গুইমারায় নিহতদের স্মরণে প্রদীপ প্রজ্বালন: পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে এ সরকারের সময়েও মিথ্যা প্রচার হচ্ছে
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় ন্যায়বিচার ও বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে এক দিনও ওই প্রতিশ্রুতির কোনো অগ্রগতি হয়নি; বরং অনেক ক্ষেত্রে অবনতি ঘটেছে। অনেক অন্যায়কে আড়াল করা হয়েছে। মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রচার করা হয়েছে।
খাগড়াছড়ির গুইমারাতে গুলিবর্ষণে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে প্রদীপ প্রজ্বালন কর্মসূচিতে উপস্থিত বক্তারা এসব কথা বলেছেন। আজ সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে এ কর্মসূচির আয়োজন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন।
কর্মসূচিতে দেশবাসী ও অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের লিখিত ঘোষণা পাঠ করেন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন। ঘোষণায় বলা হয়, খাগড়াছড়িতে একজন মারমা কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় শুরু হওয়া প্রতিবাদে সংঘর্ষ, গুলিবর্ষণ ও অগ্নিসংযোগে তিনজন নিহত এবং অন্তত ৩০ আদিবাসী আহত হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্বারা অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ রয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপের দাবি জানাচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা একটি জাতীয় সমস্যা উল্লেখ করে বলা হয়, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এখনো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। যার কারণে পাহাড়ে অশান্তি বেড়ে গেছে। তাই দেশের সব রাজনৈতিক পক্ষ ও অংশীজনকে নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে জাতীয় সংলাপ জরুরি।
কিশোরী ধর্ষণের ঘটনার মেডিকেল রিপোর্ট জনসমক্ষে চলে আসা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন জাকির হোসেন। তিনি বলেন, এ বিষয়ে খাগড়াছড়ির সিভিল সার্জন অফিসের সুস্পষ্ট বক্তব্য দেওয়া হোক। ধর্ষণের শিকার কিশোরীর পিতার বক্তব্য বিবেচনা করে দ্রুত, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নির্যাতিত কিশোরী ও পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নিহতের পরিবারের জন্য কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমার জানামতে সেই ১৯৭১ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে যতগুলো গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, তার অধিকাংশ গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল খাগড়াছড়ি জেলায়। আরও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পরেও যে ১৬-১৭টি গণহত্যা হয়েছে, তার অধিকাংশই সংঘটিত হয়েছে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলায়। সম্প্রতি সংঘটিত নারী নিপীড়ন, হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকারের লঙ্ঘনের ঘটনাও সেই ধারাবাহিকতার অংশ।’
খায়রুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, ‘পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না করার মানে পার্বত্য মানুষের ভূমি অধিকার, নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকারের অস্বীকার। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও এই অস্বীকারের রাজনীতি চলতে পারে না। এই অন্যায়ের অবসান চাই এবং ন্যায় ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আপনাদের সহযোগিতা ও সমর্থন প্রত্যাশা করছি।’
এএলআরডির পরিচালক শামসুল হুদা বলেছেন, খাগড়াছড়ির ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি আদিবাসীদের সাধারণ নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কৃত্রিম নিরাপত্তা বলয়েরই ধারাবাহিকতা।
শামসুল হুদা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় ন্যায়বিচার ও বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের প্রতিশ্রুতি দিলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে এক দিনও কোনো অগ্রগতি হয়নি; বরং অবনতি ঘটেছে। অনেক অন্যায়কে আড়াল করা হয়েছে। মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। উপদেষ্টারা ঘটনাস্থলে গিয়ে যে কথা বলেন, তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল পাওয়া যায় না, যা অত্যন্ত লজ্জাজনক।
বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য মুশতাক হোসেন বলেন, কোনো জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো এবং তার পেছনে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বিভাজন সৃষ্টি করা চলতে পারে না। দেশে সব নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। কোথাও বেসামরিক শাসন, কোথাও সামরিক শাসন—এভাবে দ্বৈত ব্যবস্থা চলতে পারে না। উসকানি সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষ হত্যা ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতি জিইয়ে রেখে যারা হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শপথ নিতে হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মাহমুদুল সুমন বলেছেন, বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনাগুলোকে বারবার ‘নিরাপত্তা ইস্যু’ হিসেবে দেখা হয়। প্রায়ই ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ তকমা দিয়ে উপস্থাপন করা হয়, যা অন্যায়। বাংলাদেশের সব নাগরিকের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষেরও সমান অধিকার আছে, তাদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের অধিকারও রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের সদস্য দীপায়ন খীসা এ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানে সংহতি জানায় ঐক্য ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, কাপেং ফাউন্ডেশন, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন।