সাত্তারকে জেতাতে মরিয়া আ.লীগ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল ও আশুগঞ্জ) আসনের উপনির্বাচনে বিএনপির দলছুট নেতা উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াকে জেতাতে মরিয়া আওয়ামী লীগ। নিজ দলের প্রার্থীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করিয়েই তারা ক্ষান্ত হয়নি। দ্বন্দ্ব-বিভক্তি ভুলে উকিল আবদুস সাত্তারের পক্ষে নির্বাচন করছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। উকিল সাত্তারের নির্বাচনী এজেন্টও হচ্ছেন তাঁরা। সাত্তারের একতরফা জয় নিশ্চিতে নির্বাচনে থাকা অন্য তিন প্রার্থীকে একরকম নির্বাচন থেকে ‘সরিয়ে দেওয়া’ হয়েছে।

নির্বাচনে সাত্তার ভূঁইয়ার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী আশুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবু আসিফ আহমেদ গত শুক্রবার থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। গতকাল সোমবার রাত পর্যন্ত তাঁর কোনো খোঁজ মেলেনি। উকিল আবদুস সাত্তার বাদে বাকি তিনজন প্রার্থীর সমর্থকদের অভিযোগ, পুলিশের পক্ষ থেকে তিন দিন ধরে তাঁদের কর্মী-সমর্থক ও এজেন্টদের তালিকা করা হচ্ছে এবং দেখানো হচ্ছে ভয়ভীতি। উকিল আবদুস সাত্তারকে নির্বাচনে জিতিয়ে আনতে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে নানা তৎপরতা চালানো হচ্ছে বলে স্থানীয় বিভিন্ন দলের নেতারা বলছেন।

আরও পড়ুন

উকিল সাত্তারের নির্বাচনী প্রচারে সরব ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এ নির্বাচনকে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন। তাঁরা উকিল আবদুস সাত্তারের জয় নিশ্চিত করে দলের সর্বোচ্চ মহলকে উপহার হিসেবে দিতে চান। জাপার প্রার্থীর লোকজনও এখন সাত্তারের পক্ষে কাজ করছেন। ফলে অনেকটা ‘ফাঁকা পোস্টে গোল’ দিতে চলেছেন উকিল সাত্তার।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া বিজয়ী হয়েছিলেন। গত ১১ ডিসেম্বর তিনি দলীয় সিদ্ধান্তে জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করায় আসনটি শূন্য হয়। আগামী বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) এ আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

৮ জানুয়ারি এ উপনির্বাচনের মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের পর আটজনের প্রার্থিতা বৈধ ঘোষণা করা হয়। তাঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগের তিনজন স্বতন্ত্র প্রার্থী নিজেদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। পরে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান জাতীয় পার্টির দুবারের সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধাও।

নির্বাচনী মাঠে আছেন আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া (কলার ছড়া), আশুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবু আসিফ আহমেদ (মোটরগাড়ি), জাপার কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব আবদুল হামিদ ভাসানী (লাঙ্গল) ও জাকের পার্টির জহিরুল ইসলাম (গোলাপ ফুল)।

আরও পড়ুন

স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উকিল সাত্তারকে বিনা বাধায় জিতিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয় আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে। ১৪ জানুয়ারি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের নেতৃত্বে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে আওয়ামী লীগের তিন স্বতন্ত্র প্রার্থী নিজেদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। এরপর থেকে দলের নেতা-কর্মীরা আবদুস সাত্তারের পক্ষে একত্র হওয়া শুরু করেন।

প্রচারের বিভিন্ন পর্যায়ে উকিল সাত্তার সমর্থক গোষ্ঠীর ব্যানারে কর্মিসভা, পরামর্শ সভা করা হয়। এসব সভায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। আওয়ামী লীগের যে তিনজন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার পর দলীয় সিদ্ধান্তে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছিলেন, তাঁরাও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সভাগুলোতে উপস্থিত ছিলেন। কর্মিসভায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এবং সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও সরাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উম্মে ফাতেমা নাজমা বেগম অংশ নেন।

গত সোমবার আশুগঞ্জে আবদুস সাত্তারের কর্মিসভায় প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমেদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার রাজনীতি বোঝেন না। আওয়ামী লীগ যেকোনো জিরোকে হিরো করতে পারে, হিরোকে জিরো করতে পারে। ১ তারিখ সন্ধ্যার পরে খবর হবে, এখানে কলার ছড়ি জিতেছে। নৌকা জিতেছে। কলার ছড়ির অপর নাম নৌকা।’

আরও পড়ুন

স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা যায়, সাত্তারকে জেতাতে জনপ্রতিনিধি এবং আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের দায়িত্ব দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মেম্বার-চেয়ারম্যানদের। কলার ছড়া প্রতীকে (আবদুস সাত্তার) ভোট নেওয়ার দায়িত্ব আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের। ভোটাররা বলছেন, সরকার ও সরকার-দলীয় নেতা-কর্মীরা সাত্তারকে জেতাতে মরিয়া। তাই নির্বাচনের ফল সাত্তারের পক্ষেই যাবে, এটা সবাই বুঝতে পারছেন। ফলে এ নির্বাচন নিয়ে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে আগ্রহ নেই বললেই চলে।

এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আল মামুন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির সংরক্ষিত সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা আশুগঞ্জে সভা করে এ নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দেন। নির্বাচন যেন নির্বিঘ্ন হয়, সে জন্য আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মাঠে নেমেছেন। এ ছাড়া দলের প্রার্থী না থাকায় তাঁরা স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছেন।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা যায়, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যাঁরা পদে আছেন, তাঁদের সমন্বয়ে এজেন্ট নিয়োগ কমিটি করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা-কর্মী ও স্বজনদের ভোটকেন্দ্রে সাত্তারের নির্বাচনী এজেন্ট করা হচ্ছে। যেমন সরাইল সদর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাংগঠনিক সম্পাদক নাসু মিয়ার মেয়ে পপি বেগমকে পূর্ব কুট্টাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নারী ভোটকেন্দ্রের এজেন্ট করা হয়েছে।

আশুগঞ্জ উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি শাহীন সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, এখানে দলীয় কোনো প্রার্থী নেই। আওয়ামী লীগ আবদুস সাত্তারকে সমর্থন দিয়েছে। তাই আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা-কর্মীরা ভোটকেন্দ্রে ওনার (উকিল সাত্তার) এজেন্ট হবেন।

সরাইল ও আশুগঞ্জ উপজেলার ১৭টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের মোট ভোটার ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৩১৯ জন। মোট ১৩২টি কেন্দ্র ও ৮২৬টি ভোটকক্ষে ভোট গ্রহণ হবে। এ নির্বাচনে কোনো ভোটকক্ষেই ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা (সিসি ক্যামেরা) থাকছে না। এ বিষয় নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করছেন সাত্তারের বিরোধী প্রার্থীরা।

খোঁজ মেলেনি মূল প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর

নির্বাচনে আবদুস সাত্তার ভূঁইয়ার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু আসিফ আহমেদ। তিনি আশুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। কয়েক দিন ধরেই নির্বাচন থেকে আবু আসিফকে সরে দাঁড়ানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠে। আবু আসিফের নির্বাচনী প্রচারের দায়িত্বে থাকা কর্মী-সমর্থকদের হয়রানি ও ভয়ভীতি দেখানোরও অভিযোগ করা হয়।

এর মধ্যেই আবু আসিফের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, গত শুক্রবার রাত থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না তাঁরা। তিনি নিখোঁজ রয়েছেন। গত শুক্রবার থেকে গতকাল সোমবার পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকার কোথাও প্রচারেও দেখা যায়নি আসিফকে। আবু আসিফের ‘নিখোঁজ’ হওয়ায় নির্বাচনে সাত্তারের জয়ের পথ আরও সহজ হবে বলে মনে করছেন স্থানীয় রাজনীতিকেরা।

অবশ্য জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের দাবি, আবু আসিফের নিখোঁজের বিষয়টি বিএনপির অভ্যন্তরীণ ঝামেলা। তিনি বলেন, আবু আসিফের নির্বাচন নিয়ে তাঁদের নিজেদের মধ্যে সমস্যা থাকতে পারে।

নিখোঁজের ঘটনার তদন্ত হবে

আবু আসিফ আহমেদ নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা গতকাল নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একজন প্রার্থীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি নিখোঁজ কবে হলেন, কীভাবে হলেন, কী সমাচার, এই বিষয়গুলো জানতে চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা একটা খবরে দেখতে পাচ্ছি, তাঁকে নাকি আটকে রাখা হয়েছে। ঘটনার সত্যতা কতটুকু, এটা জানার জন্যই তদন্ত করতে বলেছি।’ তিনি বলেন, স্থানীয় জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি) ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে ঘটনা তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

তবে এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসিফের পরিবার থেকে এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ দেওয়া হয়নি। গত রোববার বিষয়টি গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পারি। এরপর সম্ভাব্য সব জায়গায় তার খোঁজ করার চেষ্টা চলছে।’

এর আগে গত বুধবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে ‘নিখোঁজ’ হন আবু আসিফের নির্বাচন পরিচালনার প্রধান সমন্বয়কারী ও তাঁর শ্যালক শাফায়াত সুমন। এ ছাড়া আবু আসিফের নির্বাচনী প্রচারণার দায়িত্বে থাকা মুসা মিয়াকে ওই দিন দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

মাঠে নেই, তবু এজেন্টদের ভয়ভীতির অভিযোগ

এ আসনের অন্য দুই প্রার্থী জাপার আবদুল হামিদ ভাসানী ও জাকের পার্টির জহিরুল ইসলাম। এলাকায় তাঁদের পরিচিতি কম। নির্বাচনী মাঠেও তাঁরা সেভাবে নামেননি। এই দুজন প্রার্থী অভিযোগ করেন, ‘তিন দিন ধরে আমাদের নেতা-কর্মী ও এজেন্টদের তালিকা করছে পুলিশ প্রশাসন। এতে আমার লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে। নেতা–কর্মীরা অনেক জায়গাতেই এজেন্ট হতে চাইছেন না।’

এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন বলেন, প্রার্থীদের এজেন্টদের ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগটি সঠিক নয়। এজেন্টদের কোনো তালিকাও করা হয়নি।

এদিকে জাপার নেতা-কর্মীরাও এখন নিজ দলের প্রার্থী রেখে আবদুস সাত্তারের পক্ষে মাঠে নেমেছেন।

২ জানুয়ারি উপজেলা বিএনপির নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াকে সরাইলে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। পাশাপাশি এ উপনির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। ঘোষণা দিলেও মাঠে নেই সরাইল উপজেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। গ্রেপ্তার–আতঙ্কে অনেকে এলাকা ছেড়েছেন।