পুলিশের গুলিতে শামীম মিয়ার বাঁ ঊরুর হাড় ভেঙেছিল গত বছরের ৫ আগস্ট। সেই থেকে সরকারি ও বেসরকারি ছয়টি হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে তাঁর। এখন তিনি ভর্তি আছেন রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল)। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শে অন্তর্বর্তী সরকার শামীমকে বিদেশে পাঠানোর জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রাজপথে ছিলেন শামীম মিয়া। ওই সময় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে শামীমের মতো ঠিক কত মানুষ আহত হয়েছেন, তার সঠিক তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আহত ১৩ হাজার ৮১১ জন। অন্যদিকে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদ পরিবার এবং জুলাই যোদ্ধাদের কল্যাণ ও পুনর্বাসন অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এ বলা হয়েছে, সারা দেশে আহত হয়েছেন ১২ হাজার ৮৮৭ জন। আহত ব্যক্তিদের প্রকৃত সংখ্যা যা-ই হোক না কেন, শামীম মিয়ার মতো তিন শতাধিক আহত ব্যক্তি এখনো দেশে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
শামীম মিয়ার (৪০) বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইলে। তিনি কাজ করতেন গাজীপুরের শ্রীপুরের মাওনায় একটি পোশাক কারখানায়। মাসে বেতন পেতেন ২৫ হাজার টাকা। অন্য একটি কারখানায় কাজ করতেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া। স্বামী-স্ত্রীর আয়ে চলত দুই মেয়ে ও মা-বাবাকে নিয়ে ছয়জনের সংসার। ৫ আগস্ট স্বামী গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর হাসপাতালেই দিন কাটছে স্ত্রীর। যে কারণে বাধ্য হয়ে চাকরি ছাড়তে হয়েছে তাঁকে। স্বামী-স্ত্রী কথায়–কথায় জানালেন, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে দুই লাখ টাকা এবং সরকারের কাছে থেকে এক লাখ টাকা সহায়তা পেয়েছেন তাঁরা। কিন্তু চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল ও বাড়ি যাওয়া-আসাসহ অন্যান্য খরচ এবং গত এক বছরে সংসারের খরচ চালাতে গিয়ে এখন তাঁদের দেনা লাখ টাকার ওপর।
এসে পড়ি দালালের খপ্পরে। আমাকে প্রথমে নিয়ে যায় শ্যামলীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানে দুই দিন ছিলাম। এরপর বাড়ি চলে যাই।শামীম মিয়া
১৫ জুলাই সকালে পঙ্গু হাসপাতালে কথা হয় শামীম মিয়া ও তাঁর স্ত্রী রাজিয়ার সঙ্গে। শামীম বলেন, ৫ আগস্ট বেলা তিনটার দিকে শ্রীপুরের মাওনার রাস্তায় শত শত মানুষের মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। অনেকের সঙ্গে তিনিও আহত হন। গুলি বাঁ ঊরু ভেদ করে বের হয়ে যায়। কয়েকজন শিক্ষার্থী শামীমকে উদ্ধার করে প্রথমে শ্রীপুরের একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এরপর রাত তিনটার দিকে তাঁকে আনা হয় ঢাকায়।
শামীম বলেন, ‘এসে পড়ি দালালের খপ্পরে। আমাকে প্রথমে নিয়ে যায় শ্যামলীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানে দুই দিন ছিলাম। এরপর বাড়ি চলে যাই।’
১৬ আগস্ট শামীম আবার শ্যামলীর ওই বেসরকারি হাসপাতালে আসেন এবং ২১ তারিখ পর্যন্ত সেখানে ভর্তি থাকেন। পরে আবার বাড়ি চলে যান তিনি এবং নান্দাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন। সেখানে কিছুদিন চিকিৎসা নেওয়ার পর ময়মনসিংহ শহরের বেসরকারি একটি ক্লিনিকে চিকিৎসা নেন। এরপর তিনি সেখানকার চিকিৎসকদের পরামর্শে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেয়।
শামীম বলেন, ‘ভর্তি (পঙ্গু) হওয়ার পরও সিট না থাকায় হাসপাতালে জায়গা হয়নি। দুই দিন পর সিএমএইচে (সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল) ভর্তি হই। সেখানে পায়ে অপারেশন (অস্ত্রোপচার) হয়।’
স্বামী-স্ত্রী কথায়–কথায় জানালেন, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে দুই লাখ টাকা এবং সরকারের কাছে থেকে এক লাখ টাকা সহায়তা পেয়েছেন তাঁরা। কিন্তু চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল ও বাড়ি যাওয়া-আসাসহ অন্যান্য খরচ এবং গত এক বছরে সংসারের খরচ চালাতে গিয়ে এখন তাঁদের দেনা লাখ টাকার ওপর।
কাগজপত্রে দেখা যায়, শামীম সিএমএইচে ভর্তি হন ৩০ অক্টোবর। তাঁকে ছাড়পত্র দেওয়া হয় প্রায় এক মাস পর, ২৯ নভেম্বর। সেখান থেকে আবার বাড়ি যান শামীম। কিন্তু তাঁর পায়ে সংক্রমণ দেখা দেয়। আবার ভর্তি হন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এক মাসেও পায়ের কোনো উন্নতি না হওয়ায় চিকিৎসকেরা আবার তাঁকে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। গত ৩ মার্চ তিনি পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হন। সেই থেকে তিনি পঙ্গু হাসপাতালেই আছেন।
শামীম বলেন, তাঁর ঊরুর ছয় ইঞ্চি হাড় কেটে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তাঁর চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা একজন চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেন, ঠিক সময়ে চিকিৎসা না হওয়া, ঠিক চিকিৎসা না হওয়া, বারবার সংক্রমণ হওয়া—এসব কারণে শামীমের পরিস্থিতি জটিল হয়েছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে এখন বিদেশে পাঠানো হবে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের অনেকেই সঠিক সময়ে যথাযথ চিকিৎসা পাননি। আহত ১৪ জনের সঙ্গে কথা বলে প্রথম আলোর পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, সঠিক সময়ে যথাযথ চিকিৎসা না হওয়ার কারণ অন্তত তিনটি। প্রথমত, গত বছরের মধ্য জুলাইয়ে যাঁরা গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকে তখন হাসপাতালে শুধু প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। পুলিশি হয়রানির ভয়ে অনেকে হাসপাতালে ভর্তি হননি। দ্বিতীয়ত, জরুরি চিকিৎসা ব্যয় কে মেটাবে, এ রকম একটি পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছিল অনেক পরিবার। এর ফলে অনেকে আর্থিক কারণে তখন ভালোভাবে চিকিৎসা করাতে পারেননি। তৃতীয়ত, ঝামেলায় পড়তে হবে, এমন আশঙ্কা থেকে তখন অনেক বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক আহত ব্যক্তিদের ভর্তি করানোর ক্ষেত্রে অনাগ্রহ দেখিয়েছে। আবার অনেকে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা না নিয়ে বা চিকিৎসা শেষ হওয়ার আগেই হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান। কারও ক্ষেত্রে কারণটি আর্থিক, আবার কারও ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারের আশঙ্কা কাজ করছিল তখন।
এ বিষয়ে পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. আবুল কেনান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুনেছি, আহতদের ভর্তি না করানোর ব্যাপারে তখন অনেক জায়গায় চাপ ছিল।’
হাজার মানুষের চোখে ছররা গুলি
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অন্যান্য অস্ত্রের পাশাপাশি ব্যাপকভাবে ছররা গুলি ব্যবহার করে। এতে অনেক মানুষ আহত হন। অনেকে এক চোখ, কেউ কেউ দুই চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালকের কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১ হাজার ৮৭ জন চোখে গুরুতর আঘাত পেয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ৬৯৯ জন, ঢাকা সিএমএইচে ১৩৭ জন, ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে ১২২ জন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৭৭ জন, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৮ জন এবং চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ১৪ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। তাঁদের প্রত্যেকের চোখে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাসপাতাল শাখার তথ্য বলছে, ৪৫০ জন এক চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন, দুই চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন ২০ জন। এ ছাড়া ২৩৬ জনের এক চোখ এবং ২১ জনের দুই চোখ গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
চোখে আঘাত পাওয়া সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ব্যক্তির চিকিৎসা হয়েছে চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে। এসব রোগীর চিকিৎসায় বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকটি দেশ থেকে চিকিৎসক দল এসেছে। এ তালিকায় আছে চীন, নেপাল, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাজ্য। এ ছাড়া ২১ রোগীকে চোখের উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হয়েছে। এখনো সাতজন চিকিৎসার জন্য তুরস্কে আছেন।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক খায়ের আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, চোখের সমস্যা নিয়ে এক হাজারের বেশি মানুষ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাঁরা সবাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় আহত হয়েছেন। আহত এই মানুষদের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, প্রায় ৯৯ শতাংশ ছররা গুলিতে আহত হয়েছেন। বাকি ১ শতাংশের ছিল কাঁদানে গ্যাসের শেল বা অন্য কিছুর আঘাত। ছররা গুলি লেগেছে বুকে, গলায়, নাকে, মুখে, মাথায় আর চোখে। এর মধ্যে চোখ সবচেয়ে স্পর্শকাতর।
শুনেছি, আহতদের ভর্তি না করানোর ব্যাপারে তখন অনেক জায়গায় চাপ ছিল।পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. আবুল কেনান
আহতদের তিন ধরন
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে আহত ব্যক্তিদের তালিকায় ১৩ হাজার ৮১১ জনের নাম আছে। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আহত হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য আবেদনকারীকে অন্যান্য প্রমাণের সঙ্গে হাসপাতালে বা ক্লিনিকে চিকিৎসা নেওয়ার কাগজপত্র দেখাতে হয়েছিল।
অন্যদিকে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদ পরিবার এবং জুলাই যোদ্ধাদের কল্যাণ ও পুনর্বাসন অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এ বলা হয়েছে, সারা দেশে আহত হয়েছেন ১২ হাজার ৮৮৭ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে। এই বিভাগে আহত ব্যক্তির সংখ্যা ৩ হাজার ৯৮। এরপর চট্টগ্রাম বিভাগে, ১ হাজার ৯২৭ জন। রংপুর ও খুলনা বিভাগে আহত ব্যক্তির সংখ্যা যথাক্রমে ১ হাজার ৩১৫ ও ১ হাজার ১৯৫। বাকি তিন বিভাগ, অর্থাৎ বরিশাল, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগে আহত ব্যক্তির সংখ্যা যথাক্রমে ৭৭২, ৭০৮ ও ৫৩৪।
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওই অধ্যাদেশে আহত ব্যক্তিদের তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে—অতি গুরুতর আহত, গুরুতর আহত ও আহত। এক চোখ বা হাত বা পা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে স্বাধীন জীবনযাপনের অনুপযোগী, সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন, মানসিক বিকারগ্রস্ত, অঙ্গহানি এবং জীবিকার জন্য অক্ষম ব্যক্তিকে অতি গুরুতর আহত বলা হয়েছে। অতি গুরুতর আহত ব্যক্তির সংখ্যা ৪৯৩।
আংশিক দৃষ্টিহীন, মস্তিষ্কে গুরুতর আঘাত পাওয়া বা অনুরূপ আহত ব্যক্তিকে গুরুতর আহত বলা হয়েছে। তাঁদের সংখ্যা ৯০৮। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শ্রবণশক্তি বা দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত, গুলিতে আহত বা অনুরূপভাবে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন—এমন ব্যক্তিদের আহত বলা হচ্ছে। তাঁদের সংখ্যা ১০ হাজার ৬৪২।
অধিকাংশ মানুষ আহত হয়েছেন বিভিন্ন ধরনের গুলির আঘাতে। এর মধ্যে প্রাণঘাতী গুলি যেমন আছে, তেমনি আছে ছররা গুলি। আছে রাবার বুলেটের আঘাত। অনেকে লাঠি, বাঁশ, রড বা ইটের আঘাতে আহত হয়েছেন। কেউ কেউ আগুনে পুড়ে আহত হয়েছেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আহত ব্যক্তিদের মধ্যে চারজনের এক হাত কেটে ফেলতে হয়েছে। এক পা কেটে ফেলতে হয়েছে ২০ জনের। এ ছাড়া মেরুদণ্ড, মাথা বা শরীরের অন্য জায়গায় গুরুতর আঘাত পাওয়া মানুষ আছেন কয়েক শ।
পঙ্গু হাসপাতাল গুরুতর আহত ৯০২ জনকে চিকিৎসা দিয়েছে। এর মধ্যে বন্দুকের গুলিতে আহত ৬০৮ জন। আর অন্যান্য কারণে আহত ২৯৪ জন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আহত ব্যক্তিদের মধ্যে চারজনের এক হাত কেটে ফেলতে হয়েছে। এক পা কেটে ফেলতে হয়েছে ২০ জনের। এ ছাড়া মেরুদণ্ড, মাথা বা শরীরের অন্য জায়গায় গুরুতর আঘাত পাওয়া মানুষ আছেন কয়েক শ।
সরকারি গেজেট অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন ৮৪৪ জন। গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছিল, যা জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। পুলিশের পাশাপাশি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের (এখন কার্যক্রম নিষিদ্ধ) বিভিন্ন সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের অনেক নেতা-কর্মীকে গুলি করতে দেখা গেছে।
এখনো তাঁরা হাসপাতালে
আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ঠিক কতজন এখন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন, তা নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) যে তথ্য দিয়েছে, তাতে দেখা যায়, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার হাসপাতালে ৩৩৮ জন রোগী ভর্তি আছেন। তবে কয়েকটি হাসপাতালে ফোন করে জানা যায়, মন্ত্রণালয়ের এ তথ্য ঠিক নয়।
যেমন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ১১৬ জন ভর্তি আছেন। কিন্তু এই ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক খায়ের আহমেদ চৌধুরী বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের কেউ এখন আর ভর্তি নেই।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১২১ জন। তবে বৃহস্পতিবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, ভর্তি আছেন ১০ জন।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬ জন ভর্তি আছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ শাখা বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেছে, আহত ৩২ জন ভর্তি আছেন।
এ ছাড়া সিএমএইচ,বার্ন ইনস্টিটিউট ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও বেশ কয়েকজন আহত রোগী এখন ভর্তি আছেন বলে জানতে পেরেছে প্রথম আলো। চলতি মাসের ৩ তারিখ সেনা সদর আয়োজিত সর্বশেষ ব্রিফিংয়ে বলা হয়, জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৪ হাজার ৭৯০ জনকে দেশের বিভিন্ন সিএমএইচে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। সেদিনও (৩ জুলাই) ঢাকা সিএমএইচে ২২ জন চিকিৎসাধীন ছিলেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য বলছে, উন্নত চিকিৎসার জন্য এ পর্যন্ত ৭৫ জনকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে সিঙ্গাপুরে ১১ জনকে, থাইল্যান্ডে ৫৬ জনকে, তুরস্কে ৭ জনকে ও রাশিয়ায় ১ জনকে পাঠানো হয়েছে। চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছেন ২৯ জন। এখনো থাইল্যান্ডে ৩৯ জন ও তুরস্কে ৭ জন চিকিৎসার জন্য আছেন।
বিদেশে চিকিৎসা, বিদেশি চিকিৎসক
পরিস্থিতি জটিল হওয়ার কারণে বেশ কয়েকজন আহত রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠিয়েছে সরকার। তবে অভিযোগ আছে, কিছু ক্ষেত্রে রোগীদের বিদেশে পাঠাতে বিলম্ব হয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য বলছে, উন্নত চিকিৎসার জন্য এ পর্যন্ত ৭৫ জনকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে সিঙ্গাপুরে ১১ জনকে, থাইল্যান্ডে ৫৬ জনকে, তুরস্কে ৭ জনকে ও রাশিয়ায় ১ জনকে পাঠানো হয়েছে। চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছেন ২৯ জন। এখনো থাইল্যান্ডে ৩৯ জন ও তুরস্কে ৭ জন চিকিৎসার জন্য আছেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, এ পর্যন্ত বিদেশে চিকিৎসায় খরচ হয়েছে ৭৮ কোটি ৫২ লাখ ২৬ হাজার ৯১০ টাকা। আর আহত ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন, তাঁদের চিকিৎসার সম্পূর্ণ খরচ সরকার বহন করেছে।
মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, ৫ জন আহত রোগী ভিসার জন্য অপেক্ষমাণ এবং ২০ জনের জিও (সরকারি আদেশ) প্রক্রিয়াধীন। এ ছাড়া আরও কয়েকজনকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হবে। তাঁদের পাসপোর্ট তৈরির কাজ চলছে। এ জন্য পাসপোর্ট অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তা গত সোমবার পঙ্গু হাসপাতালে যান।
আহত ব্যক্তিদের উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর পাশাপাশি নানা দেশ থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদেরও সরকার দেশে এনেছে। এর মধ্যে চীন, নেপাল, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও সিঙ্গাপুরের চিকিৎসক দল বাংলাদেশে ঘুরে গেছে। বিদেশি চিকিৎসকেরা মূলত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতাল, চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও সিএমএইচে ভর্তি রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি এ দেশের চিকিৎসকদের নানা পরামর্শ দিয়েছেন।
আহত ব্যক্তিদের ব্যাপারে তিনটি জিনিসের ঘাটতি আমার নজরে পড়েছে। তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার কার্যকর ও দৃশ্যমান উদ্যোগ আমরা নিতে দেখিনি। অনেকেরই ফিজিওথেরাপি দরকার।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ
চিকিৎসা নিয়ে ক্ষোভ, সড়ক অবরোধ
দায়িত্ব নেওয়ার পর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরহাজান বেগম একাধিক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা তাঁর অগ্রাধিকারের তালিকার ১ নম্বরে রয়েছে। তবে আহত ব্যক্তিরা চিকিৎসা নিয়ে গত এক বছরে বেশ কয়েকবার প্রকাশ্যে অসন্তোষ দেখিয়েছেন, সড়ক আটকে বিক্ষোভ করেছেন। তাঁরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে একাধিকবার বিক্ষোভ করেছেন, সচিবালয়ের সামনে সমাবেশ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন। এ ছাড়া স্বাস্থ্য উপদেষ্টার গাড়ি আটকে অবরোধ করার চেষ্টা করেছেন। শাহবাগ ও আগারগাঁওয়ে সড়ক অবরোধ করেছেন। চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালকের কার্যালয়ে ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে।
আহত ব্যক্তিদের বড় অংশই তরুণ। তাঁদের মধ্যে গুরুতর আহত অনেকে শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েছেন। অনেকে উপার্জন হারিয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের একটি অংশ মানসিক চাপের মধ্যে আছে, অনেকে হতাশ, অনেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। একাধিক চিকিৎসক বলেছেন, প্রয়োজনের তুলনায় মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসার উদ্যোগ কম দেখা গেছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি ও পুনর্বাসন নিয়ে গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আহত ব্যক্তিদের ব্যাপারে তিনটি জিনিসের ঘাটতি আমার নজরে পড়েছে। তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার কার্যকর ও দৃশ্যমান উদ্যোগ আমরা নিতে দেখিনি। অনেকেরই ফিজিওথেরাপি দরকার। কিন্তু তাঁরা তা পাচ্ছেন না। এ ছাড়া ভবিষ্যতে তাঁদের জীবিকা নির্বাহের নিশ্চিত কোনো ব্যবস্থা সরকার এখনো করতে পারেনি। তাই অনেকেই এখন হতাশ। দেশের এত বড় পরিবর্তনের পর এমন হতাশা কারও কাম্য ছিল না।’