৪০ বছর দুঃসহ যন্ত্রণা বয়ে চলেন এনামুল, ঢাকায় অস্ত্রোপচারে স্বস্তির আশা

অস্ত্রোপচারের পর স্ত্রী ও ছেলের সঙ্গে এনামুল হকছবি: সংগৃহীত

‘মুখের টিউমারের জায়গায় ঝিলিক মারে। মাথায় যন্ত্রণা হয়। নিশ্বাস নিতে পারি না। বাঁ চোখেও দেখি না। কাছে কেউ আসতে পারে না। সে এক মরণযন্ত্রণা।’ কথাগুলো নড়াইলের মো. এনামুল হকের। মুঠোফোনে এটুকু বলার পর ৫০ বছর বয়সী এনামুল বললেন, ‘তবে অপারেশনের পর এখন খুব ভালো আছি। চিকিৎসকদের মঙ্গল হোক।’

১৯৮৫ সালে ফুটবল খেলতে গিয়ে এনামুল হক ব্যথা পেয়েছিলেন। মুখের বাঁ পাশে (নাকসহ চোখের নিচে) ব্যথার জায়গায় প্রথমে রক্ত জমাট বাঁধে। তারপর টিউমার হয়। সেখান থেকে পুঁজ ঝরে। তখন এনামুলের বাবা কলকাতায় নিয়ে তাঁর চিকিৎসা করান। তবে অস্ত্রোপচারের পর টিউমারটা বড় হয়ে মুখটা অস্বাভাবিক আকৃতির হয়ে যায়। নাক ও চোখ প্রায় ঢেকে যায় টিউমারে। তাই গত প্রায় ৪০ বছরে আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আবারও অস্ত্রোপচার হয়েছে এনামুলের। এর পর থেকে নিজেকে অনেকটাই সুস্থ ভাবছেন ও জীবনটা স্বাভাবিক হওয়ার পথে বলে মনে করছেন তিনি। স্বপ্ন দেখছেন পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবনে ফেরারও।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, এনামুলের যে সমস্যা, সেটিকে বলা হয় আঘাতজনিত টিউমার ও পরে মিশ্র সংক্রমণের কারণে সৃষ্ট মুখমণ্ডলের বিকৃতি। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের অরেঞ্জ ইউনিটের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক প্রদীপ চন্দ্র দাসের নেতৃত্বে এনামুলের অস্ত্রোপচার হয়। সকাল আটটায় শুরু হয়ে শেষ হয় রাত আটটায়।

ছেলে শেখ সম্রাট প্রথম আলোকে বলে, ‘আমি জন্মের পর থেকেই বাবার এমন চেহারা দেখছি। বাবার বিকৃত মুখ কখনোই আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগেনি। ক্যাডেট কলেজে ভর্তির পর বাবার সঙ্গে ছবি তুলতে চাইলে বাবা রাজি হচ্ছিলেন না। তখন প্রথম বুঝতে পারি, বাবা এই বিষয়টাতে কত কষ্ট পাচ্ছেন।

দীর্ঘ প্রায় ৪০টি বছর এনামুলের পরিবারের সদস্যদেরও অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। স্থানীয় ও ঢাকার বড় বড় হাসপাতালে চিকিৎসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে এনামুলের চিকিৎসার কাগজপত্র পাঠিয়ে পরামর্শ চেয়েছে তাঁর ছেলে শেখ সম্রাট। ‘অনেক দেরি হয়ে গেছে, এ মুহূর্তে সমস্যা খুবই জটিল, অস্ত্রোপচার করা প্রায় অসম্ভব’—মোটামুটি এমন উত্তর আসে সেসব জায়গা থেকে।

সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতাল জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও এনামুলের অস্ত্রোপচারে রাজি হয়েছিল। কিন্তু প্রায় দুই কোটি টাকা খরচের কথা জানিয়েছিল তারা। ফলে তাঁর পরিবারের পক্ষে তা আর করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে এবার দেশেই অস্ত্রোপচারের পর থেকে খানিকটা স্বস্তি নেমে এসেছে পরিবারটিতে।

এনামুল হকের এক মেয়ে। তাঁর বিয়ে হয়েছে। ছেলে শেখ সম্রাট ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে পড়ছে। গত ২৪ জানুয়ারি এনামুল ভর্তি হন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। ৪৭ দিন ভর্তি থেকে অস্ত্রোপচার শেষে এনামুল পবিত্র রমজান মাস শুরুর আগে বাড়ি ফিরেছেন।

