বিশেষ সাক্ষাৎকার: মেহতাব খানম

গর্ভকালেই শিশুর সুষ্ঠু বিকাশ দরকার

আজ ১০ অক্টোবর ‘বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস’। মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্র্যাক ও প্রথম আলো ডটকম আয়োজন করেছে বিশেষ ক্যাম্পেইন : মনের ব্যথা, বলুক কথা‌। মানসিক সমস্যা থেকেই অনেকে বেঁচে থাকার ইচ্ছা হারিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত সিদ্ধান্ত নেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কেন এমনটা হয়? এ বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খায়রুল বাবুইতারেক মাহমুদ নিজামী

প্রশ্ন:

আমাদের দেশে তরুণ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে জীবন নিয়ে হতাশায় ভোগার হার বেশি। এর পেছনের কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?

মেহতাব খানম: সম্প্রতি আঁচল ফাউন্ডেশনের একটি জরিপে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ‘জীবন নিয়ে নেওয়া’র হারের তথ্য উঠে এসেছে, যাদের বয়স ১৩ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে। এটি সত্যিই চমকে ওঠার মতো। বিষয়টি বুঝতে গেলে শিশুর মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থা থেকে শুরু করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, গর্ভবতী মায়ের সঠিক যত্ন না নিলে অনাগত শিশুরও মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যে প্রভাব পড়ে। তারপর মায়ের গর্ভের শিশুটি যখন পৃথিবীতে আসে, তখন আলো-বাতাস-শব্দে অর্থাৎ নতুন পরিবেশে তার অস্বস্তি হয় এবং সে কান্না শুরু করে। শিশু প্রথম দুই বছর একরকম অসহায় থাকে। কারণ, ক্ষুধা লাগা বা না লাগা বা পেটব্যথার কথা, তার সঙ্গে বিরূপ কোনো আচরণ করা হলে সে কিছু বলতে পারে না। তখন তার প্রকাশের একমাত্র ভাষা হচ্ছে কান্না। সে বোঝাতে চায়, আমি বিষয়গুলো পছন্দ করছি না। হয়তো মা-বাবা ঝগড়া করছেন, সে না বুঝলেও অস্বস্তিতে থাকে। তাই শিশু কোন পরিবেশে বড় হচ্ছে, সেটাও তার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে অনেক মাতা–পিতাই প্যারেন্টিংয়ের যথাযথ ধারণা ছাড়াই সন্তান বড় করে ফেলছেন। সম্পর্কের মধ্যে যদি পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস না থাকে, তাহলে সেটা সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্যেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কিছু মানসিক অসুস্থতার কারণেও অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হয়।
তাই জীবন নিয়ে হতাশায় ভোগা মানুষদের ব্যাপারে গণমাধ্যম, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রকে সচেতন থাকতে হবে। তাঁরা সুন্দর মানুষ হিসেবে গড়ে উঠলে দেশের জন্য অনেক কিছু করতে পারবেন। পাশাপাশি শিক্ষক থেকে শুরু করে আত্মহত্যা প্রতিরোধ ও প্রতিকারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। যেহেতু আমাদের ব্যক্তিত্বের গঠন প্রাক্‌–শৈশব থেকেই শুরু হয়, তাই শুধু পরিবার নয়, প্রাক্‌–প্রাথমিক পর্যায় থেকেই শিক্ষকদের সচেষ্ট থাকতে হবে, যাতে তাঁরা শিশুদের মানসিক বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারেন।

মেহতাব খানম
প্রশ্ন:

আত্মহত্যা সম্পর্কে আমাদের সমাজে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণাগুলো সম্পর্কে আপনার মতামত কী? এসব ভ্রান্ত ধারণা ও প্রচলিত কুসংস্কার কোনো ব্যক্তির ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলে?

মেহতাব খানম: হ্যাঁ, ‘আত্মহত্যাপ্রবণ’ মানুষদের নিয়ে সমাজে কিছু ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। যেমন—

১. ‘যাঁরা নিজেদের আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছেন না, শুধু তাঁরাই এসব ঘটনা ঘটাচ্ছেন। আমি আর বাঁচতে চাই না, এমন কথা যাঁরা বলছেন, এমনিই বলছেন, কিছু করবেন না’—এ ধারণা ঠিক নয়। কারণ, তাঁরা যখন এমন কথা বলেন, সেটার কোনো অর্থ থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষ আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চূড়ান্ত ঘটনা ঘটানোর আগে বেশ কয়েকবার ছোট ছোট চেষ্টা চালিয়ে থাকেন।

২. অনেকেই মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে মনে করেন, ‘এটা এমন গুরুতর বিষয় নয় যে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে। আমরা তো (মা-বাবা) আছি, আমাকে বলো তুমি।’ এমন ভাবাও উচিত নয়।

৩. মানসিক স্বাস্থ্যকে ‘স্বাস্থ্য’ হিসেবেই অনেকে গণ্য করেন না। বেশ কিছুদিন আগে সেতু থেকে যাত্রীবাহী গাড়ি নদীতে পড়ে একটি মেয়ের পরিবারের সবাই মারা গেছেন। কিন্তু গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, মেয়েটি সুস্থ আছে। এত বড় একটা ট্রমায় থাকা মেয়েটিও আমাদের দৃষ্টিতে ‘সুস্থ আছে’। তার মানে, মানসিক স্বাস্থ্যকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি না। এমনটি কাম্য নয়।

৪. ‘মনকে ইচ্ছা করলেই ঠিক করা যায়। এটা কোনো ব্যাপার না’—এটাও একটা ভুল ধারণা।

প্রশ্ন:

আমাদের দেশে আত্মহত্যাপ্রবণতার লক্ষণ ও ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে চাই। এটাকে কমিয়ে আনতে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের ভূমিকা কী হওয়া উচিত?

