মৌখিক পরীক্ষায় শিক্ষকেরা সেই প্রশ্নই করেছিলেন

অর্থনীতি ও ইংরেজির পর রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন শাহজাহান বিশ্বাস। তিনটি বিষয়ে স্নাতকোত্তর করার চেয়ে বড় দিকটি হলো, সর্বশেষ ডিগ্রিটি তিনি অর্জন করেছেন ৮৪ বছর বয়সে। গত বুধবার রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় তাঁর ফল প্রকাশিত হয়। তিনি ১৯৯৭ সালে সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে অবসর নেন। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

শাহজাহান বিশ্বাস

প্রশ্ন :

এই বয়সেও পরীক্ষায় বসার প্রেরণা পান কোথা থেকে?

শাহজাহান: পরীক্ষার হলে বসব, প্রশ্ন হাতে নেব, পড়ব। তারপর সুন্দর করে উত্তরগুলো লিখব, এটা আমার শখ। এখনো পরীক্ষার হলে বসতে আমার ভালো লাগে। বলতে পারেন, এটাই আমার এই বয়সে পরীক্ষায় বসার প্রেরণা।

প্রশ্ন :

পরীক্ষার হলে ঢোকার সময় অন্যরকম কোনো অভিজ্ঞতা হয়?

শাহজাহান: আমি সব সময় পাঁচ মিনিট আগে পরীক্ষার হলে ঢুকি। পরীক্ষার নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পাঁচ মিনিট আগে খাতা দিয়ে বের হয়ে আসি। কার কেমন পরীক্ষা হলো, তা জিজ্ঞেস করি না। আমাকেও কেউ জিজ্ঞেস করার সুযোগ পায় না।

প্রশ্ন :

এবার রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে কেমন লাগছে?

শাহজাহান: তৃতীয়বার স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার আগ্রহটা আমার এত বেশি ছিল যে এটা শেষ করতে পেরেছি এটাই বড় কথা। কারণ, এটা শেষ করতে পারব এমন ভরসা ছিল না। এনার্জি (শারীরিক জোর ও মনোবল) হারায় কি না, এই ভয় ছিল।

প্রশ্ন :

জীবনে প্রথম পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন হাতে নেওয়ার স্মৃতি কি মনে আছে?

শাহজাহান: অবশ্যই। আমি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের ফতুল্লাপুর শশীমণি হায়ার সেকেন্ডারি মাল্টিপারপাস স্কুলের ছাত্র ছিলাম। এখানে যেমন এসএসসি পরীক্ষা হয়, ওই সময় ওখানে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা হতো। সেটিই প্রথম পাবলিক পরীক্ষা, ১৯৫৫ সালে। এখনো সেই স্মৃতি জ্বলজ্বল করে। অবসরে যাওয়ার পরে সেখানে দু-তিনবার গিয়েছিলাম। তবে কোনো ব্যাচমেটকে (সহপাঠী) পাইনি। কেউ বেঁচে নেই।

প্রশ্ন :

আপনার সন্তান কত জন? এই বয়সে পরীক্ষা দেওয়ার বিষয়ে তাদের মনোভাব কী?

শাহজাহান: আমার চার মেয়ে ও এক ছেলে। আমি সব সময় নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলেছি। খাওয়াদাওয়া, চলাফেরা, সবকিছুতেই। এ জন্যই এত দিন সুস্থভাবে বেঁচে আছি। সুতরাং আমার সন্তানেরা আমার কাজকে অনুসরণীয় মনে করে। তারাও চেষ্টা করে, কিন্তু এতটা না।

প্রশ্ন :

আপনি ১৯৯৯ সালে দ্বিতীয়বার স্নাতকোত্তর করেন। ২০২২ সালে তৃতীয়। মাঝখানে এত দেরি কেন?

শাহজাহান: আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুবার স্নাতকোত্তর করেছি। দ্বিতীয় স্নাতকোত্তর করার পরপরই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয়বারের জন্য গিয়েছিলাম। তখন তাঁরা জানায় যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনবার স্নাতকোত্তর করার কোনো নিয়ম নেই। জায়গা খুঁজছিলাম, কোথায় আরেকটা স্নাতকোত্তর করা যায়। একপর্যায়ে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই সুযোগ পেলাম।

প্রশ্ন :

আপনি বলছিলেন এরপর ইতিহাস বিষয়ে স্নাতকোত্তর করার সুযোগ রয়েছে। সেটা করতে চাইলে কোথায় করবেন?

শাহজাহান: এনার্জি থাকলে সেটা করতে চাই। তবে করে উঠতে পারব কি না, সেটা ঠিক নেই। এখনো সিদ্ধান্ত নিইনি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নেব।

প্রশ্ন :

নতুন প্রজন্ম কেমন পড়াশোনা করছে বলে আপনি মনে করেন?

শাহজাহান: তাদের পড়াশোনার পরিবেশটা আমরাই নষ্ট করেছি। এ জন্য আমি তরুণ প্রজন্মকে দোষ দেব না।

প্রশ্ন :

এত পড়াশোনার প্রাপ্তিটা কী বলে মনে করেন?

শাহজাহান: এবার মৌখিক পরীক্ষার সময় শিক্ষকেরা আমাকে সেই প্রশ্নটাই করেছিলেন। আমি বলেছি, আমার সন্তুষ্টির জন্য আমি পড়ছি। আমি মনে করি, অনেকের মধ্যে আমি একটা রেকর্ড করেছি। এই রেকর্ড ভাঙা অনেকের পক্ষে কঠিন। রেকর্ড না হলে আমি আরও চেষ্টা করব।

প্রশ্ন :

পাঠ্যবইয়ের বাইরের পড়াশোনা সম্পর্কে কিছু বলেন।

শাহজাহান: বাইরের বই-ই তো আমি বেশি পড়ি। তবে তার মধ্যে ইংরেজি সাহিত্যই আমার বেশি প্রিয়। ইংরেজি সাহিত্যের বিভিন্ন দিক আমাকে প্রভাবিত করে। যেমন একজন ইংরেজ কবি বলেছেন, ‘জীবনের সুধা আমি আকণ্ঠ পান করব।’ অর্থাৎ সবটুকু জীবন তিনি সার্থক করে তুলতে চেয়েছেন। আমিও তা–ই মনে করি। জীবনের সবটুকু যেন সার্থক হয়, বৃথা না যায়।