সুন্দরবনে ৩৫০ বছরের পুরোনো মন্দির

প্রাচীনকালেও সুন্দরবন ও এর আশপাশে যে মানুষের বসতি ছিল, মন্দিরটি তার প্রমাণ বহন করে
ছবি: প্রথম আলো

গহিন বন, চারদিকে ঘন গাছের সারি। এরই মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ইট-পাথরের প্রাচীন এক মন্দির। সেটি ৩০০ থেকে ৩৫০ বছরের পুরোনো বলে মনে করছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। মন্দিরটি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে হাতে তৈরি ইট ও চুন এবং স্থানীয় নদীর বালু।

প্রাচীন ওই মন্দিরের অবস্থান সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগের খুলনা রেঞ্জের কালাবগী ফরেস্ট স্টেশনের আওতাধীন ১৬ নম্বর কম্পার্টমেন্টের শেখের টেক এলাকায়। শিবসা নদীর দক্ষিণ-পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কালীর খাল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণে সুন্দরবনের ভেতরে অবস্থিত মন্দিরটি। নদীপথে খুলনা সদর থেকে ওই স্থানের দূরত্ব প্রায় ৮৫ কিলোমিটার।

মন্দিরের বাইরের দিকে জ্যামিতিক নকশা, ফুল-লতা-পাতাসংবলিত পোড়ামাটির অলংকৃত ইট ব্যবহার করা হয়েছে
ছবি: সংগৃহীত

১৯১৪ সালে প্রকাশিত সতিশ চন্দ্র মিত্রের লেখা যশোহর-খুলনার ইতিহাস, প্রথম খণ্ড বইতেও ওই মন্দিরের উল্লেখ রয়েছে। ওই বইতে মন্দিরের দুটি ছবিও দেওয়া আছে। তবে ওই ছবি কত সালে তোলা তার উল্লেখ নেই। মন্দিরটির স্থাপত্য নকশা অনুযায়ী সেটিকে মোগল আমলে রাজা প্রতাপাদিত্য নির্মাণ করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন সতিশ চন্দ্র মিত্র।

ওই মন্দিরের কয়েক কিলোমিটার আগে শিবসা নদীর পাড়ে আরও কিছু প্রাচীন স্থাপনার নির্দশন রয়েছে। সেগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। রয়েছে শুধু ইটের স্তূপ। ওই স্থাপনার চারপাশ ঘিরে যে মোটা ইটের দেয়াল ছিল, সেটির প্রমাণ এখনো রয়েছে। নদীভাঙনে ওই প্রাচীন স্থাপনা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার লেখা বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ বইতে ওই স্থাপনার কথা উল্লেখ রয়েছে। তিনি ওই স্থাপনাকে শেখের বাড়ি বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, ওই স্থাপনাটি ছিল দ্বিতল ভবন।

সম্প্রতি বন বিভাগের সহায়তায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনার একটি দল ওই মন্দিরটি ও আশপাশের প্রাচীন স্থাপনা পরিদর্শন করেছে। যেহেতু মন্দিরটি এখনো অক্ষত আছে, তাই সেখান থেকে নিয়ে আসা মাপের ভিত্তিতে ওই মন্দিরের একটি নকশাও তৈরি করেছেন ওই দপ্তরের কর্মকর্তারা। ওই নকশা অনুযায়ী, মন্দিরের বাইরের অংশ ৬৫৫ সেন্টিমিটার বর্গাকার। আর ভেতরের অংশ ৩২৫ সেন্টিমিটার বর্গাকার। দেয়ালের পুরত্ব ১৬৫ সেন্টিমিটার। ভেতরে উত্তর দিকে একটি ছোট কুঠরি রয়েছে। দক্ষিণ ও পশ্চিম পাশে রয়েছে ৯৭ সেন্টিমিটার চওড়া দুটি প্রবেশপথ।

মন্দিরের ছাদ চারচালা রীতিতে এক গম্বুজ দ্বারা নির্মিত। নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে পাতলা ইট। মন্দিরের বাইরের দিকে জ্যামিতিক নকশা, ফুল-লতা-পাতাসংবলিত পোড়ামাটির অলংকৃত ইট ব্যবহার করা হয়েছে।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বলছে, মন্দিরটির দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রবলভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। অভ্যন্তরের বিভিন্ন স্থানেও ফাটল ধরেছে। মন্দির তৈরিতে স্থানীয় শামুকের তৈরি চুন ও শিবসা নদীর বালু ব্যবহার করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে। রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়া গেলেই বলা সম্ভব হবে প্রকৃতপক্ষে গাঁথুনিতে কী কী উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে।

মন্দিরটির চূড়া বিভিন্ন ধরনের গাছপালায় পরিপূর্ণ। বড় বড় গাছের শিকড় প্রবেশ করে মন্দিরের ডোম ও দেয়ালগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ইতিমধ্যেই ফাটল ধরেছে ডোম ও দেয়ালে। ওই ফাটলের কারণে মন্দিরের ডোম, দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ এবং উত্তর-পূর্ব কোণের অংশের ইট খসে পড়ছে। রোদ প্রবেশ করতে না পারায় স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছে মন্দিরের দেয়াল।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা ও বরিশালের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান জানালেন, মন্দিরটি আনুমানিক ৩০০-৩৫০ বছর আগে নির্মিত বলে এর স্থাপত্যিক কাঠামো ও শিল্পশৈলী দেখে অনুমান করা হচ্ছে।

প্রাচীনকালেও সুন্দরবন ও এর আশপাশে যে মানুষের বসতি ছিল, ওই মন্দিরটি তার প্রমাণ বহন করে। মন্দিরটি সংরক্ষণ করতে না পারলে অচিরেই তা ধ্বংস হয়ে যাবে। বন বিভাগের সহযোগিতা পেলে সেটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চাইলে ওই মন্দির সংরক্ষণের জন্য বন বিভাগ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। জানালেন সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন।