‘হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের’ বিচার চাইলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলের শিক্ষকেরা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন নীল দল ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ড, শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের ওপর হামলা, নাশকতা-ধ্বংসযজ্ঞের তদন্ত ও বিচারের দাবিতে’ মানববন্ধন করেছে। পরে ক্যাম্পাসে মিছিল করে উপাচার্যকে পাঁচ দফা দাবিতে স্মারকলিপি দেন ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক শিক্ষকেরা।
আজ শনিবার বেলা ১১টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে নীল দলের মানববন্ধন হয়। পরে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে সেখান থেকে মিছিল নিয়ে টিএসসির রাজু ভাস্কর্য প্রদক্ষিণ করে উপাচার্য কার্যালয়ে স্মারকলিপি দিতে যান শিক্ষকেরা।
অপরাজেয় বাংলায় মানববন্ধনে অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান আন্দোলনে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা দেখিয়েছে, নিরস্ত্র অবস্থায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে কীভাবে ন্যায়সংগত দাবি আদায় করতে হয়। এটি কোনো একাডেমিক সংকট নয়। এই সংকট তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক কিছু স্থবিরতার কারণে। সংকট জাতীয়ভাবেই সমাধান করা প্রয়োজন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য আরও বলেন, ‘আমরা চাই, অবিলম্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে শিক্ষার্থীরা যেন ক্যাম্পাসে এসে পুনরায় জীবন গড়ার সুযোগ পায়, সেই কাজটি এখন আমাদের অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। কর্তৃপক্ষের প্রতি আমাদের দাবি থাকবে, নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করে, ক্ষতিগ্রস্ত ভবন ও স্থাপনা সংস্কার সাপেক্ষে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া হোক।’
জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে গিয়ে মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘এখন প্রয়োজন জাতীয় ঐক্যের এবং সেটির জন্য সংলাপের বিকল্প নেই। সরকারের উচ্চমহল থেকে উদ্যোগটি গ্রহণ করা জরুরি। সহিংস কাজের মধ্য দিয়ে কোনো কিছু অর্জিত হবে না। শিক্ষার্থীদের প্রতি আমাদের উদাত্ত আহ্বান থাকবে যে তোমরা নিজের ক্যাম্পাসে ফিরে এসে পুনরায় জাতি গঠনের ভূমিকাকে বিগত দিনের মতো শক্তিশালী করো।’
এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘১ থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হয়েছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। আমরাও যৌক্তিক সমাধানের কথা বলেছি। আমাদের উপাচার্যও তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। হঠাৎ করে ১৫ জুলাই অপশক্তিরা শিক্ষার্থীদের বিপথে পরিচালিত করে হল দখল, কক্ষ ভাঙচুর, হামলা ইত্যাদি ঘটিয়েছে। পরদিন সহকারী প্রক্টরদের আঘাত করা হয়েছে। রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষকে অবরুদ্ধ করা হয়েছে। আমরা এসব অপকর্মের নিন্দা জানাই। যেসব শিক্ষার্থী শাহাদাতবরণ করেছেন, তাঁদের প্রতি আমরা শ্রদ্ধা জানাই।’
শিক্ষক সমিতির সদস্য আ জ ম শফিউল আলম ভূঁইয়া মানববন্ধনে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আবেগকে উসকে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। বিপথগামী শক্তি শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। সরকার পতন ও রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা যারা করছে, তাদের শিক্ষকসমাজ হুঁশিয়ার করে দিতে চায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলব, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ধৈর্য ও সংযমের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করুন। আমরা আর কোনো প্রাণহানি দেখতে চাই না। শিক্ষার্থীদের নিয়ে ক্লাসে ফিরতে শিক্ষকেরা মুখিয়ে আছেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম অহিদুজ্জামান বলেন, ‘সরকার ও কর্তৃপক্ষকে আহ্বান, হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারা আছে, তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, ‘শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক নষ্ট করার জন্য নানা ধরনের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এই অপচেষ্টা জাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।’
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ব্যবহার করে কারা সরকারের পদত্যাগ চায়—এ প্রশ্ন রেখে নীল দলের নেতা আবদুর রহিম বলেন, ‘তৃতীয় পক্ষ ঘোলা জলে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে। শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোর জন্য আমরা দুঃখিত।’
মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করে নীল দলের আহ্বায়ক আমজাদ আলী বলেন, ‘স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি দেশে নানা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে অবিশ্বাস তৈরি করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীশূন্য বিশ্ববিদ্যালয় আমরা দেখতে চাই না। সে জন্য আমরা উপাচার্যকে স্মারকলিপি দিচ্ছি ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য।
পাঁচ দফা দাবি
উপাচার্যের কাছে দেওয়া স্মারকলিপি সাংবাদিকদের পড়ে শোনান নীল দলের আহ্বায়ক আমজাদ আলী। এতে পাঁচ দফা দাবি জানানো হয়। দাবিগুলো হলো কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সংঘটিত অনাকাঙ্ক্ষিত সব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের অবিলম্বে শাস্তির ব্যবস্থা করা; আবাসিক হলগুলোয় বৈধ ও নিয়মিত শিক্ষার্থীদের অবস্থান নিশ্চিত করতে নীতিমালা প্রণয়ন; হলগুলোয় শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদের জীবনমানের উন্নয়ন, স্বাধীন মতপ্রকাশ ও যেকোনো ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন রোধে নীতিমালা প্রণয়ন; বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারগুলোয় শুধু বৈধ শিক্ষার্থীদের প্রবেশ নিশ্চিত করতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া এবং ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী-শিক্ষকসহ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
নীল দলের যুগ্ম আহ্বায়ক রবিউল ইসলামের সঞ্চালনায় মানববন্ধনে অন্যদের মধ্যে নীল দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মিজানুর রহমান, কলা অনুষদের ডিন আবদুল বাছির, সহকারী প্রক্টর আবদুল মুহিত, অধ্যাপক সাবিতা রিজওয়ানা রহমান প্রমুখ বক্তব্য দেন।