মূল ফটক দিয়ে ঢুকে বাঁ পাশে দেখা যায় হরিণের আবাস। সেখানে লাউ, শসার মতো খাবার খাচ্ছিল গোটা ত্রিশেক হরিণ। দর্শনার্থীদের কেউ কেউ পপকর্ন দিচ্ছিলেন, তা–ও খাচ্ছিল হরিণেরা। মাঝেমধ্যে ভয়ে দু–একটি হরিণ দৌড়ও দিচ্ছিল।
আজ সোমবার দুপুরে রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় চিড়িয়াখানায় ঢুকেই এমন দৃশ্য চোখে পড়ল। ঈদের ছুটিতে চিড়িয়াখানায় দর্শনার্থী সমাগম আজ আরও বেড়েছে। চিড়িয়াখানার পশুপাখির স্বভাবসুলভ চঞ্চলতা দর্শনার্থী, বিশেষ করে শিশুরা উপভোগ করেছে। কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য পশুপাখি বিরক্তও হয়েছে।
চিড়িয়াখানর ভেতরে খুব কাছ থেকে বহু মানুষ হরিণ দেখছিলেন। বাচ্চাদের কেউ কেউ সুর তুলে ‘হরিণ হরিণ’ বলছিল। হরিণ দেখছিলেন নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা মো. রাকিব। স্ত্রী, মেয়ে, ভায়রা ও দুই শ্যালিকাকে নিয়ে তিনি ঘুরতে এসেছেন। রাকিব প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় ১৫ বছর পর আজ আবার চিড়িয়াখানায় এলেন।
হরিণ দেখতে গিয়ে বাচ্চাদের কেউ কেউ সরতে চাইছিল না। একজন নারী দর্শনার্থী তাঁর সন্তানকে বলছিলেন, ‘আরও আছে, আরও আছে। সামনে সাপ আছে।’ এই বলে বাচ্চাকে সামনে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
সামনে আরও এগিয়ে গেলে বানরের খাঁচা। সেখানে কয়েকটি ছোট–বড় বানর। এর মধ্যে একটি বানর লোহার জাল ধরে ক্ষণিকের জন্য ফ্লোরে বসে ছিল। এর আড়াই থেকে তিন হাত দূরে প্রাথমিক বেষ্টনী। সেখানে থাকা একজন দর্শনার্থী সেই বানরের উদ্দেশে একটি বাদাম ছুড়ে মারেন। সেটি বানরের কোলে গিয়ে পড়ে। তবে বানরের বাদামের প্রতি আগ্রহ নেই। তারপর আরও দুটি বাদাম ছুড়ে মারেন সেই দর্শনার্থী। বাদামের দিকে মন না দিয়ে অন্যদিকে চলে যায় সেই বানর। এ সময় সেই ব্যক্তি বলছিলেন, ‘বানরের ক্ষুধা নেই, তাই বাদাম খায় না।’
সেই ব্যক্তি যখন বাদাম দিচ্ছিলেন তখন চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ মাইকে একাধিকবার ঘোষণা করছিল প্রাণীদের বিরক্ত না করার জন্য। এ ছাড়া এক শিশুকে দেখা যায়, বানরের প্রাথমিক বেষ্টনী পেরিয়ে ভেতরে চলে যেতে।
বানরের খাঁচার পাশেই পাখির আবাস। পাখির এই খাঁচায় রয়েছে অনেকগুলো কানিবক, ছোট পানকৌড়ি, পেলিকান, গ্রেটার ফ্লেমিংগো, ওয়াক ও কালেম পাখি। কিছু পাখি পানিতে দাঁড়িয়ে, কিছু গাছে আবার কিছু লোহাসহ অন্যান্য স্থাপনায় বসে।
খাঁচার চারপাশে দাঁড়িয়ে এসব পাখি দেখছিলেন অনেকে। এক শিশু তার বাবাকে জিজ্ঞেস করে, ‘বাবা, এই পাখিরা মাছ কই পায়?’ স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে এসব পাখি দেখছিলেন রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকার বাসিন্দা মো. আকাশ। এই ঈদে আজই প্রথম তাঁরা ঘুরতে বেরিয়েছেন। আকাশ প্রথম আলোকে বলেন, এর আগেও তিনি এই চিড়িয়াখানায় এসেছেন। তবে বাচ্চাদের নিয়ে এই প্রথম এলেন। সন্তানদের আবদার মেটানোর জন্যই মূলত তাঁর আসা। তাঁর মেয়ে আজিরননেসা জেসমিন (১১) বলে, এসব পাখি টেলিভিশনে দেখলেও প্রথমবারের মতো সামনাসামনি দেখল সে।
জাতীয় চিড়িয়াখানায় আসা দর্শনার্থীদের মধ্যে মাংসাশী প্রাণী দেখার জন্য একধরনের বাড়তি আগ্রহ থাকে। তাই এসব প্রাণীর খাঁচায় ভিড় লেগে থাকে। একটি খাঁচায় একটি বেঙ্গল টাইগার, যার নাম ‘টগর’। খাঁচার এক কোণে বসে ছিল টগর। লোহার জালের কাছে এসে দর্শনার্থীদের দিকে মুখ করে মাংসের একটি টুকরা খাচ্ছিল সে। এই খাঁচার অন্য দিক ফাঁকা, টগরের সামনে দর্শনার্থীদের ভিড়। বিশেষ করে শিশুদের কেউ বাবার কাঁধে উঠে, কেউ মায়ের কোলে চড়ে, কেউ–বা প্রাথমিক বেষ্টনীতে দাঁড়িয়ে টগরের মাংস খাওয়া দেখছিল।
বেঙ্গল টাইগার দেখার জন্য এক শিশুর বাড়তি আগ্রহ দেখা গেল। সে টগরের খাঁচার সামনে এসে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, রয়েল বেঙ্গল টাইগার কই?’ এক কোণে থাকা টগরকে দেখিয়ে দিয়ে ওর বাবা বলেন, ‘ওই যে বাবা।’ পরে কাছে গিয়ে টগরকে দেখল তারা। একটু পর ওই শিশুকে বলতে শোনা গেল, ‘বাবা, রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখেছি। এবার ভালুক দেখব।’ এরপর তাঁদের চলে যেতে দেখা যায়।
চিড়িয়াখানায় ‘উদ’ বা ভোঁদড়ও রয়েছে। আজ দুপুরে দেখা যায়, ছোট একটি ঘর থেকে পানির চৌবাচ্চায় চারটি ভোঁদড় দৌড়ে নামে। তারা ডুব দিয়ে পানির নিচে থাকছে। আবার উঠছে। নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে। কিছু সময় ধরে চলছিল ভোঁদড়ের জলবিলাস। এর মধ্যে একটি ভোঁদড়কে চৌবাচ্চা থেকে উঠে আসতে দেখা গেল। চৌবাচ্চার পাশে মলত্যাগ করে আবার পানিতে নেমে যায়। তখন একজন বললেন, ভোঁদড় পানিতে মলত্যাগ করে না।
শিশুদের মধ্যে যেন ভোঁদড় নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই। এক শিশু বলে, উদ উভচর প্রাণী। আরেক শিশুকে বলতে শোনা যায়, ‘হাই! ভোঁদড়।’
বিভিন্ন সময় চিড়িয়াখানায় ঘটে যাওয়া ঘটনাও মনে রাখেন দর্শনার্থীরা। হাতি দেখার সময় একজন দর্শনার্থীকে বলতে শোনা যায়, ‘এখানেই তো একজনকে হাতি মেরে ফেলেছিল।’ ২০২৪ সালের ১১ এপ্রিল ঈদুল ফিতরের দিন হাতির আক্রমণে জাতীয় চিড়িয়াখানার মাহুত আজাদ আলীর ১৭ বছর বয়সী ছেলে জাহিদের মৃত্যু হয়েছিল।
