গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে স্মরণ স্বজন-শিল্পীদের

শিল্পকলা একাডেমিতে গাজী মাজহারুল ইসলাম স্মরণসভায় বক্তারা। সোমবার বিকেলে
ছবি: প্রথম আলো

‘একটা বর্ণাঢ্য কর্মজীবন গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ারের। আমি তাঁর ছোট্ট একটা অংশ হয়ে ছিলাম। আমার মনে হয়, যেন একটা আগুনের সঙ্গে বসবাস করেছি, প্রতিভার আগুন। আমি চেষ্টা করেছি সেই আগুনকে সব সময় প্রজ্বলিত রাখতে। আমি ধন্য।’ আবেগাপ্লুত কণ্ঠে প্রয়াত স্বামী গাজী মাজহারুল আনোয়ার স্মরণসভায় কথাগুলো বলছিলেন জোহরা গাজী। স্ত্রী, কন্যা, বোনের পাশাপাশি কীর্তিমান এই গীতিকবির শিল্পীজীবনের স্বজনেরা পরম শ্রদ্ধায় তাঁকে স্মরণ করলেন।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে ছিল প্রয়াত গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ার স্মরণসভা। শিল্পকলা একাডেমি ও গীতিকবি সংঘের যৌথ আয়োজনে জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনের এ সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। সভার সভাপতি ছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী।

কেবল বিষয়বস্তু শুনেই গান লিখে ফেলতেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। ২০ হাজার গান লিখেছেন তিনি। বহু গান পেয়েছে জনপ্রিয়তা, হয়েছে কালোত্তীর্ণ। শিল্প-সংস্কৃতির মানুষের কাছে তিনি ছিলেন পিতা ও বড় ভাইয়ের মতো। নম্র, রসিক, উদার ও বন্ধুবৎসল মানুষ ছিলেন তিনি। শিল্পী, সংগীত পরিচালক ও কলাকুশলীদের সঙ্গে দ্রুত তৈরি হয়ে যেত তাঁর পারিবারিক বন্ধন। স্মরণসভায় সংগীতের স্বজনদের স্মৃতিচারণায় এভাবেই মূর্ত হয়ে ওঠে এই গীতিকবির কীর্তি।

গাজী মাজহারুল ইসলাম স্মরণাসভায় শিল্পী, গীতিকবি ও সংগীত পরিচালকেরা
ছবি: প্রথম আলো

বরেণ্য গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান বলেন, ‘চারণ কবির চেয়েও দ্রুততায় তিনি লিখতে পারতেন, স্নাত হতেন গানের ভাবে। তাঁকে চর্চার মধ্যে রাখলে কখনো মনে হবে না বাংলাদেশের গান নিঃস্ব। তাঁকে চর্চা করলে আমাদের অতীত গৌরব ও শিকড় সম্বন্ধে দৃঢ় বিশ্বাস তৈরি হবে, লালন করলে আরও অগ্রসর হবে বাংলা গান। তাঁকে ভালো না বেসে পারা যায় না, ভুলে থাকা যায় না। আমরা তাঁকে চিরদিন মনে রাখব।’

তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘আলম খানের স্মরণসভায় গাজী মাজহারুল আনোয়ারের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুটা আমার কাছে একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত। তাঁর লেখা ‘‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’’ গানটি শুনলে এখনো আনমনা হয়ে পড়ি। পৃথিবীর জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বাঙালি অনন্য তার উন্নত সংস্কৃতির কারণে। সেই সংস্কৃতির অন্যতম আমাদের গান। যত দিন বাংলা গান থাকবে, গাজী মাজহারুল আনোয়ার তত দিন আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। তাঁর গানগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজটি পরিবার ও বন্ধুদের করতে হবে। ফিল্ম আর্কাইভেও সংরক্ষণের কাজটি করা যেতে পারে।’

লিয়াকত আলী লাকী বলেন, ‘আমার মনে হয় প্রয়াণের মধ্য দিয়ে গাজী ভাইয়ের আরেকটা জীবন শুরু হলো। তাঁর এই জীবনে আমাদের দায়িত্ব অনেক। পরবর্তী প্রজন্মের স্বার্থে হলেও তাঁর গানগুলো সংরক্ষণ করতে হবে। তাঁর কাব্যের যে ব্যঞ্জনা, তা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা হতে পারে। গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে নিয়ে আমরা একটি তথ্যচিত্রও নির্মাণ করব।’

সভায় পরিবারের পক্ষে বক্তব্য দেন গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ছোট বোন নাহিদা আক্তার নাসরিন ও মেয়ে দিঠি আনোয়ার। দিঠি বলেন, ‘মৃত্যুর কিছুদিন আগেও মাকে বাবা বলেছিলেন, ‘‘তুমি আমাকে অসাধারণ সুন্দর একটা পরিবার দিয়েছ। তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।” জীবদ্দশায় তাঁর কোনো অপূর্ণতা ছিল না। তিনি ৭৯ বছরে চলে গেছেন, এর মাঝে ৬০ বছরই চলচ্চিত্র ও বাংলা সংগীতকে দিয়েছেন। বাবার সবগুলো গান এখনো সংরক্ষণ করা যায়নি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে মাত্র ছয়-সাত শ গান সংগ্রহ করা গেছে। সরকারি উদ্যোগ ছাড়া এটি আসলে খুব কঠিন। সংগীতে বাবার যে অবদান, তা স্কুল–কলেজ পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকে আনতে পারলে ভালো হতো। বাবার নামে আমরা একটা একাডেমি, স্টুডিও, জাদুঘর ও গানের স্কুল করতে চাই। কাজগুলো সরকারিভাবে করা গেলে খুব ভালো হতো।’

গাজী মাজহারুল আনোয়ার ছিলেন গীতিকবি সংঘ বাংলাদেশের আজীবন সদস্য। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বক্তব্য দেন সংগীতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের নেতা ও শিল্পীরা।

স্মৃতিচারণা করেন কণ্ঠশিল্পী আবিদা সুলতানা, রফিকুল আলম, খুরশীদ আলম, নকীব খান, কুমার বিশ্বজিৎ, মনির খান, গীতিকবি মনিরুজ্জামান মনির, জুলফিকার রাসেল, গোলাম মোরশেদ, সুরকার শেখ সাদী খান, রিপন খান, যন্ত্রশিল্পী গাজী আবদুল হাকিম প্রমুখ।

স্বাগত বক্তব্যে গীতিকবি সংঘের সাধারণ সম্পাদক আসিফ ইকবাল বলেন, ‘আমরা যাঁরা গীতিকবিতা লিখছি, তাঁদের জন্য সবচেয়ে বড় আদর্শ ছিলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি হাতে কলম তুলে নিয়েছিলেন। সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা গানকে। তাঁর মতো মানুষকে সম্মান দিতে না পারলে এমন মানুষ আর জন্মাবে না। তাঁর নামে একটি স্থাপনা বা সড়কের নামকরণের অনুরোধ করছি।’

অনুষ্ঠানের শুরুতেই গাজী মাজহারুল আনোয়ারের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন গীতিকবি সংঘের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি লিটন অধিকারী রিন্টু। সভা সঞ্চালনা করেন জয় শাহরিয়ার। অনুষ্ঠানে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের জীবন ও কর্ম নিয়ে বড় পর্দায় একটি প্রামাণ্যচিত্রের প্রদর্শনী করা হয়।