চাঁদ জয়ের কত বাকি

এ বছরের প্রথম দুমাসে দুই দেশের দুটি মহাকাশযান চাঁদে অবতরণ করেছে। একটি জাপানের মুন স্নাইপার, আরেকটি যুক্তরাষ্ট্রের অদিসেউস। দুটিই মনুষ্যবিহীন। অদিসেউস আবার প্রথম ব্যক্তিমালিকানাধীন মার্কিন নভোযান। সেটি তৈরি করেছে ‘ইন্টুইটিভ মেশিনস’ নামে একটি কোম্পানি। অবশ্য এর নির্মাণ, উৎক্ষেপণ ও চাঁদে অভিযান পরিচালনার জন্য নাসা ও মার্কিন বিমানবাহিনী পূর্ণ সহায়তা দিয়েছে।

১৯৭২ সালের প্রায় অর্ধশতাব্দী পর আবার কোনো মার্কিন নভোযান চাঁদে গেল, তা-ও বেসরকারি বাণিজ্যিক কোম্পানির অর্থায়নে। এটি নেমেছে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে। অবশ্য তার আগে, গত বছরের আগস্ট মাসে, ভারতের চন্দ্রযান-৩ চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফট ল্যান্ডিং বা সফল অবতরণ করতে সক্ষম হয়। এটিই প্রথম কোনো নভোযান, যেটি চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে নেমেছিল।

ওই একই সময়ে রাশিয়ার নভোযান লুনা-২৫ চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণের পরিকল্পনা করেছিল, কিন্তু সফল অবতরণে ব্যর্থ হয় সেটি। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চন্দ্রপৃষ্ঠের সঙ্গে সংঘর্ষে ধ্বংস হয়ে যায়। এদিকে বছরের শুরুতেই চীন ঘোষণা দিয়েছে, তারা চাঁদের কক্ষপথে স্থাপনের জন্য দুটি কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠাবে। এর পরপরই রাশিয়া ঘোষণা করেছে, আগামী এক যুগের মধ্যে চীনের সঙ্গে যৌথভাবে চাঁদে একটি পারমাণবিক কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করছে তারা। যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, তারা এ বছরই আবার চাঁদে মানুষ পাঠাবে। আর্টেমিস-২ নামের এই মিশনে থাকবেন চারজন নভোযাত্রী। তাঁদের অন্তত একজন হবেন নারী। আর্টেমিস-৩ যাবে ২০২৪ বা ২০২৫ সালে।

বাণিজ্যিকভাবেও চাঁদে ভ্রমণের খুব তোড়জোড় চলছে। মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্কের কোম্পানি স্পেসএক্স জানিয়েছে, তাদের নভোযান এ বছরের শেষ দিকে জাপানি বিলিয়নিয়ার ইউসাকু মায়জাওয়াসহ আটজনকে ‘ডিয়ারমুন ভয়েজ’-এর কর্মসূচির অংশ হিসেবে চন্দ্রভ্রমণে নিয়ে যাবে। তারা অবশ্য চাঁদে নামবে না। আশপাশে, মানে কক্ষপথে ঘুরে আসবে। একে বলা যেতে পারে চাঁদ-পর্যটন এবং এটিই হবে তাদের প্রথম ট্রিপ। তবে অদূর ভবিষ্যতে প্রতিটি ট্রিপে অন্তত ১০০ জন ‘পর্যটক’কে চাঁদে নিয়ে যেতে পারবে স্পেসএক্স। গত বছরের এপ্রিলে তাদের প্রথম রকেট স্টারশিপ অবশ্য পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণের কিছুক্ষণ পরই বিস্ফোরিত হয়েছিল। বিপুল ব্যয়ে নির্মিত রকেটটি ধ্বংস হলেও ইলন মাস্ক তাঁর সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছিলেন এ জন্য যে অন্তত পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ তো সম্ভব হলো!

মনে কি হচ্ছে না, চাঁদ জয়ের জন্য আবার একটা ধুন্ধুমার প্রতিযোগিতা লেগে গেছে উন্নত দেশগুলোর মধ্যে? এ রকম প্রতিযোগিতাই দেখা গিয়েছিল গত শতকের ষাটের দশকে। তখন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন—দুই পরাশক্তির মধ্যে চলছিল শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। সেটা স্নায়ুযুদ্ধের কাল। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন আর পুঁজিবাদী যুক্তরাষ্ট্রের এই লড়াইয়ের কৌতূহলী প্রত্যক্ষদর্শী ছিল সমগ্র বিশ্বের মানুষ। ১৯৬৯ সালে মার্কিন নভোযান অ্যাপোলো-১১ তিনজন নভোযাত্রীকে নিয়ে চাঁদে অবতরণের জন্য উড়াল দেয় এবং নামতে সক্ষম হয়। সেই থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত মোট ১২ জন নভোচারীকে চাঁদে পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। তার পর থেকে চাঁদ জয়ের এই যুদ্ধ স্তিমিত হয়ে আসে। তবে মহাকাশ গবেষণায় ছেদ পড়েনি। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এ ব্যাপারে প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে যুক্তরাষ্ট্র। এ প্রসঙ্গে ভয়েজার-টু মিশন এবং জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের মতো দুটি অসাধারণ প্রকল্পের কথা বলা যেতে পারে, যা আমাদের মহাবিশ্বের অনেক অজানা তথ্য জানতে সাহায্য করেছে।

তবে চাঁদে অভিযানের ব্যাপারে তাদের তেমন কোনো উদ্যোগ আর ছিল না। প্রায় অর্ধশতাব্দী পর কেন বারবার আবার ফিরে আসছে চাঁদে অভিযানের প্রসঙ্গ? কেনই-বা দক্ষিণ মেরু নিয়ে এত কৌতূহল? চাঁদে অভিযানের এই মাতামাতি কি কেবলই বৈজ্ঞানিক কৌতূহল থেকে উৎসারিত? মোটেও নয়। এর পেছনে রাজনীতি আছে এক বড় জায়গাজুড়ে। তা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করব লেখাটির পরের অংশে।

চাঁদ নিয়ে কৌতূহল অবশ্য কেবলই আধুনিক যুগের ব্যাপার নয়; প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল চাঁদ। অনেক তত্ত্ব, সংস্কার, মাপজোখ জড়িয়ে ছিল চাঁদের সঙ্গে। আসুন, শুরুতেই তার কিছুটা জেনে নেওয়া যাক।

পুরাণ, সংস্কার, ইতিহাস

চাঁদ নিয়ে প্রথম লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ৪০০ বছর আগে—পিথাগোরাসের পরে এবং সক্রেটিসের আগে—দার্শনিক ফিলোলাউসের লেখা বিষয় প্রকৃতি বইটিতে। চাঁদই অবশ্য তাঁর লেখার একমাত্র বিষয়বস্তু ছিল না, ছিল মহাবিশ্ব ও প্রকৃতির নিয়মাবলি-সম্পর্কিত। তিনিই ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তি, যিনি সৌরজগতের কেন্দ্র হিসেবে পৃথিবীকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান, তবে সূর্যকেও তিনি কেন্দ্রীয় আসন দেননি। তাঁর মতে, সূর্য, পৃথিবী ও অন্য গ্রহগুলো আবর্তন করছে একটা কেন্দ্রীয় অগ্নিকুণ্ডকে ঘিরে। অর্থাৎ ওই কেন্দ্রীয় অগ্নিকুণ্ড ছাড়া আর কিছুই স্থির নয়, এমনকি সূর্যও। তাঁর দর্শনের বহু কিছুই কৌতূহলোদ্দীপক। তবে আমাদের এই লেখার বিষয় যেহেতু চাঁদ, তাই অন্য বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করছি না।

ফিলোলাউস লিখেছিলেন, ‘চাঁদটা পৃথিবীরই মতো। সেখানেও মানুষ আছে, আছে জীবজন্তু, যদিও সেগুলোর আকার বেশ বড়। রয়েছে পৃথিবীর গাছপালার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর বৃক্ষরাজি ও তরুলতা। পৃথিবীর প্রাণীর চেয়ে চাঁদের প্রাণীরা ১৫ গুণ বেশি শক্তিশালী, কারণ চাঁদের দিনরাত্রির সময় আমাদের চেয়ে ১৫ গুণ দীর্ঘ।’

বলাই বাহুল্য, এগুলো পর্যবেক্ষণলব্ধ তথ্য নয়, অনুমানের ভিত্তিতে লেখা। তবে শেষ বাক্যটি কিন্তু এক অর্থে ঠিক। চাঁদে রাত নেমে এলে তা প্রায় দুই সপ্তাহ স্থায়ী হয়, দিনও তা-ই। আমরা এখন তার কারণও জানি। আবার এ কথাও ঠিক যে সৌরজগতের কোনো কিছুই স্থির নয়, গ্রহ-উপগ্রহ তো নয়ই, এমনকি সূর্যও নয়। কেবল তা-ই নয়, মহাবিশ্বের সবকিছুই যে গতিশীল, কিছুই স্থির নয়, তা আমরা জানতে পেরেছি বিংশ শতাব্দীতে এসে, ফিলোলাউসের লেখার আড়াই হাজার বছর পর। তবে কেন্দ্রীয় অগ্নিকুণ্ডের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

চাঁদে মানুষ বা অন্যান্য প্রাণী বা গাছপালা থাকার এই কল্পনা অবশ্য বেশি দিন গ্রহণযোগ্য ছিল না। তা ছাড়া এ বিষয়ে তিনিই প্রথম বিশ্বাসী নন; তাঁর জন্মের শত শত বছর আগে থেকে প্রাচীন গ্রিকরা বিশ্বাস করত যে তাদের জাতির বিশিষ্টজনেরা মৃত্যুর পর চাঁদে গিয়ে আবার জেগে ওঠেন এবং সেখানেই সুখে-শান্তিতে বাস করেন! কে জানে, গ্রিকদের এই বিশ্বাসই ফিলোলাউসকে চাঁদে মানুষ থাকার কল্পনা করতে প্ররোচিত করেছিল কি না!

যাহোক, চাঁদ নিয়ে প্রথম ‘বৈজ্ঞানিক’ পর্যবেক্ষণের নিদর্শন রয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় চার হাজার বছর আগের ব্যাবিলনীয় সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে পাওয়া বিভিন্ন মাটির ফলকে লেখা বিবরণে। সম্ভবত তাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস নদীর তীরবর্তী এসব জনপদের মুক্ত আকাশ বছরের অধিকাংশ সময়ই মেঘমুক্ত থাকত। পাহাড়ের ওপর নির্মিত বিশেষ টাওয়ার থেকে তৎকালীন জ্যোতির্বিদেরা আকাশ পর্যবেক্ষণ করতেন এবং সেসব লিখে রাখতেন। বলা বাহুল্য, তাঁদের খালি চোখেই পর্যবেক্ষণ করতে হতো; কারণ, তখন দুরবিন আবিষ্কারের চিন্তা মানুষের দূরতম কল্পনায়ও আসেনি। পর্যবেক্ষণগুলো বৈজ্ঞানিক হলেও সেসবের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পুরোপুরি বিজ্ঞানসম্মত ছিল না। তাঁরা মনে করতেন, আকাশের ওই উজ্জ্বল বস্তুগুলো একেকজন দেবতা এবং পৃথিবীর সমস্ত ঘটনাই ঘটে তাঁদের ইচ্ছায়। এ-ও বিশ্বাস করতেন যে পৃথিবীতে কী ঘটতে চলেছে, তার ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় আকাশ পর্যবেক্ষণ করেই। কারণ, আকাশে সেসবের চিহ্ন ফুটে ওঠে। এই বিশ্বাসের কারণে জ্যোতির্বিদেরা তখন জনসমাজে এতটাই প্রভাবশালী ছিলেন যে তাঁদের পরামর্শ ছাড়া কিছুই করা হতো না। সাগরে ভাসত না কোনো জাহাজ, শুরু হতো না কোনো যুদ্ধযাত্রা, এমনকি ফসল রোপণ করা বা তা ঘরে তোলাও হতো না। তাঁরা আকাশ পর্যবেক্ষণ করে আসন্ন দুর্যোগের ভবিষ্যদ্বাণীও করতেন। তাঁদের প্রভাবের সেটিও ছিল একটি প্রধান কারণ। দুর্যোগকে কেই–বা ভয় না পায়? আর তা যদি আগেভাগেই কেউ জানাতে সক্ষম হন, তিনি তো রাজকীয় সম্মান পাবেনই। ইংরেজিতে ‘ডিজাস্টার’ শব্দের মূলে আছে কিন্তু ‘ব্যাড স্টার’ বা অশুভ নক্ষত্র! জ্যোতির্বিদেরা বলতে গেলে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁরা যতটা না বিজ্ঞানী ছিলেন, তার চেয়ে বেশি ছিলেন ধর্মযাজক। পৃথিবীর প্রধান ধর্মগুলো তখনো প্রবর্তিত না হলেও মানুষের বিশ্বাস ও সংস্কারগুলো ছিল ধর্মের মতোই অলঙ্ঘনীয়।

তবে এ-ও স্বীকার করতে হবে, চাঁদ ও সূর্যের আবর্তন যে একটা বিশেষ নিয়ম মেনে চলে, সেটি কিন্তু তাঁরা আবিষ্কার করেছিলেন, যদিও তাতে সময় লেগেছিল অনেক। তখন ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ডের হিসাব ছিল না, সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখে দিনের হিসাব করা যেত। সেই হিসাব করেই তাঁরা দেখেছিলেন, সাড়ে উনত্রিশ দিনে চাঁদ একবার করে শুক্লপক্ষ-কৃষ্ণপক্ষের আবর্তন শেষ করে। এই সময়ের নামই হলো মাস। মাস বা ইংরেজিতে ‘মান্থ’ শব্দটি এসেছে পুরোনো ইংরেজি শব্দ ‘মোনা’ থেকে, যেটি আবার ধার করা হয়েছে লাতিন শব্দ ‘মেট্রি’ থেকে, যার অর্থ পরিমাপ করা। আরেকটি লাতিন শব্দ ‘মেনসিস’ মানে মাস। অর্থাৎ চাঁদের সাহায্যে যে পরিমাপ করা হয়, তার নাম মাস। চাঁদের বারোটি পূর্ণ আবর্তনের সঙ্গে যে সূর্য-প্রভাবিত ঋতু পরিবর্তনের সম্পর্ক আছে, সেটিও ব্যাবিলনবাসী জ্যোতির্বিদেরা জানতেন। কারণ, সূর্যের আবর্তন বোঝা যেত একই ঋতুর প্রত্যাবর্তনে।

মাসের সংখ্যা বারো হওয়ার কারণও এটি। এই বারোটি আবর্তনের জন্য লাগত ৩৫৪ দিন। কারণ, সাড়ে উনত্রিশকে ১২ দিয়ে গুণ করলে হয় ৩৫৪। কিন্তু সূর্যের আবর্তন হতো প্রায় ৩৬৫ দিনে। এই দুই হিসাব মিলছিল না। তাহলে বাকি ১১ দিনের কী হবে? এই অসংগতিকে দূর করার জন্য তাঁরা নির্দিষ্ট সময় পরপর বছরে একটি বাড়তি মাস যোগ করতেন। এই ১৩তম মাসটিকে অশুভ বলে মনে করা হতো। প্রাচীনকালের এই কুসংস্কার বহুকাল ধরে বয়ে বেড়িয়েছে মানুষ, ১৩ সংখ্যাটিকেই অপয়া বা অশুভ বলে মনে করা হয়েছে বহুকাল ধরে।

মাসের এই হিসাব কাজে লাগত চাষাবাদ, ফসল রোপণ ও কাটার জন্য। তখন পর্যন্ত মাসই ছিল সময় পরিমাপের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় একক। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনের ধরনও পাল্টায়। ফলে আরও ক্ষুদ্র এককের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এক মাসকে ভাগ করা হয় চারটি সপ্তাহে। সপ্তাহের প্রথম দিনটিকে ধরা হয় সূর্যদিবস, সে জন্য এর নাম হয় রোববার বা সানডে। দ্বিতীয় দিনটি হলো চন্দ্রদিবস। সে জন্য নাম হয় সোমবার বা মানডে। এই নামকরণগুলো ঘটে বেশ পরে। যদিও ব্যাবিলনবাসী সূর্যঘড়ির উদ্ভাবন করেছিল এবং সেটি নিখুঁত সময় দিত, কিন্তু ১ দিনকে ২৪ ঘণ্টায় ভাগ করা, ১ ঘণ্টাকে ৬০ মিনিটে ভাগ করা বা ১ মিনিটকে ৬০ সেকেন্ডে ভাগ করার ঘটনা ততটা প্রাচীন নয়। এগুলো মোটামুটি প্রাক্আধুনিক যুগেই ঘটেছিল। ১৬৫৭ সালে ডাচ জ্যোতির্বিদ ক্রিশ্চিয়ান হাইজেন্স প্রথম ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ড ভাগ করে ঘড়ি আবিষ্কার করেন।

ব্যাবিলনবাসী জ্যোতির্বিদদের বিবিধ পর্যবেক্ষণ থেকে যেমন অনেক বৈজ্ঞানিক সত্য আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছিল, তেমনই নানা রকম কুসংস্কারের আবির্ভাবও হয়েছিল। ১৩ সংখ্যার কুসংস্কারের কথা আগেই বলেছি। আরেকটির কথা বলা যাক।

চাঁদের আরেক নাম লুনা। বিজ্ঞানসম্মত কারণেই নামটি বেছে নেওয়া হয়েছিল। একসময় জানা ছিল না যে কেবল পৃথিবীর নয়, অন্য গ্রহেরও চাঁদ আছে। আধুনিক যুগে এসে যখন তা জানা গেল এবং এ-ও জানা গেল যে তাদের আবর্তনকাল পৃথিবীর চাঁদের মতো নয়, তখন আমাদের চাঁদকে ভিন্ন একটি নাম দিলেন বিজ্ঞানীরা—লুনা। কারণ, মুন শব্দটি এসেছে সময় পরিমাপের ধারণা থেকে। সব চাঁদের আবর্তনকাল যদি এক না-ই হয়, তাহলে নাম একই হয় কীভাবে? কিন্তু লুনা শব্দটি এল কোত্থেকে? এল লুনাসি বা লুনাটিক থেকে। লুনাসি শব্দের অর্থ উন্মত্ততা বা পাগলামি, আর লুনাটিক মানে উন্মাদ। প্রাচীনকালে মানুষ বিশ্বাস করত যে চাঁদের প্রভাবে কোনো কোনো মানুষ উন্মত্ত আচরণ করে, কেউবা উন্মাদ হয়ে যায়। এ কারণে চাঁদের নাম হলো লুনা।

ভারতবর্ষে অবশ্য লুনাসিকে অতটা খারাপ চোখে দেখা হয় না, বরং আদর করে চাঁদে-পাওয়া বা চন্দ্রগ্রস্ত বলা হয়। যেমন গৌতম বুদ্ধকে বলা যেতে পারে চাঁদে-পাওয়া মানুষ। তাঁর জন্ম পূর্ণিমায়, তিনি গৃহত্যাগ করেছিলেন পূর্ণিমায়, বোধিপ্রাপ্ত হয়েছিলেন পূর্ণিমায় এবং দেহাবসানের দিনটিও ছিল পূর্ণিমা। তাঁর জীবনের সব প্রধান ঘটনাই ঘটেছিল পূর্ণিমার রাতে। এ থেকে অনুমান করা যায় যে তিনি চাঁদে-পাওয়া মানুষ ছিলেন।

এ রকম মানুষ আমাদের আশপাশেও দেখতে পাবেন। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে সুনামগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন মমিনুল মউজউদ্দীন। তিনি পূর্ণিমার রাতে শহরে কয়েক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ দিতেন যেন শহরবাসী প্রাণভরে পূর্ণিমার রূপ উপভোগ করতে পারে! নাগরিকেরা পূর্ণিমা উপভোগ করবে কি না, সেটা তো তাদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার, চেয়ারম্যান সাহেবের এ নিয়ে এত আগ্রহ ছিল কেন? কারণ সম্ভবত এ-ই যে তিনিও ছিলেন চাঁদে-পাওয়া মানুষ। একা একা ভরা পূর্ণিমার রূপ দেখে তাঁর সাধ মিটত না, শহরের সমস্ত মানুষকে তা দেখাতে ইচ্ছা করত। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর গল্প-উপন্যাস-গান-নাটক-সিনেমায় চাঁদ ও পূর্ণিমার রাত নিয়ে যে কত কিছু লিখেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। ‘চান্নিপসর রাইতে’ মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা জানিয়ে দয়াময়ের কাছে প্রার্থনাও জানিয়েছিলেন তিনি তাঁর একটি গানে; যদিও তাঁর সেই ইচ্ছা পূরণ হয়নি।

যাহোক, নভোমণ্ডল ও চাঁদ নিয়ে আগ্রহ-কৌতূহল-পর্যবেক্ষণ যে কেবল প্রাচীন ব্যাবিলনবাসীরই ছিল, তা নয়; ভারত, চীন, আরব, মিসর, গ্রিস, মেক্সিকো প্রভৃতি অঞ্চলের মানুষেরও ছিল। লক্ষ করলে দেখা যায়, পাশ্চাত্যে সৌরবর্ষ এবং মাসের একচ্ছত্র প্রচলন হলেও প্রাচ্যে এখনো পর্যন্ত চান্দ্রমাসেরই আধিক্য। এমনকি প্রাচ্যের ধর্মগুলোও চন্দ্র–প্রভাবিত। বৌদ্ধদের সমস্ত উৎসব পূর্ণিমাকেন্দ্রিক, মুসলমানদের মাস গণনা এবং উৎসবও চন্দ্রকেন্দ্রিক, হিন্দুদের বিয়ে-পূজা-পার্বণসহ প্রায় সবকিছুই চান্দ্রতিথির হিসাবে চলে। এশিয়ার প্রায় সব দেশই নিখুঁতভাবে চান্দ্রতিথি, ক্ষণ, পূর্ণিমা, অমাবস্যা ইত্যাদি নির্ভুল গণনা করতে সক্ষম ছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই হিসাব, গণনা, পরিমাপ ইত্যাদি বোধ হয় স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবেই করা হয়েছিল, কারণ তখনকার দিনে যোগাযোগব্যবস্থা সহজ ছিল না, জ্ঞানের আদান-প্রদানও সহজ ছিল না। সৌরবর্ষের হিসাব বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তার করলেও এসব অঞ্চলের মানুষ তাদের পূর্বসূরিদের চর্চিত জ্ঞান এবং প্রজ্ঞাকে পরিত্যাগ করেনি। সে জন্যই চন্দ্রভিত্তিক সময়-মাস-বছর গণনা এবং তিথি-ক্ষণ মিলিয়ে উৎসবের রীতি আজও টিকে আছে।

চাঁদের জন্ম ও গঠন

চাঁদের জন্ম নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এই ধারণা ব্যক্ত করা হয়েছে যে পৃথিবীর আদিম অবস্থায়, অর্থাৎ গঠনের সময় থিয়া নামে একটি আদিগ্রহের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় এবং সেই অতিকায় সংঘর্ষের পরে থিয়াকে আর দেখা না গেলেও চাঁদের দেখা মেলে। সম্ভবত থিয়া গ্রহের কিছু অংশ চাঁদ গঠন করেছিল, কিছু অংশ পৃথিবীর সঙ্গে মিশে গিয়েছিল, আর বাকি অংশ মহাশূন্যে মিলিয়ে গিয়েছিল। চন্দ্র অভিযানের সময় চাঁদ থেকে মাটির যে নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন নভোযাত্রীরা। সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পৃথিবী ও চাঁদের উপাদানে অনেক মিল আছে। সেগুলোর উৎসও একই হওয়ার কথা—এই যুক্তিতে থিয়ার সঙ্গে পৃথিবীর সংঘর্ষের কথা বলা হচ্ছে।

চাঁদের জন্ম কীভাবে হয়েছিল—এই প্রশ্ন কিন্তু নতুন নয়। এ নিয়ে ভাবনাচিন্তা আর বিতর্কও নতুন নয়। চাঁদ কি পৃথিবীর সমান বয়সী, নাকি পরে কখনো সৃষ্টি হয়েছে? চাঁদ কি পৃথিবীরই অংশ, নাকি ভিন্ন কোনো উৎস থেকে তৈরি? পৃথিবী আর চাঁদ সৃষ্টির উপাদান কি একই, নাকি আলাদা? এই ধরনের বিবিধ প্রশ্নে প্রাণবন্ত বিতর্ক চলছে কয়েক শ বছর ধরে। পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে মোটামুটি সাড়ে চার বিলিয়ন (১ বিলিয়ন সমান ১০০ কোটি) বছর আগে—এ বিষয়ে বিজ্ঞানীরা মোটামুটি একমত হয়েছেন। চাঁদের জন্ম কি একই সময়ে? এ নিয়ে এখনো গবেষণা শেষ হয়নি। চাঁদের জন্ম নিয়ে কয়েকটি পুরোনো তত্ত্বের কথা বলা যাক।

১৭৯৬ সালে পিয়েরে সাইমন দ্য লাপ্লাস নামের এক ফরাসি গণিতবিদ তাঁর ‘নেবুলার হাইপোথিসিস’ বা নীহারিকা মতবাদে বলেছিলেন, বিরাটাকার কোনো মেঘের মতো আঠালো বাষ্পীয় ধোঁয়ার মধ্যেই সৌরজগৎ সৃষ্টির সূচনা হয়। সুদীর্ঘ সময় ধরে এই মেঘগুলো জমাটবদ্ধ হয়ে চারপাশে কতগুলো বলয় তৈরি করে। এই বলয়গুলোই ধীরে ধীরে কঠিন পদার্থে পরিণত হয়ে গ্রহ ও উপগ্রহ তৈরি করে। আর ধোঁয়ার কেন্দ্রীয় অংশ তৈরি করে সূর্য। পৃথিবী সৃষ্টি হওয়ার পর আবার এর চারপাশে বলয় তৈরি হয় এবং একইভাবে জন্ম নেয় চাঁদ। এই মতবাদ অবশ্য পরে পরিত্যক্ত হয়।

আরেকটি তত্ত্ব হলো ‘দ্য থিওরি অব ওয়ান্ডারিং স্টার’ বা চলমান তারার সূত্র। এই সূত্রের মূল কথা হলো, কোনো এক অজানা মহাজাগতিক বস্তু সূর্যের খুব কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় মহাকর্ষের কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, আর সেই বিচ্ছিন্ন অংশগুলোই তৈরি করে গ্রহ-উপগ্রহগুলো।

প্রকৃতিবিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের পুত্র স্যার জর্জ এইচ ডারউইন চাঁদের জন্ম নিয়ে টাইডাল হাইপোথিসিস বা জোয়ার-ভাটা তত্ত্বের সূত্রপাত করেন। তাঁর মতে, চাঁদ ও পৃথিবী একসময় একই মহাজাগতিক বস্তুপিণ্ড ছিল। তখন পৃথিবীর কক্ষপথ অনিশ্চিত, অস্থির এবং ক্রমাগত পরিবর্তনশীল ছিল বলে কোনো এক সময় এর গলিত পদার্থ ঠিকরে বেরিয়ে আসে এবং চাঁদের জন্ম হয়। ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, পৃথিবী প্রথমে গোলাকৃতির থাকলেও সূর্যের আকর্ষণজনিত জোয়ার-ভাটার জন্য এবং নিজ কক্ষপথে তার দোলন ও কম্পনের ফলে উপবৃত্তকার রূপ নেয়। মনে রাখতে হবে, পৃথিবী গঠনের সময় কঠিন বস্তু প্রায় ছিলই না, প্রায় সবই ছিল গলিত অবস্থায়। কারণ, তাপমাত্রা ছিল অত্যধিক বেশি। সে জন্য সূর্যের আকর্ষণে পৃথিবীতে জোয়ারের ধরন ছিল সম্পূর্ণই আলাদা এবং ভীষণ শক্তিশালী। কোনো এক জোয়ারের সময় পৃথিবী এতটাই স্ফীত হয়ে ওঠে যে এর আকার পরিবর্তন হয়ে বর্তুল পাত্রের মতো হয়ে ওঠে এবং এর ওপরের অংশটি ছিটকে বেরিয়ে মহাকাশে স্থান নেয়। জন্ম হয় চাঁদের। তাঁর এই তত্ত্ব অবশ্য এখন আর বিজ্ঞানীরা গ্রহণ করেন না। তাঁদের যুক্তি হলো, চাঁদের যে আয়তন ও ভর, তা দেখে মনে হয় না, এত বড় বস্তুপিণ্ড পৃথিবী থেকে ছিটকে বেরিয়ে মহাকাশে চলে যেতে পারে।

আবার পার্টিকল অ্যাকিউমুলেশন থিওরি বা কণার জমাটবদ্ধতা তত্ত্বে বলা হয়েছে, যে বাষ্পীয় মেঘ থেকে চাঁদ ও পৃথিবীর জন্ম, সেটি গ্যাস নয়, বরং কঠিন বস্তুকণায় পূর্ণ ছিল। এই কণাগুলো ধাক্কা খেতে খেতে পরস্পরের গায়ে লেগে যেতে থাকে, যেমন করে স্নোবল তৈরি হয়, অনেকটা সেভাবে। এর সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে সৌরজগতের নানা আলগা বস্তুপিণ্ড। এভাবে দীর্ঘ ও ধীর প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় পৃথিবী, চাঁদসহ অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহ।

এসব তত্ত্ব এসেছিল মানুষ চাঁদে যাওয়ার আগে। ১৯৬৯ সালে মানুষ চাঁদে গেলে নমুনা হিসেবে প্রায় ২১ কেজি মাটি ও পাথর নিয়ে আসে। তা নিয়ে গবেষণার ফলাফল হিসেবেই বলা হচ্ছে, পৃথিবীর গঠনের সময় থিয়া নামে গ্রহটি পৃথিবীর কক্ষপথে এসে পড়ে এবং প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। থিয়ারও তখন কেবল গঠনকাল চলছিল। আকার ছিল মোটামুটি মঙ্গল গ্রহের সমান। ভর ছিল পৃথিবীর ১০ ভাগের ১ ভাগ। গঠনশীল দুই গ্রহের সংঘর্ষের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ছোট গ্রহটি, অর্থাৎ থিয়া। এর কিছু অংশ পৃথিবীর সঙ্গে মিশে যায়, বাকি অংশ ছিটকে গিয়ে চাঁদ গঠন করে; থিয়া নিজে হারায় তার অস্তিত্ব। থিয়ার সংঘর্ষের ফলে চাঁদ তৈরি হওয়ায় এবং কিছু অংশ পৃথিবীতে লীন হওয়ায় পৃথিবী ও চাঁদের উপাদানে এত মিল!

অবশ্য এই তত্ত্ব কত দিন স্থায়ী হবে, তা-ও বলা যায় না। নতুন কোনো তত্ত্ব এসে এটিকে হটিয়ে দিতে পারে কিংবা এটিই স্থায়ী ব্যাখ্যা হয়ে যেতে পারে।

প্রথম বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ এবং তারপর

চাঁদ নিয়ে নানা ধরনের কল্পকাহিনি প্রচলিত ছিল বহুকাল ধরে। ইতালীয় বিজ্ঞানী গালিলেও গালিলেই সর্বপ্রথম দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করে চাঁদ পর্যবেক্ষণ করেন। সময়টি ছিল ১৬০৯-১০ সাল। বলাই বাহুল্য, তাঁর দুরবিনটি আজকালকার টেলিস্কোপের মতো এত শক্তিশালী ছিল না। তিনি এটাকে টেলিস্কোপ নামও দেননি, নাম দিয়েছিলেন অপটিক টিউব। তিনি দেখতে পান, খালি চোখে যেমন দেখা যায়, চাঁদ মোটেই তেমন মসৃণ নয়। পাহাড়-পর্বত, উপত্যকা, খাদ, প্রচুর কালো দাগ ইত্যাদির দেখা পেয়েছিলেন তিনি। চাঁদও যে একসময় পৃথিবীর মতোই গলিত পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল এবং পর্যায়ক্রমে বর্তমান রূপ লাভ করেছে, তা বুঝতে তাঁর এতটুকু দেরি হয়নি।

১৬১০ সালে প্রকাশিত গালিলেও গালিলেইয়ের সিদেরুস নিনেইয়ুস গ্রন্থে চাঁদ সম্বন্ধে বলা হয়েছে, ‘চাঁদ পাহাড় ও খাদপূর্ণ একটা পৃথিবী। সেখানে যেমন ঘন অন্ধকার বিদ্যমান, তেমনি প্রখর আলোও বিদ্যমান।’ বোঝাই যাচ্ছে, তিনি চাঁদের দিন ও রাত দুটিই পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। গ্যালিলিও ধারণা করেছিলেন, চাঁদে পানি বা বায়ুমণ্ডল নেই। চাঁদের প্রথম মানচিত্রও তিনিই তৈরি করেছিলেন। তাঁর সময় থেকেই খালি চোখে দেখার পরিবর্তে দুরবিনের সাহায্যে চাঁদ দেখার রীতি প্রবর্তিত হয়। ইতালির পর ইংল্যান্ডেও দুরবিন আনা হয় ১৬১০ সালে।

গ্যালিলিওর সমসাময়িক কালে জার্মান জ্যোতির্বিদ ইয়োহানেস কেপলার তাঁর দ্য মিস্টিরিয়াস কসমস গ্রন্থে গ্রহ-উপগ্রহগুলোর গতি বর্ণনা করেন। তিনি ধারণা করেছিলেন, চাঁদে পানি ও বায়ুমণ্ডল—দুটিই থাকা সম্ভব। পৃথিবীতে জোয়ার-ভাটার জন্য যে চাঁদই দায়ী, তা-ও তিনিই প্রথম বলেছিলেন। গ্রহ-উপগ্রহের আবর্তন বা গতি নিয়ে তিনি যে তিনটি সূত্রের প্রবর্তন করেছিলেন, সেগুলো আজও পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা অতি গুরুত্বের সঙ্গে পাঠ করে থাকেন। এই তিন সূত্রের প্রথমটিতে তিনি বলেছিলেন, গ্রহ-উপগ্রহগুলো সূর্যকে কেন্দ্র করে উপবৃত্তকার পথে (বৃত্তাকার নয়) আবর্তিত হয়। দ্বিতীয় সূত্রটি খানিকটা গাণিতিক, যার অর্থ করলে দাঁড়ায়, গ্রহের গতিবেগে তারতম্য ঘটতে পারে, সূর্যের কাছে এলে গ্রহটি দ্রুত ঘোরে, দূরে গেলে একটু ধীরে ঘোরে। তৃতীয় সূত্রটি পুরোপুরিই গাণিতিক। ওটা নিয়ে আর কথা বললাম না।

সূর্যই যে সৌরজগতের কেন্দ্র—এ কথা অবশ্য কেপলারের শত বছর আগেই বলেছিলেন পোল্যান্ডের বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপার্নিকাস। তবে বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও সূত্র আসে কেপলারের কাছ থেকে। সৌরজগতের প্রতিটি বস্তু যে সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে, আর তা ঠিক ঘড়িসদৃশ একটা যন্ত্রের মতো নিয়মকানুন, সেটিও তিনি বলেছিলেন।

কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও ও কেপলারের পর মহাকাশবিদ্যায় নতুন মাত্রা যোগ করেছিল নিউটনের গতিসূত্র ও মহাকর্ষসূত্র। এসব সূত্রের মাধ্যমে আমরা অনেক কিছু জানতে পারলাম। এখন আমরা জানি, চাঁদে অভিকর্ষজ ত্বরণের মান (১.৯৩ মিটার/সেকেন্ড) পৃথিবীর অভিকর্ষজ ত্বরণের (৯.৮ মিটার/সেকেন্ড) প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ। এই অভিকর্ষজ ত্বরণই আপনার-আমার ও অন্য সব বস্তুর ওজন নির্ধারণ করে। আপনার ভরের সঙ্গে অভিকর্ষজ ত্বরণ গুণ করলে যে সংখ্যা পাওয়া যাবে, সেটিই আপনার ওজন। আর ওজন হলো একধরনের বল, যে বল দিয়ে পৃথিবী আপনাকে নিজের সঙ্গে আটকে রেখেছে। আপনি চাঁদে গেলেও আপনার ভর একই থাকবে, কিন্তু ওজন হয়ে যাবে পাঁচ ভাগের এক ভাগ (যেহেতু ওখানে অভিকর্ষজ ত্বরণের মান ওটাই), তার মানে আপনি নিজেকে অনেক হালকা বোধ করবেন। শুধু আপনিই নন, পৃথিবীর যেকোনো বস্তু বা যন্ত্র চাঁদে গেলে হালকা বোধ করবে। কারণ, তাদের ওজন কমে পাঁচ ভাগের এক ভাগ হয়ে যাবে।

চাঁদে অভিযানের ক্ষেত্রে এটিও এক বড় চ্যালেঞ্জ। আপনি পৃথিবীর ওজনে অভ্যস্ত, অথচ চাঁদে যাওয়ামাত্র আপনার ওজন কমে পাঁচ ভাগের এক ভাগ হয়ে যাবে। এত কম ওজনে তো আপনি অভ্যস্ত নন, চট করে হতেও পারবেন না, তাহলে ভারসাম্য রাখবেন কী করে? মানুষ না হয় ব্যাপারটা বুঝবে, কিন্তু একটা যন্ত্র ভারসাম্য রক্ষা করবে কীভাবে? সম্ভবত এ কারণেই চাঁদে পাঠানো অধিকাংশ যন্ত্রই মুখ থুবড়ে পড়ে বা উল্টে যায়।

বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ এবং হিসাব-নিকাশের সাহায্যে আমরা এখন চাঁদ সম্বন্ধে অনেক কিছু জানি। একনজরে সে রকম কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক। পৃথিবী থেকে চাঁদের গড় দূরত্ব হচ্ছে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার (পৃথিবীর ব্যাসের ৩০ গুণ)। গড় দূরত্ব বলা হলো, কারণ দূরত্ব সব সময় এক থাকে না। চাঁদ যখন পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে চলে আসে, তখন দূরত্ব হয় প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার। সেই চাঁদকে আমরা ডাকি সুপারমুন বলে। এই সময় চাঁদকে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ১৪ শতাংশ বড় এবং ৩০ শতাংশ উজ্জ্বল দেখায়। আবার পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরে থাকার সময় দূরত্ব হয় প্রায় ৪ লাখ ৫ হাজার ৫০০ কিলোমিটার। চাঁদের ব্যাস ৩ হাজার ৪৭৫ কিলোমিটার (পৃথিবীর ব্যাসের এক-চতুর্থাংশের চেয়ে সামান্য বেশি), যা অন্যান্য গ্রহের চাঁদগুলোর চেয়ে বেশ বড় এবং সংগত কারণেই পৃথিবীর ওপর এর প্রভাব বেশ প্রবল। চাঁদের আয়তন পৃথিবীর আয়তনের ৫০ ভাগের ১ ভাগ, ক্ষেত্রফল পৃথিবীর ১৬ ভাগের ১ ভাগ এবং ভর পৃথিবীর ভরের ৮১ ভাগের ১ ভাগ। চাঁদের ঘনত্ব পানির চেয়ে ৩ হাজার ৩৪২ গুণ বেশি, অন্যদিকে পৃথিবীর ঘনত্ব পানির চেয়ে ৫ হাজার ৫৬০ গুণ বেশি। অর্থাৎ চাঁদ পৃথিবীর চেয়ে কম ঘনত্বের বস্তু দিয়ে তৈরি। গতি প্রতি ঘণ্টায় ৩ হাজার ৬৮০ কিলোমিটার। এটি প্রতি ২৭ দশমিক ৩২ দিনে পৃথিবীর চারদিকে একটি পূর্ণ আবর্তন সম্পন্ন করে। প্রতি ২৯ দশমিক ৫ দিন পরপর চন্দ্রকলা ফিরে আসে, অর্থাৎ একই কার্যক্রম আবার ঘটে।

জোয়ার-ভাটা ও গ্রহণের রহস্য

আমরা যে পূর্ণিমা-অমাবস্যা দেখতে পাই, কৃষ্ণপক্ষ-শুক্লপক্ষ দেখি, চন্দ্রগ্রহণ-সূর্যগ্রহণ দেখি, নদী ও সাগরে জোয়ার-ভাটা দেখি—এসবই ঘটে চাঁদের গতি ও আবর্তনের কারণে। পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে, যাকে বলা হয় বার্ষিক গতি; একই সঙ্গে নিজের চারপাশেও ঘুরপাক খাচ্ছে, যার নাম আহ্নিক গতি। চাঁদও তেমন করে ঘুরে বেড়াচ্ছে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে, একই সঙ্গে নিজের চারপাশেও ঘুরপাক খাচ্ছে। পৃথিবীর এই গতির ফলাফল আমরা সহজেই বুঝতে পারি। নিজ অক্ষের চারপাশে ঘূর্ণনের ফলে দিন-রাত হয় আর সূর্যের চারপাশে উপবৃত্তকার পথে ঘুরে আসে বলে ঋতু পরিবর্তন হয়। পৃথিবীকে একটা গোলাকার বস্তু হিসেবে কল্পনা করুন, যেটি লাটিমের মতো ঘুরছে। আপনি এখন সেই বস্তুর যে পাশে আছেন, সেটি যদি সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে, তাহলে আপনি দিনের আলোয় উদ্ভাসিত হচ্ছেন। কিন্তু সে তো ঘূর্ণমান, ফলে আপনার অবস্থানের পাশটি একই স্থানে থাকবে না, ঘুরতে ঘুরতে সূর্যের ঠিক বিপরীত দিকে চলে যাবে, আর আপনি রাতের দেখা পাবেন। এই দুই সময়ের মধ্যবর্তী সময়গুলোর (সকাল-দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যা ইত্যাদি) সঙ্গেও আপনার দেখা হবে একইভাবে। এই ঘটনা ঘটে আহ্নিক গতির ফলে।

অন্যদিকে বার্ষিক গতির ফলে ঋতু পরিবর্তন হয় এভাবে: সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার সময় পৃথিবীটা সূর্যের দিকে একটু হেলে থাকে। সে জন্য কখনো উত্তর গোলার্ধ সূর্যের একটু বেশি নিকটবর্তী হয়, কখনোবা দক্ষিণ গোলার্ধ। যখন যে গোলার্ধ সূর্যের বেশি নিকটবর্তী থাকে, তখন সেই গোলার্ধে গ্রীষ্মকাল; অন্য গোলার্ধে তখন সংগত কারণেই শীতকাল, কারণ সেটি তখন সূর্য থেকে দূরে আছে। বাংলাদেশ উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত। আমাদের এখানে গ্রীষ্মকাল শুরু হলো, তার মানে দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোয় (যেমন অস্ট্রেলিয়া, লাতিন আমেরিকা প্রভৃতি) শুরু হলো শীতকাল।

পৃথিবীর গতি আর ঘূর্ণন তো বোঝা গেল; চাঁদের ব্যাপারটা কী? চাঁদ পশ্চিম থেকে পুব দিকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। এতে তার সময় লাগে ২৭ দিন ৭ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট। চাঁদ এমনভাবে ঘোরে যে আমরা তার একটি পাশকেই সব সময় দেখতে পাই, অন্য পাশটা রয়ে যায় অন্তরালে। পৃথিবীই বলুন আর চাঁদই বলুন, দুটিই আলোকিত হয় সূর্যের আলো দিয়ে। কিন্তু সূর্য কখনোই পৃথিবী বা চাঁদের দুপাশকেই একই সঙ্গে আলোকিত করতে পারে না। এক পাশ যদি আলোকিত থাকে, অন্য পাশে তখন অন্ধকার থাকবে। তো, এ রকম একটা সময় আসে, যখন চাঁদের সেই পাশ আলোকিত, যেটি আমরা দেখতে পাই, একই সঙ্গে আমরা পৃথিবীর যে পাশে আছি, সে পাশে তখন অন্ধকার, মানে রাত। তখন আমরা পূর্ণিমার দেখা পাই।

উল্টো ঘটনা ঘটে অমাবস্যার ক্ষেত্রে। অর্থাৎ চাঁদের যে পাশ আমার দেখতে পাই না, সেই পাশ তখন আলোকিত, আমাদের দিকে মুখ করে থাকা অংশটিতে অন্ধকার। পূর্ণিমা বা অমাবস্যা অবশ্য এক দিন পরপর হয় না, তা তো আমরা জানি। কৃষ্ণপক্ষ থেকে চাঁদ যখন বেরিয়ে আসে, অর্থাৎ চাঁদের যেদিক আমরা দেখতে পাই, সেদিকে যখন সামান্য আলো পড়ে, তখন এ পাশে শুক্লপক্ষ শুরু হয়। ধীরে ধীরে সেটি পূর্ণিমায় গিয়ে পৌঁছায়।

চাঁদ, পৃথিবীসহ অন্য গ্রহ-উপগ্রহগুলো সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আমরা জানি। ‘কীভাবে’ বিরামহীন ঘুরছে, কীভাবে ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে, কেন ওগুলো মহাশূন্যে ছিটকে পড়ে যাচ্ছে না বা সূর্যের মহাকর্ষিক আকর্ষণে সূর্যের ভেতরে গিয়ে পড়ছে না, তা-ও জানি। কিন্তু জানি না, ওরা ‘কেন’ ঘুরছে? একটা সৌরজগৎ তৈরি হওয়ার কী দরকার ছিল, নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে গ্রহগুলোর ঘুরে বেড়ানোর কী দরকার ছিল, সূর্য বা নক্ষত্র এবং গ্রহ বা উপগ্রহগুলো স্বাধীনভাবে চলাফেরা করলেইবা কী ক্ষতি হতো, তা জানি না। এসব প্রশ্ন যে বিজ্ঞানীদের মনে আসে না, তা নয়; কিন্তু সচরাচর সামনে আনেন না। কারণ, উত্তর খুঁজতে গেলে পদার্থবিজ্ঞানের এলাকা ছেড়ে অধিবিদ্যার এলাকায় ঢুকে পড়ার ঝুঁকি আছে। পদার্থবিজ্ঞানীরা অধিবিদ্যা থেকে শত হাত দূরে থাকেন।

যাহোক, গ্রহণের ব্যাপারটা কীভাবে ঘটে, সেটি একটু বলি। সূর্য থাকে কেন্দ্রে। পৃথিবী ও চাঁদ দুজনেই ঘুরছে। যখন ঘুরতে ঘুরতে কোনো এক সময় পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে চাঁদ এসে পড়ে, অর্থাৎ চাঁদ এসে সূর্যকে ঢেকে দেয় পৃথিবীর কাছ থেকে, তখন সূর্যগ্রহণ ঘটে। এটা সাধারণত ঘটে নতুন চাঁদের বেলায়। আর যদি চাঁদ ও সূর্যের মাঝখানে পৃথিবী এসে পড়ে, তখন হয় চন্দ্রগ্রহণ। এটি ঘটে পূর্ণিমায়। পরের ঘটনাটিই বেশি ঘটে এবং পৃথিবীর বহু জায়গা থেকে দেখা যায়। সূর্যগ্রহণ কিন্তু খুব বেশি অঞ্চলজুড়ে দেখা যায় না। মোটামুটি ১৭০ মাইলজুড়ে সূর্যগ্রহণ দৃশ্যমান হয়। মোটের ওপর চাঁদ তো পৃথিবীর তুলনায় অনেক ছোট, সূর্যকে আড়াল করে দাঁড়ালে কতটুকুই-বা আর পারবে?

অন্যদিকে জোয়ার-ভাটা হয় চাঁদের মহাকর্ষিক আকর্ষণের কারণে। শুধু চাঁদই কি ও রকম আকর্ষণ করে? সূর্য বা অন্য গ্রহগুলো কি করে না? করে, সবাই করে। কিন্তু চাঁদ পৃথিবীর খুব কাছে বলে আকর্ষণের ব্যাপারটা বেশ জোরালো হয়। পৃথিবীর বিস্তীর্ণ সাগরাঞ্চলে চাঁদের আকর্ষণের জন্য পানির স্ফীতি দেখা দেয়। কেবল সাগরের পানিই স্ফীত হয় না; নদী, খাল, বিল, এমনকি পুকুরের পানিও স্ফীত হয়, কিন্তু তা এতই কম যে খালি চোখে দেখাই যায় না। এমনকি পৃথিবীর স্থলভাগও প্রায় চার ইঞ্চি স্ফীত হয়। কিন্তু পৃথিবীর আকার-আয়তনের তুলনায় তা এত সামান্য যে ওটাও চোখেই পড়ে না।

চাঁদের এই আকর্ষণের জন্য পৃথিবীর ঘূর্ণন সামান্য হলেও ধীরগতির হয়ে যাচ্ছে এবং প্রতি ১০০ বছরে আমাদের দিনের দৈর্ঘ্য এক মিলিসেকেন্ড করে বেড়ে যাচ্ছে। এই গতিহ্রাসের কারণে পৃথিবী যে শক্তি হারাচ্ছে, তা চাঁদ গ্রহণ করে পৃথিবী থেকে প্রতি বছর দেড় ইঞ্চি করে দূরে সরে যাচ্ছে। এসব ব্যাপার এত সূক্ষ্ম যে উন্নত মানের যন্ত্রপাতি ছাড়া ধরাই পড়ে না।

চাঁদে অভিযানের আগে

চাঁদে অভিযানের আগেই শুরু হয়েছিল মানুষের মহাকাশযাত্রার অভিযান। ১৯৫৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানোর ঘোষণা দেয়। তখন শীতল স্নায়ুযুদ্ধের কাল, দুই পরাশক্তিই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চায়। এর পেছনে যতটা না বিজ্ঞানতৃষ্ণা, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক মতাদর্শের লড়াই। কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন চায় সারা বিশ্বে কমিউনিজমের মহিমা প্রতিষ্ঠা, পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশসহ লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ায়ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রসার বাড়ছে। অন্যদিকে পুঁজিবাদী যুক্তরাষ্ট্র চায় কমিউনিজম ঠেকাতে, চায় পুঁজিবাদের সর্বব্যাপী প্লাবন। সমাজতন্ত্রবিরোধী অবস্থান নিলে একনায়কতন্ত্র বা সামরিকতন্ত্র—কোনোটিতেই তাদের আপত্তি নেই।

দুই মতাদর্শই বিশ্বব্যাপী কায়েম করার ব্যাপার ছিল বলে লড়াইটা ছিল মনস্তাত্ত্বিকও। কেবল অস্ত্রের ভয় বা শক্তিমত্তা দেখিয়ে তো পৃথিবীর মানুষকে বশ করে রাখা যায় না। তাহলে এমন কী করা যায়, যা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, সবাইকে অভিভূত করে দেবে? বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চোখধাঁধানো সাফল্যই হতে পারে সেই অস্ত্র, যা অন্য জাতিকে মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করবে। তখন আপেক্ষিকতা তত্ত্ব আর কোয়ান্টাম মেকানিকসের জয়জয়কার চলছে, কিন্তু সাধারণ মানুষ তো ওসব বোঝে না। সেসব দিয়ে রাজনীতিবিদদের ফায়দা নেই। এমন কিছু করা দরকার, যা হবে দেখনদারি, যা দেখিয়ে মানুষকে চমৎকৃত করা যাবে। চিররহস্যময় মহাকাশে যাত্রা করতে পারলে সেটিই হবে দারুণ এক বাজিমাত। অতএব দুদেশেই বিরাট কর্মযজ্ঞ শুরু হলো। বিজ্ঞানীরা দুই পরাশক্তির এই লড়াইকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করলেন। রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে শুরু হলো মহাকাশ গবেষণার নতুন যুগ।

১৯৫৭ সালের মার্চ মাসে দুই দেশ ঘোষণা দিয়েছিল মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানোর। অক্টোবরের ৪ তারিখে মার্কিনদের টেক্কা দিয়ে সোভিয়েতরা ৮৩ কেজি ওজনের স্পুতনিক-১ উপগ্রহটি আকাশে উৎক্ষেপণ করে এবং সেটি পৃথিবীর কক্ষপথে গিয়ে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। স্পুতনিকে দুটি রেডিও ট্রান্সমিটার ছিল, যেগুলো নিয়মিত বিরতিতে সিগন্যাল পাঠাত, আর তা পৃথিবীর যেকোনো রেডিওতে ধরা পড়ত। মার্কিনরা খালি চোখেই উপগ্রহটি দেখতে পেত এবং রেডিও সিগন্যাল ধরতে পারত।

সোভিয়েত ইউনিয়নের এই অপ্রত্যাশিত অসাধ্যসাধন মার্কিনদের জন্য দারুণ পীড়াদায়ক ও আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াল। তারা মনে করতে লাগল, তারা ইচ্ছা করলেই নিমেষে নিউক্লিয়ার-অস্ত্র ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দিতে পারে! তাদের সেই আতঙ্কের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘স্পুতনিক ক্রাইসিস’। শুধু তা-ই নয়, শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে তৃতীয় বিশ্বের কাছেও সোভিয়েত ইউনিয়ন এগিয়ে গেল যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে। মার্কিনদের জন্য সেটা বিরাট মনোবেদনার কারণ হলো। যাহোক, স্পুতনিক-১-কে পৃথিবীতে অক্ষত ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। ফেরার পথে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে সেটি বিস্ফোরিত হয়। দিনটি ছিল ৩ জানুয়ারি ১৯৫৮।

তবে সোভিয়েতরা ওটাকে ফিরিয়ে আনা পর্যন্ত বসে থাকেনি। স্পুতনিক-১ উৎক্ষেপণের চার সপ্তাহ পর, ওই একই বছরে, অর্থাৎ ১৯৫৭ সালের ৩ নভেম্বর স্পুতনিক-২ উৎক্ষেপণ। সেই নভোযানে প্রথম তারা একটি জীবিত প্রাণী পাঠায়। প্রাণীটি ছিল একটি কুকুর। নাম লাইকা। আলবিনা ও মুশকা নামে আরও দুটি কুকুরকেও লাইকার সঙ্গে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, যেন তারা মহাশূন্যে যাত্রার জন্য উপযোগী হয়ে উঠতে পারে, যদিও শেষ পর্যন্ত কেবল লাইকাকেই পাঠানো হয়। সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ বিপ্লবের ৪০তম বার্ষিকীটি স্মরণীয় করে রাখার জন্য এই বিশেষ অভিযানের পরিকল্পনা করেন।

বিজ্ঞানীদের হাতে সময় ছিল খুবই কম, মাত্র চার সপ্তাহের মধ্যে মহাশূন্যে জীবিত প্রাণী পাঠানোর মতো উন্নত যান তৈরি করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু রাজনীতিবিদেরা কবেইবা এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন? তাঁদের ইচ্ছাই শেষ কথা। যাহোক, লাইকার জীবনে ভাগ্যবিপর্যয় নেমে এল। কারণ, প্রশিক্ষণটি ছিল অতিশয় যন্ত্রণাদায়ক। স্পুতনিকের কেবিনটি বড় ছিল না। কুকুরটির যেন ছোট জায়গায় থাকার অভ্যাস গড়ে ওঠে, সে জন্য তাকে পৃথিবীতে ওই কেবিনের চেয়েও ছোট একটি জায়গায় রাখা হয়েছিল। রকেটের প্রচণ্ড শব্দে যেন লাইকা স্বাভাবিক থাকে, সে জন্য ও রকম শব্দে ওকে অভ্যস্ত করে তোলা হয়। কেবিনে ঘুরে দাঁড়ানোর জায়গা ছিল না বলে ওকে ঘোড়ার মতো লাগাম পরিয়ে রাখা হতো। প্রশিক্ষণের অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কারণে লাইকার মলমূত্র ত্যাগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই তাকে ওষুধ খাওয়ানো হতো। খাদ্য হিসেবে দেওয়া হতো জেলির মতো কৃত্রিম খাবার। ওকে ফিরিয়ে আনার কোনো পরিকল্পনাও ছিল না। অবশেষে সাত দিনের অক্সিজেন আর কৃত্রিম খাবার দিয়ে লাইকাসহ স্পুতনিক-২ উড়াল দিল মহাশূন্যে।

সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ সে সময় বিশ্ববাসীকে জানিয়েছিল যে লাইকা সাত দিন বেঁচে ছিল এবং অক্সিজেন ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই তাকে মেরে ফেলা হয়। ঘটনা আসলে তা নয়। প্রায় ৪৫ বছর পর আসল সত্য প্রকাশিত হয়। উৎক্ষেপণের কয়েক ঘণ্টা পরই স্পুতনিকের তাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে। তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় লাইকার অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু হয়। সত্যি বলতে কি, মহাশূন্যযাত্রী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত লাইকার জীবন কাটে ভয়াবহ যন্ত্রণায়। তার চেয়ে বড় কথা, স্পুতনিকের অচেনা পরিবেশে, রকেটের উৎকট শব্দে এবং অবিশ্বাস্য গতি লাইকাকে এক অবর্ণনীয় পরিস্থিতির মধ্যে রেখেছিল।

১৯৫৮ সালের ১৪ এপ্রিল, পৃথিবীতে ফেরার সময় বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে প্রথম নভোযানটির মতোই স্পুতনিক-২ বিস্ফোরিত হয়। ভস্মীভূত হয়ে যায় লাইকার প্রাণহীন দেহ। প্রিয় পাঠক, মহাকাশ গবেষণার জন্য যদি গৌরব বোধ করে থাকেন, তাহলে লাইকার অন্তত দুফোঁটা অশ্রু প্রাপ্য। কারণ, মানুষের মহাকাশ জয়ের স্বপ্ন-সাধ-বাসনা পূরণ করার জন্য লাইকাই প্রথম প্রাণী হিসেবে প্রাণ দিয়েছিল।

পরপর দুটি সফল উৎক্ষেপণের ফলে সোভিয়েতরা বেশ এগিয়ে যায়। এদিকে মার্কিনদের পরপর কয়েকটি চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১৯৫৮ সালে ১ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ এক্সপ্লোরার-১ উৎক্ষেপণ করে। দুই দেশের প্রতিযোগিতা চলতেই থাকে। এই প্রতিযোগিতার নামই হয়ে যায় ‘স্পেসরেস’।

১৯৬১ সালে আবার সোভিয়েতরা আরেকটি বিষয়ে ‘প্রথম’ হয়। ভস্তক-১ নামের মহাকাশযানে চড়ে প্রথমবারে মতো কোনো মানুষ মহাশূন্যে যাত্রা করেন। প্রথম সেই নভোযাত্রী ছিলেন সোভিয়েত নাগরিক ইউরি গাগারিন, বয়স ২৭ বছর। দিনটি ছিল ১২ এপ্রিল ১৯৬১। প্রায় ১০৮ মিনিট ধরে পৃথিবীর কক্ষপথে একবার চক্কর দিয়ে সশরীর ফিরে আসেন পৃথিবীতে।

একই বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম মহাকাশচারী অ্যালান শেফার্ড যাত্রা করেন। তবে তিনি পৃথিবীর কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করেননি। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মনুষ্যবাহী মার্কিন মহাকাশযান ফ্রেন্ডশিপ-৭ তিনবার পৃথিবীর কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করে। সেটিই তাদের শুরু। ১৯৬৩ সালের মে মাস পর্যন্ত তারা ছয়বার মহাকাশযান পাঠায়। সেগুলো মোট ৩৪ বার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে। মহাকাশে সময় কাটায় মোট ৫১ ঘণ্টা।

লড়াই বেশ ভালোভাবেই জমে উঠেছিল। তারই অংশ হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৬৩ সালের ১৬ জুন ভস্তক-৬ মহাকাশযানে প্রথম নারী মহাকাশচারী ভালেন্তিনা তেরেশকোভাকে মহাশূন্যে পাঠায়। ১৯৬৫ সালের ৮ মার্চ ভস্খদ-২ নভোযান থেকে বেরিয়ে আলেক্সি লেওনভ কিছুক্ষণ মহাশূন্যে ভেসে বেড়ান। তার আগেই অবশ্য চাঁদে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে।

১২ সেপ্টেম্বর ১৯৫৯, সোভিয়েত ইউনিয়নের মনুষ্যবিহীন মহাকাশযান লুনার-২ চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছায়। এখানেও সোভিয়েত ইউনিয়নই প্রথম। সংগত কারণেই সোভিয়েতের এই অব্যাহত জয় প্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিনদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। স্পেসরেস পায় নতুন মাত্রা!

চাঁদে মানুষের পদচিহ্ন

মহাকাশ অভিযানে সোভিয়েত ইউনিয়নের অব্যাহত সাফল্য যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে গভীর উৎকণ্ঠা, আতঙ্ক, অপমান ও মনোবেদনার সৃষ্টি করে। সোভিয়েতের কাছে তারা হেরে যাচ্ছে—এই অনুচ্চারিত দুঃখবোধকে ভাষা দেন নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। ১৯৬১ সালের ২৫ মে কংগ্রেসের এক যৌথ অধিবেশনে তিনি ঘোষণা দেন, এই দশকের মধ্যেই চাঁদে মানুষ পাঠিয়ে তাঁদের আবার নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার প্রকল্প নিতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৬৩ সালে কেনেডি হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তিনি দেখে যেতে পারেননি, সত্যি সত্যি দশক শেষ হওয়ার আগেই ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই তাঁর দেশের অসমসাহসী তিনজন মহাকাশচারী চাঁদে পৌঁছেছিলেন। ফিরেও এসেছিলেন নিরাপদেই।

চাঁদে মানুষের এই পদচিহ্ন আঁকতে পারার ঘটনা এক দিনে ঘটেনি। অন্তত এক দশক ধরে দুই দেশ তাদের অব্যাহত চেষ্টার সুফল পায় ১৯৬৯ সালে এসে। সেই ইতিহাস সংক্ষেপে একবার দেখে আসা যাক। বলা বাহুল্য, এই এক দশকের ইতিহাস কেবল সাফল্যেরই নয়, প্রচুর ব্যর্থতারও।

আগেই বলেছি, ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৫৯, সোভিয়েত ইউনিয়নের মনুষ্যবিহীন মহাকাশযান লুনা-২ চাঁদে পৌঁছেছিল। এর আগে তাদের অন্তত চারটি মিশন ব্যর্থ হয়। লুনা-১ মিশনটি আংশিকভাবে সফল হয়। আংশিক সফলতার মানে হলো নভোযানটি মুক্তিবেগ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। মহাকাশ অভিযানের অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের একটি হলো সফল উৎক্ষেপণ। সোভিয়েতের চন্দ্রাভিযানের প্রথম চারটি মিশনই সফল উৎক্ষেপণে ব্যর্থ হয়। আরেকটি চ্যালেঞ্জ ছিল পৃথিবীর মহাকর্ষিক আকর্ষণের বন্ধন পেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতি সেকেন্ডে ন্যূনতম ১২ কিলোমিটার বেগ অর্জন করা। এটিই মুক্তিবেগ। নভোযানের ভর যত বেশি, তার ওপর পৃথিবীর মহাকর্ষিক আকর্ষণ তত বেশি, সেই আকর্ষণ অতিক্রম করে মুক্তিবেগ অর্জন করা তত কঠিন।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৯৫৭ সালে স্পুতনিক-১ নামে প্রথম যে নভোযান পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছেছিল, সেটির ভর ছিল মাত্র ৮৩ কেজি। আর মনুষ্যবাহী অ্যাপোলো-১১ নামে যে নভোযান চাঁদে পৌঁছেছিল, সেটির ছিল দুটি অংশ। একটি সার্ভিস মডিউল, নাম কলাম্বিয়া। সেটির ভর ছিল ২৩ হাজার ২৪৩ কেজি। আরেকটি লুনার মডিউল, নাম ইগল। সেটির ভর ছিল ১৫ হাজার ৯৫ কেজি। সার্ভিস মডিউলের কাজ ছিল লুনার মডিউল, নভোযাত্রী ইত্যাদি বহন করে নিয়ে যাওয়া; আর লুনার মডিউলের কাজ ছিল চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছানোর পর মূল সার্ভিস মডিউল থেকে আলাদা হয়ে চাঁদে অবতরণ করা। পৃথিবী থেকে উৎক্ষেপণের সময় কিন্তু এই দুই মডিউল জোড় বেঁধেই গিয়েছে। তাই এর মোট ভর ছিল ৩৮ হাজার ৩৩৮ কেজি। হ্যাঁ, এটাই ছিল অ্যাপোলো-১১-র ভর। স্পুতনিকের ৮৩ কেজির তুলনায় অ্যাপোলো-১১-র এত ভর ভাবা যায়? এ রকম ভারী নভোযানের ওপর পৃথিবীর আকর্ষণ বল অত্যন্ত বেশি হবে, তা তো বোধগম্যই। সে জন্য উৎক্ষেপণের মুক্তিবেগ অর্জন করতে এটিকে অনেক বেশি পরিমাণ শক্তি ও জ্বালানি ব্যয় করতে হবে।

সোভিয়েতের মনুষ্যবিহীন নভোযান লুনা-২ সফলভাবে চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছানোর পর কিছু ছবি তুলে পাঠায়। একই বছর একটা চমকপ্রদ ঘটনা ঘটায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। লুনা-৩ নামে তাদের পাঠানো আরেকটি নভোযান চাঁদের অন্য পিঠ ঘুরে আসে। আমরা সব সময় চাঁদের একটা পিঠই দেখি, সে কথা আগেই বলেছি। অন্য পিঠে কী আছে, তার কিছুই জানি না। লুনা-৩ সেই চির-না-দেখা অন্য পিঠের অনেকগুলো ছবি তুলে এনেছিল প্রথমবারের মতো।

পরপর দুটি মনুষ্যবিহীন নভোযানের সফল চন্দ্রাভিযানের পর ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তত ১৩টি মিশন ব্যর্থ হয়েছিল। কোনোটা উৎক্ষেপণই তারা করতে পারেনি, কোনোটা উৎক্ষেপণের পরপরই বিধ্বস্ত হয়েছে, কোনোটা পৃথিবীর কক্ষপথ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি, কোনোটা চাঁদের কাছে গিয়ে ঘুরে এলেও অবতরণ করতে পারেনি।

এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র মোটেই থাকেনি। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তারা মোট ১৮টি অভিযান পরিচালনা করে। একটা কথা বলা হয়নি, সব কটি অভিযানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কিন্তু এক ছিল না। কোনোটির উদ্দেশ্য ছিল চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছানো, কোনোটির ছিল চাঁদের কাছ দিয়ে ঘুরে আসা, কোনোটির ছিল চাঁদে সহজ অবতরণ, কোনোটির ক্র্যাশ ল্যান্ডিং। ক্র্যাশ ল্যান্ডিং কোনো দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত ছিল। উদ্দেশ্য সফল না হলে সেই মিশনকে ব্যর্থ বলে ধরে নেওয়া হয়। বলা প্রয়োজন, যে নভোযান যায়, সেটি অবতরণও করে না, ক্র্যাশও করে না। মূল সার্ভিস মডিউলটি বহন করে নিয়ে যায় ছোট আকারের একটা যান, সহজ ভাষায় যেটিকে ল্যান্ডার বলা হয়। ওটাই অবতরণের জন্য পাঠানো হয় বা ক্র্যাশ করা হয়, মূলটি রয়ে যায় কক্ষপথে এবং পরে পৃথিবীতে ফিরে আসে। অ্যাপোলো-১১-র সার্ভিস মডিউল কলাম্বিয়া ফিরে এসেছিল তিন অভিযাত্রীকে নিয়ে। লুনার মডিউল ইগলের একটা অংশ ফেলে আসা হয়েছিল চাঁদের মাটিতে, অন্য অংশ চাঁদের কক্ষপথে।

যাহোক, যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম চারটি মিশন ব্যর্থ হয়, পঞ্চম মিশন পাইওনিয়ার-৪ আংশিকভাবে সফল হয়, অর্থাৎ মুক্তিবেগ অর্জন করতে সক্ষম হয়। এরপরের সাতটি মিশন ব্যর্থ হয়। রেঞ্জার-৪ নামে নভোযানের ত্রয়োদশ মিশনটি আংশিকভাবে সফল হয়। এই মিশনের লক্ষ্য ছিল চাঁদে সহজ অবতরণ। চাঁদ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেও অবতরণ করতে গিয়ে সেটি ধ্বংস হয়ে যায়। সেটি এমনকি কোনো ছবিও পাঠাতে পারেনি। এরপর আরও দুটি মিশন ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতা কাটিয়ে ১৯৬৪-৬৫ সালে—রেঞ্জার-৭, রেঞ্জার-৮ ও রেঞ্জার-৯—পরপর তিনটি মিশনে সাফল্য নিয়ে আসে তারা। তিনটিরই লক্ষ্য ছিল ক্র্যাশ ল্যান্ডিং। সেটি করতে তারা সক্ষম হয়। তবে তার আগে নভোযানগুলো চাঁদের প্রায় ১৭ হাজার ছবি তুলে পাঠায়।

প্রায় একই সময়ে, ১৯৬৫-৬৬ সালে, সোভিয়েত ইউনিয়নের দুটি নভোযান লুনা-৯ ও লুনা-১৩ চাঁদে সফল অবতরণ করে প্রচুর ছবি পাঠাতে সক্ষম হয়। এরপর তাদের পরপর ছয়টি মিশন ব্যর্থ হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন কখনোই মনুষ্যবাহী নভোযান চাঁদে পাঠানোর প্রকল্প হাতে নেয়নি। তবে মনুষ্যবিহীন যানের সফল অবতরণ, চাঁদের মাটির নমুনা তুলে আনা কিংবা চন্দ্রপৃষ্ঠে চলাচল করার প্রকল্প তারা নিয়েছিল। ১৯৭০ সালে লুনা-১৬ মিশনের লক্ষ্য ছিল চাঁদ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা। নভোযানটি প্রায় ১০০ গ্রাম নমুনা নিয়ে ফিরে আসে।