মেহতাব খানম: যাঁরা নিজের জীবন নিয়ে গভীর হতাশায় ভোগেন, তাঁদের কিছু লক্ষণ থাকে। কোভিড–১৯ মহামারিতে আমি অনলাইনে সেবা দেওয়ার সময় দেখেছি, যেসব শিশুকে ছোটবেলায় শাস্তিস্বরূপ বাথরুমে আটকে রাখা হয়েছে, করোনায় যখন মানুষ ঘরবন্দী হলো, তখন তাদের অনেকেই সেই ভয়াবহ স্মৃতির কথা ভেবে ট্রমায় ভুগেছে। এটাকে আমরা বলি ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি)’। অর্থাৎ শৈশবের স্মৃতি মনে করে হতাশাগ্রস্ত হওয়া। এ ছাড়া জীবনের প্রতি হতাশ মানুষেরা অনেক আগে থেকেই বলা শুরু করেন, ‘আমি বাঁচতে চাই না।’ জীবনের প্রতি তাঁদের কোনো উৎসাহ ও ভালোবাসা থাকে না। পরিবারের কাউকে বিশ্বাস করতে পারেন না। তাই আত্মহত্যার হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকাটাই মুখ্য।

প্রশ্ন:

দেশে আত্মহত্যার প্রবণতা কমিয়ে আনা ও মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতে কী কী পদক্ষেপ বা কৌশল নেওয়া যেতে পারে?

মেহতাব খানম: শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, যখন মনের স্থিতিশীলতা থাকে তখন ঘরে-বাইরে-অফিসে—যেখানেই হোক যেকোনো কাজ খুব ভালোভাবে করা যায়। যা শুধু তাঁর জন্য নয়, রাষ্ট্র বা দেশের জন্যও মঙ্গল। আর অনেকেই মনের ব্যথা বন্ধুকে বলেন অথচ মা-বাবাকে বলেন না। তাই সন্তানের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে বিশ্বাসের জায়গাটা মজবুত করতে হবে। তাঁর জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, এমন কিছু করা যাবে না।

শিশুরাও যেন নিজেদের কথাগুলো বলতে পারে, রাষ্ট্রকে এমন সেবা চালু করতে হবে। কারণ, অনেকেই নিজের রাগ ঝাড়েন শিশুদের ওপর। পরিশেষে বলব, শিশু গর্ভে থাকার সময় থেকেই তার মনের সঠিক যত্ন নিশ্চিত করতে হবে।

প্রশ্ন :

মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে উন্নত দেশগুলোয় কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়? এ ধরনের পদক্ষেপ আমাদের দেশে কার্যকর হবে কি না?

মেহতাব খানম: উন্নত বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্যের অনেকগুলো মানসিক সহায়তা কেন্দ্র এবং নিজের মনের ব্যথা খুলে বলার মতো অনেক বিশ্বস্ত মাধ্যম রয়েছে। শিশুরাও ফোন করলে জরুরি সেবার কর্মকর্তারা বাসায় পৌঁছে যান। পাশাপাশি ‘আত্মহত্যা প্রতিরোধ কেন্দ্র’ রয়েছে।

কিন্তু আমাদের দেশে অনেক মা-বাবা মনে করেন, ‘বাচ্চারা তো আমার সম্পত্তি, তাকে আমি যা খুশি তা-ই করতে পারব।’ এ ধরনের আচরণ শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যকে ভঙ্গুর করে তোলে। আমরা উন্নত দেশগুলোর পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করলে সুফল পেতে পারি।

প্রশ্ন:

মানসিক অসুস্থতায় ভোগা ব্যক্তির চিকিৎসা বা তাঁকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে সামাজিক উদ্যোগ বা সম্মিলিত প্রচেষ্টার গুরুত্ব কতটুকু?

মেহতাব খানম: আগেই বলেছি, যাঁরা বাঁচার আশা হারিয়ে ফেলেন, তাঁরা নিজেদের সমাজের বোঝা ভাবেন। মনে করেন, কেউ তাঁকে পছন্দ করেন না। পৃথিবীতে আসাটাই ভুল হয়েছে। তাই আমাদের বুঝতে হবে, যে সন্তান পৃথিবীতে এসেছে, তারও আলাদা একটি সত্তা রয়েছে। যখন সে ভালোবাসা পাবে, তখন নিজেকেও সে ভালোবাসবে।
আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্যসম্পর্কিত উদ্যোগ কম। এ বিষয়ে উদ্যোগ বাড়াতে হবে।

মানসিকভাবে যাঁরা খুব কষ্টে থাকেন, তাঁরা কষ্টের কথা বিশ্বাসযোগ্য মানুষের কাছে বলতে চান। সুতরাং যাঁকে তিনি মনের ব্যথার কথা বলবেন, সেই কাছের মানুষকে মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথা শুনতে হবে। মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিও যেন বুঝতে পারেন, ওই ব্যক্তি মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথা শুনছেন, তাঁর ব্যথায় সমানভাবে ব্যথিত হচ্ছেন। পাশাপাশি তাঁর কথার গোপনীয়তাও রক্ষা করছেন।

সম্মিলিতভাবে এসব উদ্যোগ নেওয়া গেলে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার হার কমে আসবে।

প্রশ্ন:

আপনাকে ধন্যবাদ।

মেহতাব খানম: প্রথম আলোকেও ধন্যবাদ।