মন্তব্য করার মতো ছবি দেন কেন, নিজের এ রকম ছবি বারবার দেওয়ার তো কোনো মানে নেই।

এভাবে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন তির্যক মন্তব্যের মুখোমুখি হন অনলাইন নারী উদ্যোক্তা সানজিদা লিমা। কারণ একটাই, তিনি পণ্যের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিজের ছবি দেন। তাঁর মুখের অনেকটা অংশজুড়ে কালো রঙের একটি জন্মদাগ আছে, যা নিয়েই মানুষের এমন মন্তব্য।

সানজিদা বললেন, মুখে জন্মদাগ নিয়েও একটি মেয়ে নিজের ছবি ফেসবুকে প্রকাশে কোনো সংকোচবোধ করছেন না, বিষয়টি হয়তো অনেকে মানতে পারেন না। জন্মদাগ নিয়ে তাঁকে শুধু সাইবার বুলিংয়ের শিকার হতে হয় তা–ই নয়, সরাসরিও অনেক বাজে মন্তব্য হজম করতে হয়। অনেকে মুখের কাছে এসে হাত দিয়ে ধরে দেখতে চান। শিশুরা দেখলে ভয়ে দূরে সরে যায়।

বিরূপ মন্তব্যসহ বিভিন্ন কারণে মাত্র ২৪ বছর বয়সে হাঁপিয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তা সানজিদা। বললেন, ‘আমার মুখের দাগ দেখে অনেকে সরাসরিই বলেন, “মনে হয় তোমার মা কোনো পাপ করেছিলেন। তাঁর পাপের জন্যই এমন হয়েছে।” এর বাইরে যখনই কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাই, যোগ্যতা থাকার পরও ঘুরেফিরে মুখের দাগের প্রসঙ্গ আসে। একসময় দেখা যায় চাকরি হয়নি।’

‘আগে তেমন কিছু মনে হতো না। এখন স্বামী ও সন্তানের সামনে যখন কেউ বাজে মন্তব্য করে, তখন আর তা সহ্য করতে পারি না। লজ্জার বিষয় হয়ে গেছে ব্যাপারটি। অনেকে আমার এ দাগের জন্য করুণাও করেন। এখন আর ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে মনে হয় প্লাস্টিক সার্জারি করে মুখ থেকে দাগটি চিরতরে দূর করে দিই। তবে আমার নিজের পরিবার ও স্বামী এ জন্মদাগটিকে খুব সহজভাবে মেনে নিয়েছেন। তাই মন খারাপ হলেও আবার সাহস পাই সামনে চলার জন্য’—বললেন সানজিদা।

সানজিদার অনলাইন উদ্যোগের নাম ‘অরোরা’। উদ্যোগটির প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তাঁর তৈরি বিছানার চাদর দেশের ১৮টি জেলার মানুষসহ দেশের বাইরের ক্রেতারাও কিনছেন। আপাতত সানজিদার একটাই স্বপ্ন, অরোরাকে আরও বড় করা।

রংপুরের মেয়ে সানজিদা। ইংরেজি সাহিত্যে এম এ করছেন। দুই বছর হলো বিয়ে করেছেন। স্বামীর নাম শাহীন আলম। চার মাস বয়সী একমাত্র ছেলেকে নিয়েই এই দম্পতির সংসার। সানজিদা জানালেন, তাঁর বাবা মো. হায়দার আলী ঢাকায় একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। তিনি ঢাকা থেকে গজ কাপড় কিনে পাঠান। সানজিদা ঘরে বসে গজ কাপড় সেলাই করে বিছানার চাদর তৈরি করেন।

নিজেদের পছন্দের পর পারিবারিকভাবেই শাহীনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় বলে জানান সানজিদা। তিনি বলেন, মুখের দাগের জন্য এখনো শ্বশুরবাড়ি থেকে তাঁকে পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নেওয়া হয়নি। তাই স্বামী শাহীন বাধ্য হয়ে রংপুরেই থাকছেন। শ্বশুরবাড়ির লোকজন স্বামীকে ফোন করে প্রায়ই বলেন, সানজিদাকে টাকাপয়সা দিয়ে হলেও তালাক দিতে।

সানজিদা বলেন, ‘বড় মেয়ের পর বাবা চেয়েছিলেন পরের সন্তান ছেলে হবে। তবে পরের সন্তানও মেয়ে হয়েছে জেনে মন খারাপ করেছিলেন বাবা। দুদিন পর আমাকে দেখেন তিনি। তবে আমার মুখের দাগটি বাবাকে সম্পূর্ণ অন্য মানুষ বানিয়ে দেয়। আমাকে দেখে অনেক কান্নাকাটি করেন রাগী বাবা। সেই ছোটবেলা থেকে দেখছি, আমাকে দেখে কেউ হাসলে বা বাজে কথা বললে বাবা তা সহ্য করতে পারেন না। কোনো না কোনোভাবে তার প্রতিবাদ করেন।’