একই বছর লুনা-১৭ মিশনের লক্ষ্য ছিল চন্দ্রপৃষ্ঠে চলাচল করা। ছোট্ট সুন্দর লুনার রোভারটি চন্দ্রপৃষ্ঠে প্রায় ১০ দশমিক ৫ কিলোমিটার দৌড়ে বেড়াতে সক্ষম হয়। একইভাবে ১৯৭৩ সালে লুনা-২১ মিশনের রোভারটি চন্দ্রপৃষ্ঠে দৌড়ে যায় প্রায় ৩৭ কিলোমিটার পর্যন্ত। অন্যদিকে ১৯৭২ ও ১৯৭৬ সালে যথাক্রমে লুনা-২০ ও লুনা-২৪ মিশন তাদের লক্ষ্য অনুযায়ী চাঁদের মাটি নিয়ে পৃথিবীতে ফেরত আসে। ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালে অবশ্য তাদেরও দুটি মিশন ব্যর্থ হয়েছিল। ১৯৭৬ সালের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশ গবেষণা অব্যাহত রাখলেও চাঁদে অভিযান বন্ধ করে দেয়। তত দিনে আবার মার্কিন চন্দ্রযান অ্যাপোলো-১১ মানুষ নিয়ে চাঁদ থেকে ঘুরে পৃথিবীতে ফিরে এসেছে।

১৯৬৯ সালে অ্যাপোলো-১১ অভিযানের আগে ১৯৬৬-৬৮ সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র চাঁদে সাতটি অভিযান পরিচালনা করে। এর সব কটিই ছিল মানুষ যাওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি। সংগত কারণেই সব কটি মিশনের লক্ষ্য ছিল চাঁদের বিভিন্ন অঞ্চলে সহজ অবতরণ। এই সাতটির মধ্যে পাঁচটি মিশন সফল হয়, দুটি ব্যর্থ। অর্থাৎ সফলতার হার বাড়তে থাকে।

অবশেষে ১৯৬৯ সালের ১৬ জুলাই তিন নভোযাত্রী মাইকেল কলিন্স, বাজ অলড্রিন ও নিল আর্মস্ট্রংকে নিয়ে অ্যাপোলো-১১ মিশনের নভোযান কলাম্বিয়া যাত্রা শুরু করে। এই স্বপ্নের দিনটিকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে এর আগে আট বছর ধরে সাতটি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল। পুরো প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন প্রায় চার লাখ বিজ্ঞানী-প্রকৌশলী-টেকনিশিয়ান, খরচ হয়েছিল প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার (এখনকার হিসাবে সেটি প্রায় ২৫০ বিলিয়ন ডলার)! অ্যাপোলো মিশনের লক্ষ্যই ছিল মানুষকে চাঁদে পাঠানো। চূড়ান্ত উৎক্ষেপণের আগে ধাপে ধাপে চলছিল প্রস্তুতি। কিন্তু একেবারে শুরুতেই একটা ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে।

সেটি ছিল অ্যাপোলো-১ মিশন। নভোযানে চড়ে পৃথিবীর কক্ষপথ পরীক্ষা করার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন তিন নভোচারী—এডওয়ার্ড হোয়াইট, রজার শেফি ও ভার্জিল গ্রিমস। কিন্তু উৎক্ষেপণের সময় একটা বৈদ্যুতিক গোলযোগ ঘটে রকেটে আগুন ধরে যায়। মুহূর্তের মধ্যে ভস্মীভূত হয়ে যান তিন সম্ভাব্য নভোচারী। মানুষের মহাকাশ জয়ের স্বপ্ন পূরণের জন্য প্রথম পর্যায়ে প্রাণ দিয়েছিল লাইকা নামের এক কুকুর, আর চাঁদ জয়ের জন্য প্রথম প্রাণ দেন এই তিন নভোচারী।

যাহোক, অ্যাপোলো-১১ নভোযানেরও যথারীতি দুটি অংশ ছিল। একটি কমান্ড মডিউল, কলাম্বিয়া, যার পাইলট ছিলেন মাইকেল কলিন্স; অন্যটি লুনার মডিউল, ল্যান্ডার ইগল, যার পাইলট ছিলেন বাজ অলড্রিন। আর এই পুরো অভিযানের কমান্ডার ছিলেন নিল আর্মস্ট্রং। এই নভোযানকে পৃথিবীর কক্ষপথ পর্যন্ত বহন করে নিয়ে যায় স্যাটার্ন ফাইভ রকেট। প্রায় তিন ঘণ্টা পর নভোযানটি রকেট থেকে আলাদা হয়ে যাত্রা শুরু করে। ১৯৬৯ সালের ১৯ জুলাই তাঁরা চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছান। পরদিন ২০ জুলাই অভিযানের কমান্ডার নিল আর্মস্ট্রং এবং লুনার মডিউলের পাইলট বাজ অলড্রিন কলাম্বিয়া থেকে বেরিয়ে ইগলে চড়ে বসেন এবং চাঁদে অবতরণের জন্য রওনা দেন। কমান্ড মডিউলের পাইলট মাইকেল কলিন্স রয়ে যান কলাম্বিয়াতেই। প্রদক্ষিণ করতে থাকেন চাঁদের কক্ষপথ।

চাঁদের দিকে রওনা হওয়ার ঘণ্টা তিনেক পর চাঁদের মাটিতে অবতরণ করেন আর্মস্ট্রং ও অলড্রিন। যত সহজে বলা হলো, ব্যাপারটা তত সহজ ছিল না। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মহাবিপদের ঝুঁকি ছিল। এর আগে যেমন অনেক মিশন ব্যর্থ হয়েছে, অনেক নভোযান বিধ্বস্ত হয়েছে, এ ক্ষেত্রেও সেটি হতে পারত। লুনার মডিউল বিপৎসংকেতও দিচ্ছিল। কিন্তু সেই সংকেত উপেক্ষা করে তাঁরা অবতরণ করেন। মানুষের ইতিহাসে রচিত হলো এক অবিস্মরণীয় ও মহাকাব্যিক মুহূর্ত। চাঁদের মাটিতে তাঁরা রেখে আসেন তাঁদের তিনজন নিহত সহকর্মীর ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্র, মার্কিন প্রেসিডেন্টসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতাদের শুভেচ্ছাবার্তা, দুজন সোভিয়েত নভোযাত্রীর দুটি মেডেল এবং যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা। আর নিয়ে আসেন প্রায় ২১ কেজি মাটি ও পাথর।

২৪ জুলাই ১৯৬৯ তিন অভিযাত্রীকে নিয়ে নভোযানটি নিরাপদে ফিরে আসে পৃথিবীতে। অ্যাপোলো-১১ মিশনের অভাবনীয় সাফল্যের পর যুক্তরাষ্ট্র ১৯৬৯-৭২ কালপর্বে আরও পাঁচটি অভিযান পরিচালনা করে। অ্যাপোলো–১২, ১৪, ১৫, ১৬ ও ১৭—এই ৫টি নভোযানে মোট ১০ জন নভোচারী চাঁদের মাটিতে হেঁটে আসেন। তার মানে, নিল আর্মস্ট্রং, বাজ অলড্রিনসহ মোট ১২ জন চাঁদের মাটিতে নেমেছেন। কিন্তু প্রথম হওয়ার মর্যাদা আর পরেরগুলোয় ছিল না। তাঁদের নামও তাই জানা হয় না। বিভিন্ন অভিযানের নভোযাত্রীদের নামগুলো একবার জেনে নেওয়া যাক। অ্যাপোলো–১২: পেট কনরাড ও অ্যালান বিন। অ্যাপোলো–১৪: অ্যালান শেফার্ড ও এডগার মিশেল। অ্যাপোলো–১৫: ডেভিস স্কট ও জেমস আরউইন। অ্যাপোলো–১৬: জন ইয়ং ও চার্লস ডিউক। অ্যাপোলো–১৭: জিন সারমন ও হ্যারিসন স্মিথ। তাঁরা চাঁদে গিয়ে নানা ধরনের কাজ করেছেন। কৌতূহলী পাঠকেরা একটু খুঁজলেই সেসব বিবরণ পেয়ে যাবেন। এরপর আর কোনো দেশের অন্য কোনো নভোচারী চাঁদের মাটিতে পা রাখেননি।

মজার ব্যাপার হলো, যুক্তরাষ্ট্রের এই চন্দ্রাভিযান, বিশেষ করে মানুষের চাঁদে যাওয়া নিয়ে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব বা কন্সপিরেসি থিওরি চালু আছে বেশ জোরেশোরে। যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত পাঁচ ভাগ মানুষ এখনো বিশ্বাস করে না যে মানুষ কখনো চাঁদে গিয়েছিল। পৃথিবীর অনেক দেশের বহু মানুষও বিশ্বাস করে না। এই ষড়যন্ত্রতত্ত্ব প্রচারিত হয়েছিল খোদ যুক্তরাষ্ট্র থেকেই, ১৯৭৬ সালে সাংবাদিক বিল কেইসিংয়ের উই নেভার ওয়েন্ট টু মুন: আমেরিকাস থার্টি বিলিয়ন ডলার সুইন্ডল শিরোনামের বইটি প্রকাশের মাধ্যমে। ১৯৭৮ সালে মুক্তি পাওয়া ক্যাপ্রিকর্ন ওয়ান চলচ্চিত্রটি সেই ষড়যন্ত্রতত্ত্বের পালে বেশ জোর হাওয়া দেয়, যেখানে মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার নামে মানুষকে ধাপ্পা দেওয়ার ঘটনা দেখানো হয়েছে। যে নভোযান সেই চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে, সেটি দেখতেও অনেকটা অ্যাপোলো-১১-র মতো।

কেইসিং দাবি করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র কখনোই চাঁদে মানুষ পাঠায়নি, কারণ তখন চাঁদে যাওয়ার মতো কারিগরি ও যান্ত্রিক সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়নকে টেক্কা দেওয়ার জন্য তারা একটা মিথ্যা নাটক সাজিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে তিন হাজার কোটি ডলারের একটা ধাপ্পাবাজি উপহার দিয়েছে। মানুষ যে চাঁদে যায়নি, তার প্রমাণ হিসেবে তিনি কিছু যুক্তি বা বলা যেতে পারে কুযুক্তির অবতারণা করেন। যেমন চাঁদে তো বাতাস নেই, তাহলে পতাকা উড়ল কীভাবে? যে ছবি তোলা হয়েছে, সেখানে আকাশ অন্ধকার কেন এবং সেখানে তারা নেই কেন? চাঁদে আর্দ্রতা নেই, তাহলে সেখানে আর্মস্ট্রং ও অলড্রিনের পায়ের ছাপ পড়ল কীভাবে? পৃথিবীকে ঘিরে ‘ভ্যান অ্যালেন বেল্ট’ নামে যে তেজস্ক্রিয় অঞ্চল আছে, সেখানে পৌঁছামাত্র নভোযাত্রীদের মারা যাওয়ার কথা, তাঁরা সেটি অতিক্রম করেও বেঁচে রইলেন কীভাবে? প্রতিটি প্রশ্নের বিজ্ঞানসম্মত উত্তর ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়ে গেছে। তবে সবচেয়ে মোক্ষম উত্তরটি সম্ভবত এ-ই যে চন্দ্রাভিযান শুরুই হয়েছিল দুই পরাশক্তির শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি চাঁদে না-ই যেত, তাহলে সেটি প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত-সক্ষমতা সোভিয়েত ইউনিয়নেরই ছিল। কিন্তু কখনোই তারা যুক্তরাষ্ট্রের এই সাফল্যকে অস্বীকার করেনি।

১৯৭২ সালের পর যুক্তরাষ্ট্র আর চাঁদে অভিযান চালায়নি। যদিও সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত মনুষ্যবিহীন যান পাঠিয়েছে। এরপর চাঁদে অভিযানের আগ্রহে ভাটা পড়ে দুই দেশেরই।

সম্প্রতি সেই ধরনের প্রতিযোগিতা আবার ফিরে এসেছে, তবে এখন আর এটি কেবল দুই পরাশক্তির লড়াই নয়, আরও কিছু দেশও এতে যুক্ত হয়েছে। এই লেখার শুরুতেই সে কথা বলেছি। কিন্তু সব দেশই চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করতে চাইছে কেন? সেই রহস্য জানার জন্য আগে সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক চাঁদে কী আছে? আর বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কী পাওয়ার সম্ভাবনা আছে!

দুটি প্রশ্নের জবাব

চাঁদে কী আছে—এ প্রশ্নের উত্তরে আমরা আপনাকে পৃথিবীর কথা কল্পনা করতে বলব। তবে বর্তমান পৃথিবীর নয়। এমন এক পৃথিবী, যেখানে মানুষ তো নেই-ই, এমনকি কোনো জীবজন্তু, পশুপাখি, কীটপতঙ্গও নেই, নেই গাছপালাও। অর্থাৎ প্রাণের কোনো অস্তিত্বই নেই। সমুদ্র-নদীনালা-খালবিল-পুকুর-দিঘি কিছুই নেই, অর্থাৎ পানির কোনো উৎসই নেই। কিংবা থাকলেও তা আছে মাটির অনেক অনেক গভীরে জমাটবদ্ধ অবস্থায়, বরফের মতো, যার দেখা মেলে না। নেই বায়ুমণ্ডলও। কেউ যদি আপনাকে প্রশ্ন করে, এ রকম একটা পৃথিবীতে তাহলে কী আছে? অবশ্য আপনাকে জিজ্ঞাসা করবে কীভাবে, করবেইবা কে? আপনি বা প্রশ্নকর্তাও তো তখন নেই। তো, প্রশ্ন করলে কী বলবেন? মনে হচ্ছে না যে কিছুই নেই? হ্যাঁ, ব্যাপারটা অনেকটা তা-ই। কিন্তু মাটি তো আছে, আছে পাহাড়, যদিও সেগুলো সবুজ নয়, নিতান্তই পাথুরে। সমুদ্র নেই বলে ওখানে আছে গভীর খাদ, আছে বিস্তীর্ণ মরুভূমি, মানে সমতলভূমি ইত্যাদি।

চাঁদের অবস্থাও তা-ই। ওখানে প্রাণ নেই, পানি নেই, বায়ুমণ্ডলও নেই। কিন্তু পাথুরে পাহাড় আছে, গিরিখাদ আছে, মালভূমির মতো কিছু জায়গাও আছে। পৃথিবীর মাটি বা পাথর যেমন নানা ধরনের উপাদানে তৈরি, চাঁদের উপরিভাগের মাটিও তা-ই। চাঁদে প্রচুর ধুলোবালু আছে। বাতাস নেই বলে সেগুলো ওড়ে না, বরং পুরু হয়ে জমে থাকে। বায়ুমণ্ডল নেই বলে সূর্যের তাপ শোষণ করারও কিছু নেই। সে জন্য দিন ও রাতে তাপমাত্রার বিরাট পার্থক্য দেখা যায়। সূর্যালোকিত দিনের বেলায় চন্দ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা পৌঁছায় প্রায় ১৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, আর রাতে তাপমাত্রা নেমে যায় মাইনাস ১৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। মেরু অঞ্চলে নেমে যায় এর চেয়েও বেশি, প্রায় মাইনাস ২৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। এটিই সৌরজগতে রেকর্ড করা সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। অর্থাৎ চন্দ্রপৃষ্ঠে দিন ও রাতের তাপমাত্রায় পার্থক্য ২৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে! অভাবনীয় লাগে না?

চাঁদের পাথরগুলো প্রধানত লোহা ও ম্যাগনেশিয়াম দিয়ে গড়া। যেসব সাগর আছে (নামেই সাগর, পানি মোটেই নেই), সেগুলো তৈরি হয়েছে বিলিয়ন বছর আগে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত থেকে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, আদিম অবস্থায় সব গ্রহ-উপগ্রহই গলিত পদার্থে পূর্ণ ছিল এবং তাপমাত্রা ছিল অত্যন্ত বেশি। অগ্ন্যুৎপাত তাই অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। চাঁদের খাদগুলো ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত গভীর। চাঁদ থেকে যেসব নমুনা সংগ্রহ করে আনা হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চাঁদের উপরিতলের মাটিতে অক্সিজেন, সিলিকন, লোহা, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, অ্যালুমিনিয়াম, ক্রোমিয়াম, টাইটানিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ইত্যাদি উপাদান লীন হয়ে আছে। কোথাও কোথাও তেজস্ক্রিয় মৌল থোরিয়ামের পরিমাণ বেশি, ইউরেনিয়ামেরও অস্তিত্ব আছে সেখানে।

মনে রাখা প্রয়োজন, বিশ্বজগতে যত মৌলিক পদার্থ আছে, তার সবই তৈরি হয় নক্ষত্রে। গ্রহ বা উপগ্রহ মৌলিক উপাদান তৈরিতে অক্ষম। এমনকি প্রাণজগৎ যেসব উপাদানে তৈরি, সেগুলোও এসেছে কোনো না কোনো নক্ষত্র থেকে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে আমরা সবাই নক্ষত্রেরই অংশ।

চাঁদে যেসব উপাদান আছে, সেগুলোও কোনো না কোনো নক্ষত্র থেকে এসেছে। সবচেয়ে বেশি এসেছে সূর্য থেকে। বায়ুমণ্ডল ও জলের প্রবাহ নেই বলে চাঁদের আদি পরিবেশ খুব বেশি পাল্টায়নি, ক্ষয়সাধনও হয়নি, আবহাওয়া বদলায়নি, যৌগিক পদার্থও খুব বেশি তৈরি হয়নি। পৃথিবী, চাঁদ ও অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহ যেহেতু প্রায় একই প্রক্রিয়ায় তৈরি, সে জন্য চাঁদের পরিবেশ ও উপাদান নিয়ে যথাযথ গবেষণা হলে পৃথিবী ও সৌরজগতের আদিম দশা ও বিবর্তনের প্রক্রিয়া সম্বন্ধেও জানা যাবে বলে আশা করা যায়।

চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পানি জমাট বেঁধে আছে, মানে বরফ হয়ে আছে। যদিও তা চন্দ্রপৃষ্ঠে নয়, বরং বেশ গভীরে, এমনটা আবিষ্কৃত হয় ২০১৮ সালে। তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি, জাপান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে নভোযান পাঠানোর তোড়জোড় শুরু করেছে।

গত শতকের ষাটের দশকে মার্কিন ও সোভিয়েত নভোযানগুলো চাঁদের বিষুবরেখার কাছাকাছি নেমেছিল, মেরু এলাকা থেকে যা অনেক দূরে (বিষুবরেখা হলো এমন এক কাল্পনিক রেখা, যা কোনো গ্রহ বা উপগ্রহকে সমান দুই ভাগে ভাগ করে, এক ভাগে থাকে উত্তর গোলার্ধ, অন্য ভাগে দক্ষিণ গোলার্ধ)।

গত বছরের আগস্ট মাসে ভারতের চন্দ্রযান-৩ চাঁদের দক্ষিণ মেরু থেকে ৬০০ কিলোমিটার দূরে সফল অবতরণ করে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে। এটিই কোনো নভোযানের প্রথম মেরু অঞ্চলে অবতরণ। এই নভোযানের ল্যান্ডারটির নাম বিক্রম। সেখান থেকে মানুষের বদলে প্রজ্ঞান নামের এক ছোট্ট রোভার চাঁদের মাটিতে নামানো হয়। প্রজ্ঞান একটু একটু করে চলতে চলতে চাঁদের দক্ষিণ মেরু এলাকার মাটিও কিছুটা খুঁড়ে দেখেছে এবং অদ্ভুত এক তথ্য পাঠিয়েছে। সে সময় চন্দ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ছিল ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, অথচ মাটির মাত্র ৩ ইঞ্চি গভীরে তাপমাত্রা ছিল মাত্র মাইনাস ১০ ডিগ্রি সেলসিলিয়াস। অর্থাৎ দিনের বেলায়, চন্দ্রপৃষ্ঠ যখন বেশ উষ্ণ, তখন মাটির সামান্য নিচেই হিমশীতল ঠান্ডা!

মেরু অঞ্চলে এমন কিছু গহ্বর আছে, যেখানে কখনোই সূর্যের আলো পৌঁছায় না। চির অন্ধকার সেসব এলাকায় প্রচুর পরিমাণে বরফ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। কোটি কোটি বছর ধরে সঞ্চিত সেই বরফ হয় চাঁদের মাটির সঙ্গে মিশে আছে অথবা চন্দ্রপৃষ্ঠে উন্মুক্ত অবস্থায় আছে। বরফের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেলে এবং সেগুলো কী অবস্থায় আছে (জমাটবদ্ধ পানি, নাকি বালুকণার সঙ্গে মিশে থাকা বরফের স্ফটিক), তা জানা গেলে একটা বড় অগ্রগতি হবে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। বরফ বা পানি থেকে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন আলাদা করে তা ব্যবহার করা যাবে রকেটের জ্বালানি হিসেবে। এমনকি মানুষের জন্য অস্থায়ী বসতিও নির্মাণ করা যাবে।

তাতে সুবিধা কী? সুবিধা হলো, দূরের গ্রহগুলোয় তখন অভিযান চালানো সহজ হবে। পৃথিবী থেকে রওনা দিয়ে সরাসরি মঙ্গলে বা অন্য কোনো গ্রহে যাওয়ার চেয়ে চাঁদে নেমে রকেটে আবার জ্বালানি ভরে নতুন যাত্রা করা অনেক সুবিধাজনক। চাঁদের মুক্তিবেগও অনেক কম, ফলে ওখান থেকে উৎক্ষেপণ করলে খুব বেশি জ্বালানিও লাগবে না।

তবে চাঁদে মানববসতি স্থাপনের চিন্তা নিতান্তই উদ্ভট ও অবাস্তব। যেখানে বায়ুমণ্ডল নেই, সেখানে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যে ধরনের কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করতে হবে, তা এতই বয়বহুল, শ্রমসাধ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ যে তা অর্জন করা কোনো দিনই সম্ভব হবে না। চাঁদে পানি নেই, দক্ষিণ মেরুতে জমাটবাঁধা বরফ আছে বলে ধারণা করা হলেও এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য এখনো আমরা জানি না। তাহলে কল্পিত মানববসতির বাসিন্দাদের জন্য পানির উৎস কী হবে? দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য এত বেশি যে কোনো প্রাণীর পক্ষেই সেখানে টিকে থাকা সম্ভব নয়। হ্যাঁ, সম্ভব হবে যদি তাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যায়। সেটিইবা করা হবে কীভাবে? বসতি স্থাপন মানে তো আর কয়েক মিনিটের অবস্থান নয়, সারা জীবন সেখানে বসবাসের ব্যাপার। বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে জরুরি দুটি ব্যাপার বায়ুমণ্ডল ও পানির উৎস ছাড়া কীভাবে তা সম্ভব? খাদ্যের সংস্থানের কথা নাহয় বাদই দেওয়া গেল।

এসব ব্যাপার সাধারণ মানুষও বোঝে। তাহলে বিজ্ঞানীরা কি বোঝেন না? তাঁরাও বোঝেন। বুঝেশুনেই তাঁরা বলেন। তাঁরা আসলে রাষ্ট্রনেতাদের বোকা বানিয়ে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের অর্থায়নে রাজি করাতে এসব বলেন। যদিও সবাই জানেন ও বোঝেন, চাঁদে বসতি স্থাপনের চেয়ে বরং পৃথিবীকে অধিকতর বাসযোগ্য করে তোলাই হতে পারে সবচেয়ে ভালো বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ।

এই লেখার জন্য নানা বই ও উৎস থেকে তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে, স্থানাভাবে এখানে দেওয়া গেল না