৬০ মামলা ‘ফেলে রাখা’ হয়েছে

  • প্রেশারে’ রাখতেই সরকার মামলা প্রত্যাহার করছে না বলে মনে করছে হেফাজত।

  • ২০১৩ সালের ৫ মের ঘটনায় হেফাজতের বিরুদ্ধে ৮৩ মামলা।

  • ২১ মামলায় অভিযোগপত্র ও ২টিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন।

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ

হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধকে কেন্দ্র করে ১১ বছর আগে সারা দেশে ব্যাপক হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছিল। ওই সব ঘটনায় রাজধানীসহ সারা দেশে ৮৩টি মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে ২১ মামলায় অভিযোগপত্র ও ২টিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। বাকি ৬০ মামলার তদন্তই এখনো শেষ হয়নি।

হেফাজতে ইসলামের অভিযোগ, সরকার হেফাজতের বিরুদ্ধে দায়ের মামলা প্রত্যাহারের আশ্বাস দিয়ে আসছে। কিন্তু কোনো মামলাই প্রত্যাহার করা হয়নি। সরকার তাদের ‘প্রেশারে’ (চাপ) রাখতেই মামলাগুলো প্রত্যাহার করছে না।

অবশ্য পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মামলাগুলোর কী হবে—সে বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে তারা। এ কারণে এসব মামলা ‘ফেলে রাখা’ হয়েছে।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরু হয়।

২১ মামলায় অভিযোগপত্র ও ২টিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন। এর মধ্যে একটির রায়ে সব আসামি খালাস।

ওই আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কথিত নাস্তিক-ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে আন্দোলনে নামে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। ওই বছরের ৫ মে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবরোধ কর্মসূচি শেষে সংগঠনের হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেন। রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বিত অভিযানে তাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান।

এর আগে ওই দিন হেফাজতের কর্মসূচি ঘিরে রাজধানীর পল্টন ও মতিঝিল এলাকায় ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পরদিন ৬ মে চট্টগ্রামের হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জ, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে দুই দিনে সারা দেশে ৩৯ জন নিহত হন।

পুলিশ সূত্র জানায়, এসব ঘটনায় সারা দেশে ৮৩ মামলা করা হয়। এসব মামলায় ৩ হাজার ৪১৬ জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়। হেফাজত ছাড়াও ইসলামী ঐক্যজোট, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির, নেজামে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের এসব মামলায় আসামি করা হয়।

যেসব মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি, সেগুলোর তদন্ত চলছে।
ইনামুল হক, পুলিশ সুপার (এসপি-গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) পুলিশ সদর দপ্তর

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ সদর দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে হেফাজতের মামলাগুলো নিষ্পত্তির পদক্ষেপ নিয়েছিল সরকার। তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে হেফাজতের নেতারা দেখা করেছিলেন। এরপর আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। তাই মামলাগুলো সেই অবস্থায় ‘ফেলে রাখা’ হয়েছে।

গত ৩০ এপ্রিল যোগাযোগ করা হলে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মুহিউদ্দিন রব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, মামলাগুলো বারবার প্রত্যাহারের কথা বলা হলেও আসলে কিছুই করছে না। এইটা আমাদের ‘প্রেশারে’ রাখা।

মুহিউদ্দিন বলেন, জামিনে থাকলেও নেতা-কর্মীদের আজ ঢাকার আদালতে তো কাল চট্টগ্রামের আদালতে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। কারাগারে থাকার চেয়ে এটা কম বিড়ম্বনার নয়।

হেফাজত সূত্র জানায়, এখন তাদের প্রায় সব নেতা-কর্মী জামিনে মুক্ত। সর্বশেষ গত শুক্রবার গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পান সংগঠনের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক।

২০১৩ সালে ওই সংঘর্ষ-সহিংসতার ঘটনায় রাজধানীতে ৫৩টি এবং নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, কক্সবাজার ও লক্ষ্মীপুরে ৩০টি মামলা হয়। হেফাজতের তৎকালীন মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীসহ (প্রয়াত) কয়েকটি দল ও সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় ৮৮ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, সারা দেশের ৮৩ মামলার মধ্যে ঢাকায় ৪টি ও ঢাকার বাইরের ১৭টি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। ২টিতে দেওয়া হয়েছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন। এ ছাড়া ২০১৪ সালে ১৫টি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।
যে চার মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে, তার চারটি বাগেরহাটের। ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে বাগেরহাটে পুলিশের সংঘর্ষে হেফাজতের দুই কর্মী নিহত হন। ওই ঘটনায় জেলার ফকিরহাটে চারটি ও বাগেরহাট সদর থানায় দুটি মামলা করে পুলিশ। এতে হেফাজত, জামায়াত ও স্থানীয় বিএনপির ৮৮ নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ১০-১২ হাজার জনকে আসামি করা হয়।

জেলা পুলিশ জানায়, ছয় মামলার মধ্যে আদালতে চারটির অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৯ সালে ফকিরহাট থানার একটি মামলার রায়ে প্রায় ৪০০ আসামি খালাস পান। দুটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র পুলিশ সুপার (এসপি-গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) ইনামুল হক শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, যেসব মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি, সেগুলোর তদন্ত চলছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্র জানায়, রাজধানীতে হেফাজতের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় করা ৫৩ মামলার মধ্যে মাত্র ৪টির অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। বাকি ৪৯ মামলার মধ্যে থানা-পুলিশ ৩৩টি এবং ১৬টি ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) তদন্ত করছে।

জানতে চাইলে গত ৩০ এপ্রিল ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৩ সালে হেফাজতের বিরুদ্ধে ডিএমপিতে করা ৪৯ মামলার তদন্ত দ্রুত শেষ করে নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।