নিজের লেখা প্রচারে আগ্রহ কম ছিল আবুল হাসনাতের

মাহমুদ আল জামান নামে লেখা আবুল হাসনাতের তিনটি কাব্যগ্রন্থের ১৫৭টি কবিতা নিয়ে কবিতাসমগ্র–এর মোড়ক উন্মোচন

আবুল হাসনাতের কবিতাসমগ্র গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে (বাঁ থেকে) নাসিমুন আরা হক, মুহম্মদ নূরুল হুদা, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সুব্রত বড়ুয়া, মুনতাসীর মামুন, মতিউর রহমান ও মনিরুল হক। গতকাল বিকেলে রাজধানীর বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান মিলনায়তনে
প্রথম আলো

আবুল হাসনাত কখনো প্রথাগত ধারায় কবিতা লেখেননি। নিজের লেখাকে কখনো সম্পাদনার দায়িত্বের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেননি। তাই প্রয়াত এই সাহিত্যিকের আরেক নাম যে মাহমুদ আল জামান, এই পরিচয় অনেক পাঠকই জানেন না। জীবনের দীর্ঘ সময় দৈনিক সংবাদ–এর সাহিত্য বিভাগ এবং কালি ও কলম পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বে থাকলেও নিজের লেখার প্রচারে ছিল তাঁর কুণ্ঠা। অথচ তিনি কবিতানুরাগী সেই তরুণ থেকেই। মাহমুদ আল জামানের (আবুল হাসনাত) কবিতাসমগ্র প্রকাশনা উৎসবে বক্তাদের কথায় উঠে এলো তাঁর অজানা এসব তথ্য।

গতকাল সোমবার বিকেলে বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান হলে এক অনুষ্ঠানে আবুল হাসনাতের কবিতা সমগ্র–এর মোড়ক উন্মোচিত হলো। অনন্যা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এই কবিতাসমগ্র–এ আছে তিনটি কাব্যগ্রন্থ—জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক, কোনো একদিন ভুবনডাঙায় এবং ভুবনডাঙার মেঘ ও নধর কালো বেড়াল–এর মোট ১৫৭টি কবিতা। কবিতার প্রতি আবুল হাসনাতের যে দুর্বলতা ও লেখার প্রতি আগ্রহ, সেই স্মৃতি তুলে আনলেন তাঁর ষাটের দশকের সতীর্থরা। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদারের কণ্ঠে তাঁর লেখা ‘সবিতা হালদার’ কবিতাটি আবৃত্তির মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বললেন, ‘একসময় শিল্প ও সংস্কৃতি রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু ছিল না। আমরা সময়ের সন্তান। আবুল হাসনাত তাঁর সময়ে দায়িত্বটি পালন করে গেছেন।’

এর আগে আবদুল হাসনাত যে প্রকৃত কবি, সে কথা জানিয়ে গেলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৌভিক রেজা। সম্পাদক হিসেবে তিনি নৈর্ব্যক্তিক আর কবি হিসেবে ব্যক্তিগত উল্লেখ করে সৌভিক রেজা বলেন, ষাটের দশক থেকে কবিতা লিখলেও নিজের লেখা প্রথম কবিতার বই প্রকাশ করেন আশির দশকে।

সম্পাদক ও কবিসত্তার মধ্যে আবুল হাসনাতের নীরব বোঝাপড়ার কথা উঠে এলো আরেক সতীর্থ বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ও কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার কথায়। তিনি বলেন, সাহিত্য সম্পাদনার পাশাপাশি নিজেকেও সম্পাদনা করেছিলেন আবদুল হাসনাত।

এর আগে আবুল হাসনাতের স্মরণে কবি ও প্রাবন্ধিক মনজুরে মওলার লেখা কবিতা ‘আকাশই শুধু’ আবৃত্তি করেন আরেক কবি পিয়াস মজিদ। অনুষ্ঠানে তাঁর স্মরণে লেখা কবিতা আবৃত্তি করেন কবি হাসান হাফিজ ও মাহবুব সাদিক।

শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, আবুল হাসনাতকে নিয়ে কথা বলা অতীত মাধুর্যে ফিরে যাওয়ার মতো। নিমগ্ন চিত্তের এমন সম্পাদক বাংলাদেশ আর কখনো পাবে না।

প্রয়াত আবুল হাসনাতের সহধর্মিণী, সাংবাদিক ও নারী নেত্রী নাসিমুন আরা হক মিনু বলেন, তাঁর আরও অনেক কাজ করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু তা যেমন পূর্ণ হয়নি, তেমনি তিনি নিজেও কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি। তবে এখন তাঁর লেখা কবিতা, গদ্য ও প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা হলে অন্তত তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে।

আবুল হাসনাতের রেখে যাওয়া দায়িত্বটি যথাযথভাবে পালনের নানা অভিজ্ঞতার কথা শোনা গেল অনুষ্ঠানের সভাপতি কালি ও কলম সম্পাদক সুব্রত বড়ুয়ার মুখে।

আবুল হাসনাতের কবিতা পৃষ্ঠপোষকতার আরেক ইতিহাস জানা গেল গণমুখী নামে ষাটের দশকের একটি বইয়ের সূত্র ধরে। পশতুসহ কয়েকটি ভাষার ১৯ কবির লেখা ২৮টি কবিতা অনুবাদ করে বই প্রকাশ করেছিলেন তিনি। হারিয়ে যাওয়া গণমুখী নামের সে বই নিয়ে অনুষ্ঠানে এসে বন্ধুর স্মৃতিচারণা করলেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান।

অনুষ্ঠান শেষ হয় সঞ্চালক ত্রপা মজুমদারের কণ্ঠে আবুল হাসনাতের লেখা ‘আমার রোদ্দুর ঢেকে যাচ্ছে কালো মেঘে’ বাক্যটি দিয়ে। ‘শেষ লেখা’ নামের ওই কবিতা ২০২০ সালের ১ নভেম্বর তাঁর মৃত্যুর কয়েক দিন আগে লিখে যাওয়া।