যাত্রী সুরক্ষার বিষয়টি শুধু আইনেই

আইন মেনে গণপরিবহন চলার বিষয়টি এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

  • তল্লাশিচৌকি বসিয়ে কিংবা মহাসড়কে টহল জোরদার করে যাত্রী সুরক্ষায় হাইওয়ে পুলিশের তৎপরতা কম।

  • আন্তজেলা বাস চলাচলের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া যাত্রী তোলার নিয়ম না থাকলেও তা মানা হয় না।

কুষ্টিয়া থেকে ছেড়ে আসা এই বাসে ধর্ষণ ও ডাকাতির ঘটনা ঘটে
প্রথম আলো ফাইল ছবি

চলন্ত বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনার দায় এড়াতে পারেন না পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা। গণপরিবহনের যাত্রীদের সুরক্ষায় সড়ক পরিবহন আইনের পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন ধরনের নির্দেশনা থাকলেও এসব মানতে চান না তাঁরা। অন্যদিকে আইন মেনে গণপরিবহন চলার বিষয়টি এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একইভাবে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

আন্তজেলা বাস চলাচলের ক্ষেত্রে অনুমোদন পাওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে নির্দিষ্ট স্থানে (জেলা সদরে) থামতে পারবে বাস। এর বাইরে যত্রতত্র যাত্রী তোলা যাবে না। তবে যাত্রী চাইলে বাস থেকে নামতে পারবেন। সড়ক পরিবহন আইনে বাসের চালকসহ সব কর্মীর নিয়োগপত্র থাকা এবং মাসিক বেতন দেওয়ার বিধান আছে। এ বিধান বেশির ভাগ পরিবহন কোম্পানি মানে না। পরিববহনশ্রমিকদের সঙ্গে চুক্তিতে বাস চালান মালিকেরা। এ জন্য চালক-সহকারীরা বাড়তি আয়ের আশায় যত্রতত্র যাত্রী তোলেন। আর এ কাজ করতে গিয়েই গত মঙ্গলবার রাতে টাঙ্গাইলে ঈগল এক্সপ্রেসের বাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটে এবং একজন নারী যাত্রী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন।

এ দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে পরিবহন খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈগল এক্সপ্রেসের বাসটি যাত্রীদের সুরক্ষায় কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বাসটি প্রচলিত আইন ও বিধি লঙ্ঘন করেই চলেছিল। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থেকে নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে বাসটি। গভীর রাতে বঙ্গবন্ধু সেতু পার হওয়ার পর তিন দফায় যাত্রীবেশী ডাকাতেরা বাসে ওঠেন।

পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা আইন মানেন না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বিআরটিএ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে না। ফলে যা হওয়ার তা–ই হচ্ছে।
মোজাম্মেল হক চৌধুরী, মহাসচিব, যাত্রীকল্যাণ সমিতি

অস্ত্রের মুখে বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যাত্রীদের হাত, চোখ, মুখ বেঁধে ফেলেন তাঁরা। তিন ঘণ্টা ডাকাত দলের নিয়ন্ত্রণে ছিল বাসটি। এ সময়ের মধ্যেই যাত্রীদের মুঠোফোন, টাকাসহ মূল্যবান জিনিস লুট করা হয়। একই সময়ে ধর্ষণের ঘটনাও ঘটে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, কুষ্টিয়া থেকে পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ হয়ে নারায়ণগঞ্জে চলাচলের জন্য কোনো বাস রুটের অনুমোদন নেই। এ পথে অনুমোদন ছাড়াই ঈগল এক্সপ্রেস চলাচল করছে। অন্যদিকে মহাসড়কে একটি বাসের নিয়ন্ত্রণ তিন ঘণ্টা ডাকাত দলের কাছে থাকার পরও তা পুলিশের নজরে না আসাকে অস্বাভাবিক ঘটনা বলেই মনে করছেন পরিবহন খাতের বিশেষজ্ঞরা।

বিআরটিএ সূত্র বলছে, ঈগল এক্সপ্রেসের রুট পারমিট ছিল ঢাকা–পাবনা পথে। কিন্তু বাস চালানো হচ্ছে কুষ্টিয়া–নারায়ণগঞ্জ পথে।

এ বিষয়ে ঈগল এক্সপ্রেসের মালিক সোলায়মান হক প্রথম আলোকে বলেন, কুষ্টিয়া–চট্টগ্রাম পর্যন্ত তিনি রুট পারমিট নিয়েছেন। চালান নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত। কিন্তু কুষ্টিয়া–চট্টগ্রাম পথে বিআরটিএর তালিকায় কোনো রুট নেই—এ প্রশ্ন করা হলেও সোলায়মান হক কোনো জবাব দেননি। পথে বাসে যাত্রী তোলা সম্পর্কে তিনি বলেন, মুনাফার জন্য চালক ও কর্মীরা এ কাজ করেছেন। চালক ও কর্মীরা বেতনভোগী হওয়ার কথা—এ প্রশ্নে তিনি বলেন, এখন চুক্তিতেই বেশির ভাগ বাস চলাচল করে।

সড়কপথে ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধ বেড়ে যাওয়ার পর নব্বইয়ের দশকে বাসের চালক ও যাত্রীদের মাঝখানে একটি স্টিলের বেষ্টনী লাগানোর নির্দেশনা দিয়েছিল সরকার। দূরপাল্লার কিছু বাসে এ ধরনের বেষ্টনী দেখা যায়। তবে যাত্রী ওঠার পর এ বেষ্টনী আটকে দেওয়া হয় না। ঈগল এক্সপ্রেসের বাসে এ ব্যবস্থা থাকলে চলন্ত বাস চালকের কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণ নিতে পারতেন না ডাকাতেরা।