স্ত্রী ও আট মাসের কন্যা মেহজাবিনকে নিয়ে হাতি দেখছিলেন মো. মহসিন। তাঁর গ্রামের বাড়ি খুলনায়, কর্মস্থল ঢাকার যাত্রাবাড়ী। এবার তাঁরা ঢাকায় ঈদ করছেন। মহসিন প্রথম আলোকে বলেন, এই ঈদে আজই প্রথম ঘুরতে বের হলেন তাঁরা। চিড়িয়াখানায় এসে পশুপাখি দেখে ভালো সময় কাটছে তাঁদের।
পশুপাখির চঞ্চলতা সবচেয়ে বেশি মানায় প্রকৃতিতে। সেই প্রকৃতির মুক্ত জীবন চিড়িয়াখানার পশুপাখিদের ভাগ্যে জোটে না। তবু তো আর জীবন থেমে থাকে না। এর মধ্যেই যতটুকু আনন্দ নিয়ে থাকা যায়, সেই চেষ্টায় হয়তো থাকে তারা। আর তা দেখে বা তাদের দেখতে পেয়েই আনন্দ দর্শনার্থীদের।
চিড়িয়াখানা সূত্রে জানা যায়, জাতীয় চিড়িয়াখানার আয়তন প্রায় ১৮৭ একর। এতে এখন বাঘ, হরিণ, সিংহ, ভালুক, জিরাফ, হায়েনা, জলহস্তী, কালেম পাখি, পেলিকান, পানকৌড়ি, কানিবক, সাপসহ বিভিন্ন প্রজাতির ৩ হাজার ৩৩২টি পশুপাখি সংরক্ষিত আছে। বড় একটি অঞ্চলজুড়ে গড়ে ওঠা এই চিড়িয়াখানায় এত পশুপাখি দেখতে গিয়ে অনেকেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। অবশ্য চিড়িয়াখানার ভেতরে পর্যাপ্ত গাছপালা রয়েছে। বিশ্রাম করার জন্য অবকাঠামোও আছে। আজ বহু মানুষকে গাছের ছায়ায় ঘাসের ওপর বসে বিশ্রাম নিতে দেখা গেছে। বেশ কিছু পরিবার বিছানার চাদর ও পাটি বিছিয়ে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিয়েছে।
জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক রফিকুল ইসলাম তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, এসব পশুপাখি দেখতে এবার ঈদে আজই সবচেয়ে জনসমাগম হয়েছে জাতীয় চিড়িয়াখানায়। আজ ১ লাখ ২৫ থেকে ৩০ হাজার দর্শনার্থীর সমাগম হয়েছে।
কিছু ব্যতিক্রম
প্রতিবছরই ঈদকে সামনে রেখে জাতীয় চিড়িয়াখানার সামনে ব্যাপক যানজট এবং এতে ভোগান্তি তৈরি হয়। আজ যানজট নিয়ন্ত্রণে মিরপুরের রাইনখোলা মোড় পর্যন্ত বাস যেতে দেওয়া হচ্ছে। সেখান থেকে দর্শনার্থীদের অটোরিকশা, সিএনজি বা হেঁটে চিড়িয়াখানায় যেতে হয়েছে। দেখা যায়, চিড়িয়াখানার প্রধান ফটকের সামনে যানজট সমস্যা নেই।
চিড়িয়াখানার ভেতরে নির্দিষ্ট কিছু খাবারের দোকান আছে। ভ্রাম্যমাণ খাবার বিক্রির অনুমতি নেই চিড়িয়াখানার ভেতরে। আজ দেখা গেছে, চিড়িয়াখানার ভেতরে ভ্যানে করে আম ভর্তা বিক্রি করা হচ্ছে। তাল বিক্রি করতেও দেখা গেছে। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বলেছে, চিড়িয়াখানার ভেতরে থাকা বিভিন্ন ফলের গাছ ইজারা দেওয়া হয়। সেসব গাছের ফল ইজারাদারেরা বিক্রি করেছেন।