গত বৃহস্পতিবার মুঠোফোনে কথা হলো এনামুল ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। এনামুল এখন আগের চেয়ে স্পষ্ট করে কথা বলতে পারেন। আগে মুখ হাঁ করে নিশ্বাস নিতেন। এখন নাক দিয়ে নিতে পারছেন। দুই চোখে একসঙ্গে একই জিনিস দেখতে পেতেন না, এখন সে সমস্যাও নেই। মুখের বিকৃতি আছে, তবে আগের তুলনায় তা কিছুই নয়।

এখন আমরা একটা নতুন জীবন পেয়েছি মনে হচ্ছে
শাবানা বেগম, এনামুল হকের স্ত্রী

এনামুল হক নারকেলের ব্যবসা করেন। তবে তাঁর কাছে তেমন কেউ আসতে চান না বলে মুঠোফোনে কথা বলেই এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। নিজের দুর্ভোগের কথা বলতে গিয়ে বললেন, ‘ছেলেটার পড়া নষ্ট হবে, স্ত্রী চিন্তা করবে, তাই আমার যন্ত্রণা গোপন রাখতে চেষ্টা করি প্রায় সময়। কিন্তু বছরখানেক আগে যন্ত্রণায় আর তা গোপন রাখতে পারিনি। টিউমারের ভেতর পোকা হয়ে গিয়েছিল।’

ছেলে শেখ সম্রাট প্রথম আলোকে বলে, ‘আমি জন্মের পর থেকেই বাবার এমন চেহারা দেখছি। বাবার বিকৃত মুখ কখনোই আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগেনি। ক্যাডেট কলেজে ভর্তির পর বাবার সঙ্গে ছবি তুলতে চাইলে বাবা রাজি হচ্ছিলেন না। তখন প্রথম বুঝতে পারি, বাবা এই বিষয়টাতে কত কষ্ট পাচ্ছেন। আর মা তো সারা জীবনই কষ্ট করছেন।’ সে বলেন, ‘আমি সব সময় চেয়েছি বাবা ও মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে। এবার মনে হচ্ছে, আমার সেই চাওয়া পূরণ হওয়ার পথে। এবার হাসপাতাল থেকে ফেরার পর থেকে বাবা ও মায়ের মুখে হাসি দেখেছি।’

এই রোগী ৩৭ বছর ধরে অনিয়মিতভাবে দেশে-বিদেশে চিকিৎসা নিয়েছেন। সমন্বিত ও নিয়মিত চিকিৎসা করা হলে অনেক আগেই রোগমুক্তি সম্ভব ছিল।
প্রদীপ চন্দ্র দাস, সহযোগী অধ্যাপক, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট

সেই ১৯৮৫ সাল থেকে বাবা যন্ত্রণা সহ্য করছেন জানিয়ে শেখ সম্রাট বলে, ‘কখনো কম আবার কখনো বেশি—এভাবে যন্ত্রণা হতেই থাকে। তবে ২০২০ সালের শুরু থেকে বাবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এবার আমেরিকায় থাকা পরিচিত চিকিৎসক জাহিদ হাসান ভাইয়ের মাধ্যমে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন আমার বাবার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া। চিকিৎসক প্রদীপ চন্দ্র দাস সাহস করে এগিয়ে এসে সফল অস্ত্রোপচার করে ইতিহাস তৈরি করেছেন।’

এনামুল হক বিয়ে করেছেন ২০০০ সালে। স্ত্রী শাবানা বেগম জানালেন, পারিবারিকভাবেই তাঁদের বিয়ে হয়। বললেন, ‘মানুষের সামনে কখনো আমার সমস্যার কথা বলতাম না। আমার দুই ছেলে–মেয়েও তাদের বাবার এমন অবস্থায় কোনো দিন তাঁকে অবহেলা করেনি। এখন আমরা একটা নতুন জীবন পেয়েছি মনে হচ্ছে।’

