প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্যে হাঁসফাঁস

নগরের বিভিন্ন খাল হয়ে প্রতিদিন অন্তত ৭৮৫ টন বর্জ্য মিশছে কর্ণফুলীতে। এর মধ্যে বেশি থাকে প্লাস্টিক ও পলিথিন।

দূষণে জর্জরিত কর্ণফুলী নদীর একাংশ। ভাসছে পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল ও ময়লা–আবর্জনা। এর মধ্যে বোতল সংগ্রহ করছে এক কিশোর। গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের নতুন ফিশারিঘাট এলাকায়
ছবি: জুয়েল শীল

কর্ণফুলী নদীর চাক্তাই খালের মুখে ভাসছে পলিথিন, চিপসের খালি প্যাকেট, জাম্বুরার খোসাসহ নানা আবর্জনা। এসব ময়লার উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল চাক্তাই খালের সেতুর নিচে একটি ময়লার ভাগাড় রয়েছে। রাস্তার পাশের দোকান ও বসতি থেকে প্রতিদিন সেখানে ফেলা হয় আবর্জনা। খাল হয়ে সেসব বর্জ্য যাচ্ছে নদীতে।

শুধু চাক্তাই নয়, সংযুক্ত রাজাখালী খাল হয়েও আবর্জনা সরাসরি মিশছে কর্ণফুলীতে। দুটি খালের মোহনায় পানি কালো কুচকুচে। চাক্তাই-রাজাখালী খালের পাশাপাশি সরেজমিনে নদীর চট্টগ্রাম নগর অংশের অন্তত আরও তিনটি স্থান—ব্রিজঘাটা, অভয়মিত্র ঘাট ও সদরঘাট ঘুরে পলিথিন ও গৃহস্থালি বর্জ্য ভাসতে দেখা যায়।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ২০২১ সালের বর্জ্যবিষয়ক প্রতিবেদন অনুযায়ী, নগরের বিভিন্ন খাল হয়ে প্রতিদিন অন্তত ৭৮৫ টন বর্জ্য মিশছে কর্ণফুলীতে। এর মধ্যে বেশি থাকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্লাস্টিক ও পলিথিন। আবর্জনার কারণে পানিদূষণের পাশাপাশি নদীর গভীরতাও কমে আসছে বলে বিভিন্ন সমীক্ষা ও গবেষণায় উঠে এসেছে।

পলিথিন নদীর তলদেশে জমা হয়েছে। এ ছাড়া যেসব মাটি তোলা হয়েছে, তাতেও পলিথিন ও প্লাস্টিক দ্রব্য পাওয়া গেছে। এটি নদীর জীববৈচিত্র্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। ব্যবহার বন্ধ না করলে নদী কখনো পলিথিনমুক্ত করা সম্ভব নয়।
স্বপন কুমার পালিত, অধ্যাপক ও গবেষক, চুয়েট

পরিবেশবাদী সংগঠন চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন ২০২২ সালে কর্ণফুলী নদীর গভীরতা ও দখল জরিপ করে। এর মধ্যে চাক্তাই খালের মোহনার উত্তর পাশে নদীতে গভীরতা পাওয়া যায় মাত্র সাড়ে ১৩ ফুট। দক্ষিণ পাশে তীরের কাছাকাছি গভীরতা পায় ৪৮ ফুট। রাজাখালী খালের মোহনায় গভীরতা পাওয়া যায় ৪ ফুট। আবার ফিরিঙ্গিবাজার এলাকায় নদীর গভীরতা পাওয়া যায় সাড়ে সাত ফুট।

চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশনের খাল দিয়ে নদীতে গিয়ে পড়ে তরল ও কঠিন বর্জ্য। পলিথিন তার মধ্যে অন্যতম। তবে চাক্তাই, রাজাখালী ও মহেশখাল দিয়ে বেশির ভাগ আবর্জনা নদীতে যায়। কারণ, এই তিনটি খাল সরাসরি যুক্ত কর্ণফুলীর সঙ্গে।

কর্ণফুলী নদীতে চট্টগ্রাম বন্দরের চলমান ড্রেজিং (খনন) কার্যক্রমেও পলিথিনের ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায়। ২১৮ সালের অক্টোবর থেকে নদীর চলমান ড্রেজিংয়ে চলতি বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত ৪৮ লাখ ঘনমিটার বালুযুক্ত মাটি তোলা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২২ লাখ ঘনমিটার ছিল পলিথিনযুক্ত বালুমাটি। ড্রেজিং এখনো চলছে। নদীতে আরও পলিথিনের স্তর রয়েছে বলে জানান এই কার্যক্রমে যুক্ত এক বন্দর কর্মকর্তা।

বিশেষজ্ঞরা কর্ণফুলী পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যমুক্ত না হওয়ার জন্য নদীপাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ না হওয়াকে অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ২০১৫ সালে হাইকোর্টে জমা দেওয়া এক প্রতিবেদনে কর্ণফুলী নদী দখল করে ২ হাজার ১১২টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে জেলা প্রশাসন। পরে আদালতের নির্দেশে ২০১৯ সালে এই স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু গত দুই বছর ধরে তা থেমে আছে।

জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, কর্ণফুলী নদীর বেশ কিছু অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। বাকিগুলো উচ্ছেদে শিগগির অভিযান চালানো হবে।

ভারতের মিজোরামে উৎপত্তি হওয়া কর্ণফুলী নদী বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে চট্টগ্রামে প্রবেশ করে। কালুরঘাট সেতু থেকে নদীর মোহনা চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার নগর অংশে পড়েছে। দূষণও বেশি এই অংশে।

চলতি বছরের আগস্ট মাসে প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্যের কারণে পরিবেশ দূষণ ও বিরূপ প্রভাব শীর্ষক চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। চুয়েটের অধ্যাপক স্বপন কুমার পালিত এতে নেতৃত্ব দেন। এতে বলা প্রতিদিন ২৫০ টন প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে ১৪০ টন সংগ্রহ করা যায় না। এসব বর্জ্য গিয়ে নদীতে পড়ে।

জানতে চাইলে স্বপন কুমার পালিত প্রথম আলোকে বলেন, পলিথিনের কারণে নদীর ড্রেজিংয়ে সমস্যা হয়েছে। পলিথিন নদীর তলদেশে জমা হয়েছে। এ ছাড়া যেসব মাটি তোলা হয়েছে, তাতেও পলিথিন ও প্লাস্টিক দ্রব্য পাওয়া গেছে। এটি নদীর জীববৈচিত্র্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। ব্যবহার বন্ধ না করলে নদী কখনো পলিথিনমুক্ত করা সম্ভব নয়।