জুলাই গণ–অভ্যুত্থান: আহতদের বিদেশে চিকিৎসা, আসছেন বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও

উন্নত চিকিৎসার জন্য ৩০ জনকে বিদেশে পাঠিয়েছে সরকার। দুজন চিকিৎসা শেষে ফিরেছেন। আরও ১২ জন যাচ্ছেন। 

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে আহত এক যুবককে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গত ৪ আগস্ট বেলা তিনটায় চট্টগ্রাম নগরের নিউমার্কেট মোড় এলাকায়ফাইল ছবি: প্রথম আলো

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের মধ্যে এ পর্যন্ত ৩০ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তাঁদের দুজন চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছেন। মন্ত্রণালয় খুব শিগগির আরও ১২ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাবে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আহত ব্যক্তিদের বিদেশে পাঠানোর পাশাপাশি বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এনে এ দেশের হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসা দেওয়ারও চেষ্টা অব্যাহত আছে। গত ২৭ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১০ জনের একটি চিকিৎসক দল বাংলাদেশে এসেছে। ৪ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুর থেকে ৫ জন চক্ষুবিশেষজ্ঞ ঢাকায় আসার কথা আছে। গত কয়েক মাসে থাইল্যান্ড, চীন, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স থেকে বেশ কয়েকটি চিকিৎসক দল আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দিতে বাংলাদেশে এসেছিল।

২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বিদেশে চিকিৎসার জন্য মন্ত্রণালয়ের ব্যয় হয়েছে ১৬ কোটি ১৪ লাখ ৭২ হাজার টাকা। এর মধ্যে একজনের পেছনে খরচ হয়েছে ৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকার বেশি। সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে থাকা ওই আহত ব্যক্তির চিকিৎসা শেষ হতে আরও কয়েক মাস লাগবে বলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আহতরা যেন সর্বোত্তম চিকিৎসা পান, সে জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেশে না থাকলে আমরা অবশ্যই আহতদের বিদেশে পাঠাব। আবার প্রয়োজনে বিদেশ থেকেও চিকিৎসক আনব।’

জুলাই-আগস্টে ঠিক কত মানুষ আহত হয়েছিলেন, তার সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তবে ঠিকানা ও পরিচয় জানা সম্ভব হয়েছে, এমন ১১ হাজার ৫৫১ জনের একটি তালিকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে। সরকার বলছে, এটি খসড়া তালিকা। এ তালিকায় থাকা আহত ব্যক্তিরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা বিনা মূল্যে পাবেন।

সরকার পতনের আগে আহতদের সঠিক চিকিৎসা হয়নি। অনেকে হাসপাতালে ভর্তি হতে ভয় পেয়েছিলেন। হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়ারও অভিযোগ আছে।
নূরজাহান বেগম, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা 

স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বলেন, সরকার পতনের আগে ১৫ থেকে ২০–২১ জুলাই আহত ব্যক্তিদের অনেকেরই সঠিক চিকিৎসা হয়নি। অনেকে হাসপাতালে ভর্তি হতে ভয় পেয়েছিলেন, অনেকে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা না নিয়েই হাসপাতাল থেকে পালিয়েছেন। হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়ারও অভিযোগ আছে। 

বাস্তবে তাঁরা চিকিৎসা পান সরকার পতনের পর আগস্টের মাঝামাঝি থেকে। এত দিনে অনেকের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে।

সর্বশেষ পাওয়া খবরে জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল), বিএসএমএমইউ, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) এখনো ১৩০ জনের মতো আহত চিকিৎসাধীন।

থাইল্যান্ডে ২০ জন চিকিৎসাধীন

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তালিকায় দেখা যায়, ৩০ জন আহত ব্যক্তিকে পাঠানো হয়েছে থাইল্যান্ডের চারটি ও সিঙ্গাপুরের তিনটি হাসপাতালে। থাইল্যান্ডে পাঠানো হয়েছে ২০ জনকে, ১০ জনকে সিঙ্গাপুরে।

সিঙ্গাপুরে পাঠানো আহতদের ৯ জনের চোখে ছররা গুলি লেগেছিল। ১ জনের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত সমস্যা, তাঁর মাথায় গুলি লেগেছিল। থাইল্যান্ডে যাওয়া আহতদের মধ্যে চোখের সমস্যার পাশাপাশি মাথায় আঘাত বা গুলি, স্নায়ুর সমস্যা ও মেরুদণ্ডের রজ্জুতে আঘাতের ঘটনা বেশি। ইতিমধ্যে থাইল্যান্ড থেকে চিকিৎসা নিয়ে দুজন দেশে ফিরে এসেছেন। 

পাবনা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র সাজ্জাদ হোসেনের বাঁ চোখে শটগানের গুলি লাগে ৪ আগস্ট। প্রথমে পাবনায় এবং পরে ঢাকার চারটি হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা হয়। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাঁকে থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে পাঠায়। চিকিৎসা শেষে সাজ্জাদ ২৬ ডিসেম্বর দেশে ফিরেছেন। গতকাল শুক্রবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বাম চোখে দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসেনি। আমাকে আরও আগে চিকিৎসার জন্য পাঠালে হয়তো ৫০-৬০ শতাংশ দৃষ্টি ফিরে পেতাম।’

গত ১৯ জুলাই বাসার নিচে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিল সাত বছরের বাসিত খান মুসা। গত ২২ অক্টোবর তাকে সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে পাঠানো হয়। তার বাবা মুস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক দফা অস্ত্রোপচারের পর এখন শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। এক পাশের হাত ও পা নাড়াতে পারছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গঠিত স্বাস্থ্যবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য শাহরিয়ার মোহাম্মদ ইয়ামিন প্রথম আলোকে বলেন, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে আহত ব্যক্তিদের। অনেকের ক্ষেত্রেই চিকিৎসার ফল ইতিবাচক।

খোকন যাবেন রাশিয়ায়

গুলির আঘাতে মুখের আদল একেবারে বদলে গেছে খোকন চন্দ্র বর্মণের। প্রায় ছয় মাস ধরে খোকন জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। খোকন আহত হন যাত্রাবাড়ী এলাকায়। খুব কাছ থেকে তাঁকে গুলি করা হয়েছিল। তাঁর চোয়াল, নাক ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।

রাশিয়ার মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির ক্লিনিকে খোকন চন্দ্র বর্মণের চিকিৎসা হবে। চিকিৎসকেরা খোকনের মুখের চেহারা আগের মতো করে দেওয়ার জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করবেন বলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আশা করছেন। প্রথমে চোয়াল, তারপর নাক প্রতিস্থাপন করা হবে। পরবর্তী ধাপে মুখের বিভিন্ন ধরনের টিস্যু ঠিক করা হবে। জানা গেছে, খোকন চিকিৎসার জন্য রাশিয়ায় যাচ্ছেন ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। মার্চের শেষ সপ্তাহে চিকিৎসা শুরু হবে।

আধুনিক ফিজিওথেরাপি

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গণ-অভ্যুত্থানের সময় আহত ব্যক্তিদের রোবোটিক ফিজিওথেরাপি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন। এই যন্ত্রের দাম ১২-১৩ কোটি টাকা। উপহার পাওয়া রোবোটিক ফিজিওথেরাপির যন্ত্রপাতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) শহীদ আবু সাঈদ কনভেনশন ভবনে স্থাপন করা হবে। এর সেবা পেতে গণ-অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিরা অগ্রাধিকার পাবেন।

মন্ত্রণালয় নিজ অর্থে আরও দুটি রোবোটিক ফিজিওথেরাপি যন্ত্র চীনের কাছ থেকে কিনবে। একটি চট্টগ্রামে ও অন্যটি রংপুর বা বগুড়ায় স্থাপন করা হবে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের সহায়তার জন্য গঠিত ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ প্রথম আলোকে বলেন, মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশের ভিত্তিতে আহতদের বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে। এই চিকিৎসা ব্যয় সরকার বহন করছে। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন বিদেশে চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সহায়তা করছে। আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিবারের সদস্যরাও বিদেশে যাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে আর্থিক সংকটের কথা জানিয়ে আবেদন করেছেন, এমন পরিবারগুলোকে অর্থসহায়তা দিয়েছে ফাউন্ডেশন।