পরিবার পরিকল্পনার কাজে গতি কম

জনবল ও জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। সমস্যায় নজর নেই পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের।

খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রটি কয়েক মাস ধরে তালাবদ্ধ। গত মঙ্গলবারের ছবিছবি: প্রথম আলো

প্রায় ৯ বছর আগে ২০১৫ সালের ১৪ মে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. নূর হোসেন তালুকদার অধিদপ্তরের সব কর্মকর্তা–কর্মচারীর উদ্দেশে চার পৃষ্ঠার একটি চিঠি লিখেছিলেন। অনিয়ম–দুর্নীতি দূরে ঠেলে জড়তা কাটিয়ে সৎভাবে নিজ দায়িত্বটুকু ঠিকভাবে পালন করার আহ্বান ছিল ওই চিঠিতে।

চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘বর্তমানে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কার্যক্রমে সরকার, ডোনার এজেন্সিসহ ইউএনএফপিএ, বিশ্বব্যাংক—কেউ সন্তুষ্ট নয়।...আমরা যদি কাজ না করি এবং কাজ যে করেছি তার প্রমাণ না দেখাতে পারি, আমাদের দপ্তরের প্রয়োজন কী?’

মো. নূর হোসেন তালুকদার মারা গেছেন। তবে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে কোনো পরিবর্তন আসেনি। অনেকে অভিযোগ করেছেন, পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।

অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, মাঠপর্যায়ে ৯ হাজারের বেশি পদ খালি। অধিদপ্তরের বর্তমান মহাপরিচালক এসব পদে লোক নিয়োগের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না। প্রায় সারা দেশের গুদামগুলোতে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর ঘাটতি রয়েছে। এগুলো ঠিক সময়ে কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। দেশের প্রায় অর্ধেক অঞ্চলে স্বাভাবিক প্রসবের সেবাসামগ্রী নেই। তা কেনারও উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। মানুষ পুরোপুরি সেবা পাচ্ছে না।

পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে অধিদপ্তর মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখানে নেতৃত্বের বড় সংকট চলছে। বহুদিনের জমে থাকা সমস্যা এখন সংকটে পরিণত হয়েছে। পুরো বিষয়টি আদ্যোপান্ত তদন্ত হওয়া দরকার।
আবু জামিল ফয়সাল, জনস্বাস্থ্যবিদ

এমন পরিস্থিতিতে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর কী উদ্যোগ নিচ্ছে, তাদের অবস্থান কী, তা জানার জন্য একাধিকবার অধিদপ্তরে গিয়ে মহাপরিচালক সাহান আরা বানুর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি দেখা করেননি। মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টাও করে তাঁকে পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ ১২ ফেব্রুয়ারি অধিদপ্তরের কার্যালয়ে গিয়েও তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। অধিদপ্তরের একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, তাঁদের গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলা নিষেধ।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের অর্জনে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের বড় ভূমিকা রয়েছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে মোট প্রজননহার কমেছে। মোট প্রজননহার কমার কারণে নারীর গর্ভধারণ কমেছে, মাতৃমৃত্যু কমেছে। এসব নারী স্বাস্থ্যের উন্নতিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। অর্থনীতিবিদদের একটি অংশ এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে নারী স্বাস্থ্যের উন্নতি।

আরও পড়ুন

বর্তমানে মাঠের সেবা পরিস্থিতি

দক্ষিণের জেলা খুলনার সুন্দরবনসংলগ্ন উপজেলা কয়রা। কয়রা উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে ৩৩টি পরিবার পরিকল্পনা ইউনিট রয়েছে। সেগুলোতে পর্যাপ্ত পরিবারকল্যাণ সহকারী (এফডব্লিউএ) নিয়োগ দেওয়া হয়নি। বর্তমানে ২৩ জন পরিবারকল্যাণ সহকারী দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারের ছয়টি পদের মধ্যে চারটি পদ শূন্য।

গত মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের একটি সুরম্য ভবন রয়েছে। তবে মূল দরজায় তালা লাগানো এবং সব কটি কক্ষ বন্ধ। সেখানে কোনো কর্মচারীও নেই। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামনের নলকূপটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে রয়েছে। নিচতলার জানালার কাচ ভেঙে যাওয়ায় ধুলাবালি জমে কক্ষের ভেতরের যন্ত্রপাতি ও আসবাব নষ্ট হওয়ার পথে।

স্থানীয় বাসিন্দা আসাদুল ইসলাম জানান, হাসপাতালটি স্থাপনের পর থেকে মাঝেমধ্যে খুলতে দেখা যায়। তবে ছয় মাস ধরে হাসপাতালটি টানা বন্ধ রয়েছে।

দক্ষিণ বেদকাশী গ্রামের বাসিন্দা আমেনা বেগম বলেন, তাঁর বিয়ে হয়েছে ৯ বছর হলো। দুটি সন্তানও আছে। তবে কখনো কোনো ধরনের পরামর্শ বা সেবা তিনি পাননি। পরিবার পরিকল্পনার কেউ কোনো দিন যাননি। যেকোনো পরামর্শের জন্য স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়।

কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী, উত্তর বেদকাশী ও মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে গিয়ে অন্তত ৫০টি দম্পতির সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলো প্রতিনিধির। এর মধ্যে ২১ জন কখনোই স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের মাধ্যমে সেবা পাননি। ১৩ জন নিজ দায়িত্বে পরিবারকল্যাণ সহকারীর বাড়িতে গিয়ে সেবা নিয়ে আসেন। ১৬ জনের বাড়িতে গিয়ে পরিবারকল্যাণ সহকারীরা সেবা দিয়ে আসেন।