সানজিদা ফেসবুকে নারী উদ্যোক্তাদের প্ল্যাটফর্ম উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ট্রাস্টের (উই) সদস্য। দেড় বছর ধরে তিনি উইয়ের সঙ্গে আছেন। যখনই সানজিদা সেখানে নিজের ছবিসহ কোনো পণ্যের পোস্ট দেন, তাঁকে বাজে মন্তব্য হজম করতে হয়।
তবে সানজিদা উইয়ের অন্য সদস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করলেন।

নারী উদ্যোক্তা সানজিদা লিমা
ছবি সংগৃহীত

বললেন,‘বাজে মন্তব্য দেখেও এখন আর সব সময় প্রতিবাদ করতে ইচ্ছা করে না। গ্রুপের অন্য সদস্যরাই মন্তব্যকারীদের কথা শুনিয়ে দেন। তাঁরাই আমার হয়ে ঝগড়া করেন। আর উই গ্রুপের সদস্যদের জন্যই বিক্রিও বেশ ভালো।’

উইয়ের অন্য উদ্যোক্তাদের মধ্যে কেউ কেউ সানজিদার ছবি নিজেদের পোস্টে ব্যবহার করেন। উদ্দেশ্য নিজেদের পোস্টের পরিচিতি বাড়ানো। সানজিদা বলেন, ‘আমার ছবি অনেকেই ব্যবহার করছেন নিজেদের স্বার্থে। এটাও আমার ভালো লাগে না। পোস্টদাতারা বোঝাতে চান, তাঁরা আমার প্রতি সমব্যথী হয়েই পোস্টটি করছেন, কিন্তু আসলে তো তা নয়।’

ব্যবসা কেমন চলছে জানতে চাইলে মুঠোফোনের এ প্রান্ত থেকে সানজিদার স্বস্তির নিশ্বাসের শব্দ পাওয়া গেল। বললেন, তাঁকে সন্তান-সংসার-ব্যবসা বলতে গেলে একা হাতেই সব সামলাতে হচ্ছে। স্বামী চাকরি করে যেটুকু সময় পান, তখন কিছুটা সহায়তার চেষ্টা করেন। তারপরও গত এক বছরের কিছু বেশি সময়ে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করেছেন। এর আগে তিনি আদা, রসুনসহ বিভিন্ন বাটা মসলা অনলাইনে বিক্রি করতেন।

উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা নাসিমা আক্তার জানালেন, উইয়ের সদস্য সংখ্যা এখন ১২ লাখ। উদ্যোক্তা সানজিদাকে গ্রুপ থেকে বাজে মন্তব্য শুনতে হচ্ছে—এ প্রসঙ্গে নাসিমা আক্তার বলেন, ‘মুখের জন্মদাগের সঙ্গে ব্যবসার কোনো সম্পর্ক নেই। এ দাগের জন্য তাঁর মেধা কমে যাচ্ছে, বিষয়টি তো তেমন নয়। দাগের জন্য কেউ যদি সানজিদাকে হেয় করে বাজে মন্তব্য করেন, তা অত্যন্ত অন্যায়। যাঁরা বাজে মন্তব্য করছেন, তাঁদের মনমানসিকতার পরিবর্তন হওয়া জরুরি।’

মনোচিকিৎসক ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক আহমেদ হেলাল প্রথম আলোকে বলেন, সানজিদা সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। এতে তাঁর মধ্যে তীব্র মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। তাঁর মধ্যে হতাশা ও বিষণ্নতা তৈরি হচ্ছে।

আবেগ নিয়ন্ত্রণেও সমস্যা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে করণীয় হলো, তিনি বাজে মন্তব্যগুলো একদমই আমলে নেবেন না, পাত্তা দেবেন না। নির্লিপ্ত থাকলে একসময় বাজে মন্তব্যের সংখ্যা কমে আসবে। তর্কে গেলে অন্যরাও বাজে মন্তব্য করতে উৎসাহী হতে পারেন।
যাঁরা সানজিদাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করছেন, তাঁরা শারীরিকভাবে সুস্থ। তবে তাঁদের শিক্ষা-সভ্যতার ঘাটতি আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের আদবকেতা মানছেন না তাঁরা। এটি তাঁদের ব্যক্তিত্বের বিকাশের সমস্যা বলেও উল্লেখ করলেন আহমেদ হেলাল।