সড়কপথের নিরাপত্তায় ২০০৫ সালে হাইওয়ে পুলিশ গঠন করা হয়। মূলত সড়কে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কিছু ব্যবস্থা নেয় হাইওয়ে পুলিশ। ডাকাতি কিংবা বাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে আসামি ধরার ক্ষেত্রে থানা-পুলিশকে সহায়তা করে পুলিশের এ ইউনিট। তবে তল্লাশিচৌকি বসিয়ে কিংবা মহাসড়কে টহল জোরদার করে যাত্রী সুরক্ষায় হাইওয়ের পুলিশের তৎপরতা কম। এ জন্য জনবল ও সরঞ্জামের ঘাটতির কথা বলা হয়। বর্তমানে হাইওয়ে পুলিশের জনবল তিন হাজারের কাছাকাছি।

হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শামসুল আলম সরকার প্রথম আলোকে বলেন, টাঙ্গাইলের ঘটনার পর স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে আসামি ধরা হয়েছে। বাসে ডাকাতি, ধর্ষণের ঘটনা কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ডাকাতি বা ধর্ষণের ঘটনা সব সময় হয় না। এসব ঘটনা ঠেকাতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

২০০৫ সালে হাইওয়ে পুলিশের যাত্রা শুরুর পর অপরাধ ঠেকাতে দূরপাল্লার রাতের বাসগুলোতে যাত্রা শুরুর স্থানে বাসের ভেতরের অবস্থা (যাত্রীসহ) ভিডিও করা হতো। কিন্তু এখন আর এতে কারও নজর নেই।

যাত্রী সুরক্ষার উদ্যোগে জোর নেই

বাসে ডাকাতি বা অপরাধ কমাতে চলতি বছরের শুরুতে ঢাকা মহানগর পুলিশ প্রতিটি বাসে একটি বিশেষ যন্ত্র বসানোর পরিকল্পনার কথা জানায়। এ ব্যবস্থাটা এমন যে বাসে একটি বাটন থাকবে। ডাকাত বা কোনো বিপদ বুঝতে পারলে ওই বাটনে চাপ দিলে যে এলাকায় বাসটি আছে সে এলাকার পুলিশ সুপার, বাসমালিক এবং জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এ সাহায্য চেয়ে একটি বার্তা পৌঁছে যাবে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার শফিকুল ইসলাম গত ফেব্রুয়ারি মাসে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, শেষ ডাকাতটিকে ধরতে চান তাঁরা। প্রযুক্তি চালু হলে যাত্রী, পরিবহনমালিক, চালক, বাসের সহকারী সবার জন্য নিরাপত্তা সুরক্ষিত হবে। কিন্তু এ বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতি নেই বলে পরিবহনমালিক ও পুলিশ সূত্র জানিয়েছে।

২০০৫ সালে হাইওয়ে পুলিশের যাত্রা শুরুর পর অপরাধ ঠেকাতে দূরপাল্লার রাতের বাসগুলোতে যাত্রা শুরুর স্থানে বাসের ভেতরের অবস্থা (যাত্রীসহ) ভিডিও করা হতো। কিন্তু এখন আর এতে কারও নজর নেই।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি বাসে যাত্রী তোলা শেষ হওয়ার পর এবং গন্তব্যে নামার আগে একবার করে ভিডিও করলে ডাকাতি কমে যাবে। এমনকি হোটেলে বিরতির সময়ও ভিডিও করা যায়। তিনি বলেন, আগের চেয়ে বাসে ডাকাতি কমেছে। মাঝপথে যাত্রী তোলা বন্ধ, হাইওয়ে পুলিশের সংখ্যা এবং তল্লাশিচৌকি বাড়াতে পারলে ডাকাতি আরও কমে যাবে। এ বিষয়ে মালিক সমিতি সরকারকে সহায়তা করবে বলেও তিনি জানান।

বাসে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি

২০১৬-১৯ সাল পর্যন্ত গণপরিবহনে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির হিসাব সংরক্ষণ করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। করোনা মহামারির সময় সেই হিসাব আর রাখেনি সংগঠনটি। সমিতির হিসাবে, ওই চার বছরে গণপরিবহনে ১৩৪টি ধর্ষণ, ৪২টি দলবদ্ধ ধর্ষণ এবং ৯১টি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে।

কয়েক বছরে টাঙ্গাইল এলাকায় বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের কয়েকটি ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন তৈরি করে। এর মধ্যে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে চলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার হন একজন তরুণী। পরে তাঁকে হত্যা করে টাঙ্গাইলের মধুপুর বন এলাকায় ফেলে যাওয়া হয়। এ ঘটনায় বাসচালক ও সহকারীরা জড়িত ছিলেন।

যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, রাত তিনটার সময় যদি হাত তুললেই যাত্রী ওঠানোর সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে বাসে ডাকাত উঠবে নাকি ভালো মানুষ উঠবে? নির্ধারিত স্থানের বাইরে যাত্রী তোলা বন্ধ করলে এবং হাইওয়ে পুলিশের তৎপরতা বাড়ানো গেলে চলন্ত বাসে ডাকাতি এবং ধর্ষণের ঘটনা কমে যেত। তিনি বলেন, পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা আইন মানেন না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বিআরটিএ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে না। ফলে যা হওয়ার তা–ই হচ্ছে।