এডিসি হারুন, এপিএস আজিজুল প্রসঙ্গ: থানায় নির্যাতন অথবা সহকর্মীকে আঘাত, কী বলছে আইন

সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ডিএমপির রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার হারুন অর রশিদ
ছবি: সংগৃহীত

কোনো ব্যক্তিকে ধরে থানায় নিয়ে নির্যাতনের কোনো সুযোগ নেই। এটা যদি কেউ করে থাকেন, সেটা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।

২০১৩ সালে করা নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে এটাই বলা হয়েছে। জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আইনটি করেছিল।

আবার কোনো সরকারি কর্মচারী তাঁর সহকর্মীকে আঘাত করতে পারেন না। এটা তাঁর অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে। সেটার শাস্তি কী, তা বলা আছে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালায় (২০১৮)।

আরও পড়ুন

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন ও সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে রাজধানীর শাহবাগ থানায় নিয়ে ছাত্রলীগের তিন নেতাকে মারধর ও সহকর্মীকে আঘাত করার অভিযোগের ঘটনায়।

গত শনিবার রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আজিজুল হকের সঙ্গে ব্যক্তিগত বিরোধের জেরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (এডিসি) রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশীদের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের তিন নেতাকে শাহবাগ থানায় নিয়ে মারধর করা হয়।

শাহবাগ থানায় ছাত্রলীগের তিন নেতাকে নির্যাতনের অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েই এডিসি হারুনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে পরবর্তী প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেবে কর্তৃপক্ষ।
মোহাম্মদ নুরুল হুদা, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক

ছাত্রলীগের নেতাদের ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল। তাঁদের মারধরের পর সোমবার এডিসি হারুনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। রাষ্ট্রপতির এপিএসের স্ত্রী এডিসি সানজিদা আফরিন দাবি করেছেন, এপিএস আজিজুল এডিসি হারুনকে প্রথম আঘাত করেছেন। পুলিশ ঘটনাটিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

মানবাধিকার সংগঠন ব্লাস্টের আইন উপদেষ্টা ও সাবেক জেলা জজ এস এম রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৩ সালের নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন অনুযায়ী, পুলিশি হেফাজতে কোনো ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন হচ্ছে ফৌজদারি অপরাধ।

আইনে কী আছে

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের শুরুতে বলা হয়েছে, নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা অমর্যাদাকর আচরণ অথবা শাস্তির বিরুদ্ধে জাতিসংঘ সনদের কার্যকারিতা প্রদানের লক্ষ্যে এই আইন করা হয়েছে।

১৯৮৪ সালের ১০ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার অথবা দণ্ডবিরোধী একটি সনদ স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৯৮ সালের ৫ অক্টোবর ওই সনদে বাংলাদেশও অংশীদার হয়েছে।

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, নির্যাতন বলতে কষ্ট হয়, এমন ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, শাহবাগ থানায় ছাত্রলীগের তিন নেতাকে নির্যাতনের অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েই এডিসি হারুনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে পরবর্তী প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেবে কর্তৃপক্ষ।

মারধরের শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

নুরুল হুদা আরও বলেন, পুলিশি হেফাজতে যেকোনো ধরনের নির্যাতনই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নির্যাতনের অভিযোগে কারও বিরুদ্ধে প্রশাসনিক তদন্ত ও ফৌজদারি বিচার চলতে কোনো বাধা নেই।

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন অনুযায়ী, পুলিশি হেফাজতে কোনো ব্যক্তি যদি নির্যাতনের শিকার হন, তাহলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আদালতে সরাসরি মামলা করতে পারবেন। আবার ভুক্তভোগী ছাড়া তৃতীয় কোনো ব্যক্তি নির্যাতনের বিষয়টি আদালতকে জানাতে পারেন।

ভুক্তভোগী না হওয়া সত্ত্বেও তৃতীয় কোনো ব্যক্তি পুলিশ সুপারের নিচে নয়, এমন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে পারবেন। আবার আদালতের কাছেও তৃতীয় কোনো ব্যক্তি অভিযোগ লিখিত আকারে জানাতে পারবেন।

সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালায় লঘুদণ্ড ও গুরুদণ্ড রয়েছে। লঘুদণ্ডের মধ্যে তিরস্কার, বেতন বৃদ্ধি অথবা পদোন্নতি স্থগিত ইত্যাদি রয়েছে।

ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল প্রথম আলোকে বলেন, ভুক্তভোগীর অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেলে আদালত অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ দেবেন। ভুক্তভোগী সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যদি মনে করেন, পুলিশ দ্বারা সুষ্ঠুভাবে তদন্ত সম্ভব নয়, তাহলে আদালত বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ দিতে পারবেন।

শাস্তি কী

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন বলছে, নির্যাতনের অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। আর নির্যাতনের ফলে যদি কেউ মারা যান, তাহলে অভিযুক্ত কর্মকর্তার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান প্রথম আলোকে বলেন, আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নন। নির্যাতনের ঘটনায় প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি যত দ্রুত সম্ভব নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা দরকার।

আরও পড়ুন

আচরণবিধি কী বলছে

সরকারি কর্মচারীদের জন্য সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা-২০১৮ রয়েছে। এতে অসদাচরণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, অসদাচরণ অর্থ অসংগত আচরণ বা চাকরি শৃঙ্খলার জন্য হানিকর আচরণ, অথবা সরকারি কর্মচারীদের আচরণ-সংক্রান্ত বিদ্যমান বিধিমালার কোনো বিধানের পরিপন্থী কোনো কার্য, অথবা কোনো সরকারি কর্মচারীর পক্ষে শিষ্টাচার-বহির্ভূত কোনো আচরণ।

সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালায় লঘুদণ্ড ও গুরুদণ্ড রয়েছে। লঘুদণ্ডের মধ্যে তিরস্কার, বেতন বৃদ্ধি অথবা পদোন্নতি স্থগিত ইত্যাদি রয়েছে। গুরুদণ্ডের মধ্যে রয়েছে, নিম্ন পদ বা বেতনের নিম্ন ধাপে নামিয়ে দেওয়া, বাধ্যতামূলক অবসর, চাকরি থেকে অপসারণ ও বরখাস্ত করা।

সরকারি চাকরিবিষয়ক আইন ও বিধিবিধানের বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, কোনো সরকারি কর্মচারী যদি অন্য কর্মচারীকে আঘাত করেন, সেটা স্পষ্টই অসদাচরণ। বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়ানো অসদাচরণ তো অবশ্যই, সঙ্গে বাংলাদেশের আইনে এটা ফৌজদারি অপরাধ।

ফিরোজ মিয়া আরও বলেন, রাষ্ট্রপতির এপিএস ও এডিসি হারুনের ঘটনায় গণমাধ্যমে আসা সংবাদে অসদাচরণ ও ফৌজদারি অপরাধের উপাদানগুলো দেখা যাচ্ছে। তদন্ত সাপেক্ষে প্রমাণ পেলে তাঁদের সবার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে হবে।

আরও পড়ুন