ঘর বাঁচল পাখিগুলোর
দিনটা ছিল গত ৭ জুন। ভারী বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির পানিতে ঢাকার আশপাশের ডোবা-নালা পানিতে টইটম্বুর। চারদিকে গাছপালাগুলো সতেজ সবুজ। এ সময় পাখিদের বাসা বানানোর ভরা মৌসুম। পাখিরা তাদের সংসার নিয়ে খুব ব্যস্ত। এবার বেশ কয়েকটা পাখির বাসা রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ির মেট্রোরেল ডিপোর দক্ষিণ পাশের একটি বালুর ঢিবিতে দেখা গেছে। এর একটি বাসা ধলাবুক মাছরাঙার। বাকিগুলো নীললেজ সুইচোরার। সম্ভবত এই সুইচোরাদের একটি বাসা দখল করে মাছরাঙারা সংসার পেতেছে। বাসাগুলোর সন্ধান পেয়েছেন আমার বন্ধু আসকার ইবনে ফিরোজ। তিনি আমাকে পাখির খোঁজখবর দেন। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি ঢাকার পাখির ওপর একটি তথ্যচিত্র বানাচ্ছেন। নাম দিয়েছেন ঢাকার পাখি: ছোট হয়ে আসছে আকাশ। এ কাজ করতে গিয়েই বাসাগুলোর দেখা পান তিনি।
বৃষ্টি কমার লক্ষণ না থাকায় আসকারের মনে হলো, মাছরাঙা ও সুইচোরার বাসাগুলো হয়তো ডুবে যাবে। আর তা ঘটলে ব্যাপারটা খুব খারাপ হবে। চোখের সামনে পাখিগুলোর সংসার শেষ হয়ে যাবে! ভয়ে ভয়ে ৭ জুনই বালুর মাঠে গিয়ে দেখা গেল, এভাবে বৃষ্টি হতে থাকলে বাসাগুলো ডুবে যেতে পারে। কোনো কিছু না ভেবে পানি কমানোর জন্য সেচযন্ত্র লাগানো হলো। ১০ ও ১১ জুন—দুই দিনে পানি সেচে রক্ষা করা হলো পাখিগুলোর বাসা।
সুইচোরারা এ রকম বালুর ঢিবিতে নিয়মিতই বাসা করে থাকে। ঢাকায় এ রকম জায়গা নেই বললেই চলে। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ তাদের কাজের জন্য বালুর স্তূপ করে রেখেছিল। দূর থেকে দেখলে মনে হবে ছোট ছোট বালুর টিলা। সেখানেই কয়েক বছর ধরে সুইচোরারা নিয়মিত বাসা করছে। এ বছর বালুর ঢিবির উচ্চতা কমে গেছে। তারপরও সুইচোরারা সরে যায়নি। জায়গাটিকে নিরাপদ ভেবে বাসা করে। সঙ্গে একটি মাছরাঙাও নির্ভয়ে বাসা বাঁধে। গত ২০ এপ্রিল মাছরাঙাটি জোড়া বাঁধে ও সংসার সাজায়। মে মাসের শেষ ভাগে এই সংসারে আসে চারটি বাচ্চা। বাচ্চাগুলোকেই মা-বাবা যত্ন করে খাবার এনে খাওয়াচ্ছিল। তারপরই এল সেই বৃষ্টি এবং বেধে গেল বিপত্তি।
ধলাবুক মাছরাঙা ও নীললেজ সুইচোরা দুটি প্রজাতিই বাংলাদেশে সহজেই দেখা যায়। সুইচোরারা মূলত নদীর বালুচরে ও অথবা নদীর কিনারায় দলে দলে বাসা করে। একসঙ্গে নদীতীরে অর্ধশত বাসাও আমি দেখেছি। তবে ঢাকায় এই পাখির একসঙ্গে এতগুলো বাসার খবর প্রথম শুনলাম আসকারের কাছ থেকে। অন্যদিকে মাছরাঙারা দল বেঁধে বাসা করে না। একা একা সংসার করে এবং নিভৃতে বাচ্চা ফোটায়।
সেদিন তো বৃষ্টির পানি থেকে রক্ষা পেল মাছরাঙা ও সুইচোরার সংসার। আসকার পানি সেচার কাজ না করলে হয়তো বাচ্চাগুলো মারা পড়ত! আমরা কোনোরকমে রক্ষা করতে পেরেছি পাখিগুলোর বাসা। অন্য কোনো জায়গার খবর আমাদের জানা নেই। হয়তো এ রকম ঘটনা আরও ঘটছে; আমরা কেউ তা খেয়াল করি না!
ঢাকার পাখির আকাশ আসলেই ছোট হয়ে আসছে। চারপাশটা শুধু মানুষেরই জন্য। ঢাকা শহর অন্য প্রাণীর জন্য একটুখানি জায়গাও নেই। কেউ এটা নিয়ে চিন্তাও করে না। এ শহরের কোটি মানুষের জন্য শত শত হাসপাতাল আছে, অথচ প্রাণীদের জন্য হাসপাতাল তো দূরের কথা, একটি বাসা করার জন্য একটুখানি নিরাপদ জায়গাও নেই!
সুইচোরা ও মাছরাঙারা এ বছর কোনোরকমে বেঁচে গেছে। তাদের ‘ঘর’ আলো করে এসেছে ফুটফুটে বাচ্চা। বাচ্চাগুলো এখন বড় হয়ে উড়তে শিখেছে। মা-বাবাকে ছেড়ে বাচ্চাগুলো আলাদা হয়ে গেছে। আগামী বছর এই বালুর মাঠ থাকবে কি না, আমাদের জানা নেই। অথবা বালুর ঢিবির উচ্চতা হয়তো আরও কমে যাবে। আর তা হলে এ এলাকা থেকে সরে পড়বে প্রিয় দুই পাখি—মাছরাঙা ও সুইচোরা।