আরও পড়ুন

চিকিৎসকের বক্তব্য

সহযোগী অধ্যাপক প্রদীপ চন্দ্র দাস প্রথম আলোকে তাঁর অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে বলেন, ‘অস্ত্রোপচারের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে রোগীর টিউমার থেকে মাংস নিয়ে পরীক্ষা করার কথা ছিল। আমি মুখে সাধারণ মাস্ক দিয়ে অস্ত্রোপচার কক্ষে (ওটি) ঢুকি। তবে গন্ধে (টিউমার থেকে বের হওয়া) ততক্ষণে ওই কক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্তরা বের হয়ে গিয়েছিলেন। আমি প্রায় অচেতন হয়ে যাচ্ছিলাম গন্ধে। পরে ওটি থেকে বেরিয়ে নাকে স্কচটেপ লাগিয়ে ঢুকে বাকি কাজ শেষ করি। গন্ধে আমাদের এ অবস্থা হলেও রোগী কিন্তু গন্ধ পাচ্ছিলেন না।’

প্রদীপ চন্দ্র দাস (পি সি দাস নামে পরিচিত) আরও বলেন, এনামুল হকের যে সমস্যা, তা বিরল ঘটনা বলা যেতে পারে। কারও কারও ক্ষেত্রে সাধারণ আঘাতজনিত ঘটনার জটিলতায় শরীরের মাংসপেশি বা অন্য কোনো টিস্যু/কলা হাড়ে রূপান্তরিত হতে পারে; যা থেকে ‘ওসিফাইং ফাইব্রোমা’ পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু অস্বাভাবিক এই হাড়ে বা টিউমারে ইনফেকশন হয়ে এভাবে প্রায় পুরো মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়লে একে বিরল ঘটনাই বলতে হবে।

এই চিকিৎসক বলেন, এনামুল হকের ওপরের চোয়াল, অক্ষিকোটর, ব্রেনের তলদেশ ও তালু পর্যন্ত মাল্টিপল সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছিল। এর চিকিৎসা, সংক্রমণ হওয়া হাড়গুলো ফেলে দিতে হবে। তাঁর মুখের ভেতরে হাড়ের যে অবস্থা ছিল, তাতে প্রায় সব হাড়ই ফেলে দেওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তা করলে মুখের অস্তিত্ব বলতে কিছু থাকত না। অস্ত্রোপচারের পর যে গর্ত তৈরি হবে, তা ভরাট করে আবার স্বাভাবিক আকৃতি দেওয়াসহ পুরো প্রক্রিয়াই খুব জটিল ছিল। তাই এর আগে অনেকেই অস্ত্রোপচারে রাজি হচ্ছিলেন না।

প্রদীপ চন্দ্র দাস বলেন, ‘রোগীর ইচ্ছাশক্তি দেখে এবং আমার চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভিজ্ঞতায় অস্ত্রোপচার করেছি। পচা হাড় ফেলে দিতে হয়েছে। রোগীর ঊরু থেকে চামড়া-মাংসের ফ্ল্যাপ নিয়ে মাইক্রোসার্জারির মাধ্যমে গলার সংযোগ স্থাপন করে গর্ত ভরাট করতে হয়েছে। অস্ত্রোপচারের পর দুই সপ্তাহ গলায় ছিদ্র করে রক্তের শিরার মাধ্যমে খাবার দিতে হয়েছে।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওরাল ও ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক চিকিৎসক উদয় কুমার গোস্বামী ও চক্ষু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুক্তি রানী এনামুলের অস্ত্রোপচারে প্রদীপ চন্দ্র দাসের দলকে সহায়তা করেন।

প্রদীপ চন্দ্র দাস বলেন, মুখের আকৃতি টিকিয়ে রাখতে এনামুলের সংক্রমিত সব হাড় ফেলে দেওয়া সম্ভব হয়নি। হাড়গুলো কোন জীবাণুর মাধ্যমে আক্রান্ত হয়েছে, তা চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হয়েছে। প্রায় ছয় মাস রোগীকে এ অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হবে। আশা করা হচ্ছে, এতে হাড়গুলো ভালো হয়ে যাবে।

অস্ত্রোপচারকারী এই চিকিৎসক বললেন, ‘এই রোগী ৩৭ বছর ধরে অনিয়মিতভাবে দেশে-বিদেশে চিকিৎসা নিয়েছেন। সমন্বিত ও নিয়মিত চিকিৎসা করা হলে অনেক আগেই রোগমুক্তি সম্ভব ছিল। এখন জটিল অবস্থায় প্রথম ধাপের অস্ত্রোপচার আশাতীতভাবে সফল হয়েছে। নিয়মিত ফলোআপ চিকিৎসায় উনি রোগমুক্ত হবেন বলেই আমার বিশ্বাস।’