চিকিৎসক নুসরাত জীবিত না মৃত

২০০৭ সালের ৮ সেপ্টেম্বর হাসপাতাল থেকে বাসার উদ্দেশে বের হন নুসরাত। এরপর আর তাঁকে পাওয়া যায়নি।

নুসরাত আলম

ঘটনাটি সাড়ে ১৫ বছর আগের। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার পথে নিখোঁজ হন চট্টগ্রামের এক নারী চিকিৎসক। এরপর মামলা, তদন্ত—কত কিছুই হলো। কিন্তু সেই চিকিৎসকের আর খোঁজ মেলেনি। থানা-পুলিশ, আদালতে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত বাবা। তবু আশা, যদি কোনো খোঁজ পাওয়া যায়।

ওই চিকিৎসকের নাম নুসরাত আলম। নিখোঁজ হওয়ার সময় তাঁর বয়স ছিল ২৬ বছর। তাঁর বাবা নুরুল আলম ভূঁইয়ার ভাষ্যে, ‘জলজ্যান্ত মেয়েটিকে পাওয়াই গেল না। পুলিশ কিছুই করতে পারেনি। জীবিত না মৃত, সেটাও জানি না। মারা গেলে অন্তত কবরটা দেখিয়ে দেন।’

নুসরাত চট্টগ্রাম নগরের ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) এমবিবিএস কোর্সে। ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষে সেখান থেকে এমবিবিএস পাস করেন। পরে তিনি চমেক হাসপাতালে শিশুস্বাস্থ্য বিষয়ে পিজিটি (পোস্টগ্র্যাজুয়েট ট্রেনিং) করছিলেন।

দীর্ঘ সাত বছর থানা, ডিবি, সিআইডি পুলিশ ও আদালতে দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত হয়ে যান মেয়েহারা নুরুল আলম ভূঁইয়া। তিনি আর নারাজি আবেদন দেননি আদালতে।

যেভাবে নিখোঁজ

২০০৭ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। প্রতিদিনের মতো সকালে বাসা থেকে হাসপাতালে যান নুসরাত। দুপুরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে রিকশায় লালখান বাজারের বাসার উদ্দেশে রওনা হন। এর পর থেকে তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। পুলিশ নুসরাতের মুঠোফোনের সর্বশেষ অবস্থান শনাক্ত করে হাসপাতালের কাছে প্রবর্তক মোড়ে।

পরিবার ও সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নুসরাত কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তাঁর পরিবারের কেউ রাজনীতি করেন না। কারও সঙ্গে পরিবারের শত্রুতা নেই। তাঁর সঙ্গে কারও প্রেমের সম্পর্কও ছিল না। পারিবারিকভাবে বাগ্‌দান হয় এক প্রকৌশলীর সঙ্গে। এরপর নিখোঁজ হন।

নুসরাতের বাবা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। এক ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে নুসরাত বড়। ছেলে প্রকৌশলী। একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে শোকে কাতর নুসরাতের মা তামান্না আলম এখনো মেয়ের পথ চেয়ে আছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখনো চেয়ে থাকি মেয়েকে ফেরত পাব। এসে মা বলে ডাকবে। মনকে কীভাবে বোঝাব। অনেক কষ্ট করে মেয়েকে চিকিৎসক বানিয়েছিলাম।’

কথা হয় নুসরাতের কলেজের সহপাঠী পপি আক্তারের সঙ্গেও। তিনি বলছিলেন, এত বছরেও তাঁর খোঁজ না পাওয়া রহস্যজনক। কেন, কী কারণে, কারা তাঁর নিখোঁজের সঙ্গে জড়িত, তা উদ্‌ঘাটনের দাবি জানান তিনি।

প্রকৃত রহস্য উদ্‌ঘাটন করে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হোক। তদন্তকারী সংস্থাই বের করুক তিনি জীবিত না মৃত।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন চট্টগ্রামের সভাপতি অধ্যাপক মুজিবুল হক খান

তদন্তের পর তদন্ত, ফলাফল শূন্য

নুসরাত নিখোঁজ হওয়ার পরদিন (২০০৭ সালের ৯ সেপ্টেম্বর) তাঁর বাবা নুরুল আলম ভূঁইয়া বাদী হয়ে নগরের পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা করেন। থানা-পুলিশ কিছুই করতে না পারায় ছয় মাস পর মামলাটি নগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশে যায়। তারাও কিছু করতে না পেরে দুই বছরের মাথায় (২০০৯ সাল) আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। ডিবিতে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন বর্তমানে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) চট্টগ্রামের পরিদর্শক আবু জাফর মোহাম্মদ ওমর ফারুক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই সময় অনেক চেষ্টা করেও কিছুই পাওয়া যায়নি।

বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। ওই সময় এখানকার মতো এত সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না। থাকলে হয়তো প্রবর্তক মোড় থেকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, জানা যেত। প্রযুক্তিরও এত ব্যবহার ছিল না।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে বর্তমানে অবসরে থাকা কাজল কান্তি চৌধুরী

চাকরিজীবনে কোনো অপূর্ণতা থাকলে এই ঘটনা। তরতাজা একজন চিকিৎসক উধাও হয়ে গেলেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে আবু জাফর ওমর ফারুক বলেন, নুসরাত মুঠোফোন ব্যবহার করতেন। তাঁর সর্বশেষ অবস্থান পাওয়া গিয়েছিল চট্টগ্রাম মেডিকেল–সংলগ্ন নগরের প্রবর্তক মোড়। এতে ধারণা করা হচ্ছে, জড়িত ব্যক্তিরা খুবই চতুর। সর্বশেষ অবস্থান যাতে জানা না যায়, হয়তো ফোনটি ঘটনাস্থলে ধ্বংস করে ফেলে।

ডিবি পুলিশের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি আবেদন করেন নুসরাতের বাবা। আদালত পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) তদন্তের নির্দেশ দেন। কিন্তু সিআইডি কোনো কিনারা করতে না পারায় ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে এ মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। দীর্ঘ সাত বছর থানা, ডিবি, সিআইডি পুলিশ ও আদালতে দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত হয়ে যান মেয়েহারা নুরুল আলম ভূঁইয়া। তিনি আর নারাজি আবেদন দেননি আদালতে।

জানতে চাইলে সিআইডিতে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে বর্তমানে অবসরে থাকা কাজল কান্তি চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। ওই সময় এখানকার মতো এত সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না। থাকলে হয়তো প্রবর্তক মোড় থেকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, জানা যেত। প্রযুক্তিরও এত ব্যবহার ছিল না।

তবু আশা

থানা, ডিবি ও সিআইডি পুলিশ কূলকিনারা করতে না পারায় গত বছরের সেপ্টেম্বরে পিবিআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন নুসরাতের বাবা। তাঁর আশা, পিবিআই যেহেতু অনেক পুরোনো ও সূত্রহীন মামলার রহস্য উদ্‌ঘাটন করছে, তাই তাঁর মেয়ে নিখোঁজের রহস্য তারা বের করতে পারবে। পিবিআইয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তিনি নিজেও কয়েকবার নগরের দেওয়ানহাটে পিবিআই কার্যালয়ে গেছেন।

পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা গত শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসক নুসরাত নিখোঁজের বিষয়টি খুবই গুরুত্ব দিয়ে ছায়া তদন্ত করছে পিবিআই।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন চট্টগ্রামের সভাপতি অধ্যাপক মুজিবুল হক খান বলেন, প্রকৃত রহস্য উদ্‌ঘাটন করে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হোক। তদন্তকারী সংস্থাই বের করুক তিনি জীবিত না মৃত।