বিষয়টি নিয়ে উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, কয়রা উপজেলা একটি ঘনবসতি এলাকা। এ উপজেলায় পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের ৩৩টি ইউনিট থাকলেও সেগুলো পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত জনবল নেই। জন্মবিরতিকরণ পদ্ধতির জন্য সব ধরনের ওষুধ মজুত থাকলেও ইউনিট কর্মী কম থাকায় সব মানুষের কাছে সেবা পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, একজন মাঠকর্মীর মাসে অন্তত একবার একটি দম্পতির বাড়িতে যাওয়ার কথা। কিন্তু কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলায় চিত্র ভিন্ন। এই উপজেলার মাতারবাড়ী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডে ২ হাজার ৩৮৫ জন সক্ষম দম্পতির জন্য কাজ করছেন একজন পরিবারকল্যাণ সহকারী। এ কারণে তিন মাসেও মাঠপর্যায়ে একটি দম্পতি পরিবারকল্যাণ সহকারীর দেখা পাচ্ছেন না।

মাতারবাড়ী ইউনিয়নের পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক মোহাম্মদ অছিয়র রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ইউনিয়নে ৯ হাজার সক্ষম দম্পতির জন্য নয়জন কর্মী থাকার কথা। আছেন তিনজন পরিবারকল্যাণ সহকারী ও একজন স্বেচ্ছাসেবী।

মাঠপর্যায়ে লোকবল–সংকটের কারণে পরিবার পরিকল্পনার কার্যক্রম কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছে বলে মনে করেন মহেশখালী উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) সৈকত বড়ুয়া।

১১ হাজার ১৪৫টি পদ শূন্য

বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের সাফল্যের পেছনে ছিলেন মাঠকর্মীরা, বিশেষ করে ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট বা পরিবারকল্যাণ পরিদর্শক। এঁরা প্রধানত বাড়ি বাড়ি গিয়ে নতুন বিয়ে হওয়া নারীকে নানা ধরনের স্বাস্থ্যসচেতনতামূলক বার্তা দেন, সঙ্গে দেন জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ হিসাব বলছে, সারা দেশে এ রকম ৪ হাজার ৩৩৪টি পদ খালি আছে।

পরিবারকল্যাণ পরিদর্শকের কাজ তদারকি করেন পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক। সারা দেশে এঁদের ৩৫০টি পদ শূন্য হয়ে আছে। অর্থাৎ ওই সব এলাকায় মাঠকর্মীদের কাজের কোনো তদারকি নেই।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের প্রশাসন বিভাগের সূত্র বলছে, কেন্দ্র থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ে ৩২ ধরনের (ক্যাটাগরি) কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন। এঁদের মোট পদ ৪৮ হাজার ৮৭টি। বর্তমানে নিয়োগযোগ্য শূন্যপদ ১১ হাজার ১৪৫টি। অর্থাৎ ২৩ শতাংশ পদ শূন্য রেখে দিন পার করছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর।

সংকট বড়ি–কনডম–কিটের

সরকারের সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট পোর্টালে দেখা যায়, বিভিন্ন ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর মজুত কমে এসেছে। কোনো কোনো জেলায় মজুত একেবারে শূন্য। গত মঙ্গলবার ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, ২১টি জেলায় কমডম, ২১টি জেলায় ইমপ্লানন, ৬টি জেলায় ‘আপন’ নামের মুখে খাওয়ার বড়ির মজুত শূন্য। মাসিক নিয়মিতকরণ ওষুধ ও সামগ্রী নেই ২২ জেলায়। স্বাভাবিক প্রসবসামগ্রী নেই ২টি জেলায়।

মজুত পরিস্থিতি আরও খারাপ ছিল। এ মাসের শুরুর দিকে প্রথম আলোসহ কয়েকটি গণমাধ্যমে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর মজুত নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়া হয়। অধিদপ্তর সূত্র জানায়, প্রতিবেদন প্রকাশের পর পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর তড়িঘড়ি করে এক জেলার সামগ্রী পার্শ্ববর্তী জেলায় ভাগ করে দিয়ে পরিস্থিতি উন্নতির চেষ্টা করে। এতে জেলাগুলোর মজুত শূন্য না দেখালেও বাস্তবে মজুত পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।

থেমে আছে প্রজননহার

মাঠপর্যায়ে জনবল না থাকা, কাজ যা হচ্ছে তাতে নজরদারি না থাকা, জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর স্বল্পতা—এসব কারণে জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। বাংলাদেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সফল হয়েছিল মূলত মোট প্রজননহার কমানোর মাধ্যমে। স্বাধীনতার সময় একজন প্রজননক্ষম নারী (১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী) গড়ে ছয়টির বেশি সন্তানের জন্ম দিতেন। গত শতকের সত্তরের দশকের শেষে ও আশির দশকের শুরুতে জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করার পর দেশে মোট প্রজননহার ক্রমান্বয়ে কমতে থেকে। কিন্তু ২০১১ সাল থেকে মোট প্রজননহার ২ দশমিক ৩ বা তার আশপাশে থমকে আছে।

পরিবারকল্যাণ সেবা ও মাতৃস্বাস্থ্য নিয়ে চার দশক ধরে কাজ করছেন জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে অধিদপ্তর মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখানে নেতৃত্বের বড় সংকট চলছে। বহুদিনের জমে থাকা সমস্যা এখন সংকটে পরিণত হয়েছে। পুরো বিষয়টি আদ্যোপান্ত তদন্ত হওয়া দরকার।’