বড় হচ্ছে দেশের টিভির বাজার

দেশে টেলিভিশনের বাজার বড় হচ্ছে, বিশেষ করে স্মার্ট টিভির বাজার। টেলিভিশন খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট খাতগুলোও সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে টেলিভিশনের উৎপাদন, বিক্রি ও রপ্তানি। টেলিভিশন খাতে দেশীয় উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি পেলেও এই শিল্পের হুমকি ‘গ্রে মার্কেট’ (অননুমোদিত পণ্যের বাজার)। শুধু উৎপাদন, বিক্রি বা রপ্তানিই নয়, মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে টেলিভিশন খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

বাড়ছে প্রযুক্তির ব্যবহার

টিভি এখন আর শুধু দেখার বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। দেখার ধরন ও টেলিভিশনের আকারে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। টিভিতে প্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। ক্রেতারাও ঝুঁকছে স্মার্ট টিভির দিকে। সনাতন পদ্ধতির সিআরটি টিভি এখন বলতে গেলে বিলুপ্ত প্রায়। সিআরটি টিভিকে হটিয়ে বাজারে আসে এলসিডি ও এলইডি টিভি। আবার এলসিডি-এলইডির জায়গাটি এখন দখল করছে স্মার্ট টিভির নানা সংস্করণ। মনিটরের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পাশাপাশি আরও বেশ কিছু ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে টেলিভিশনে। টিভি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোও টিভিকে কতটা স্লিম ও প্রযুক্তিসমৃদ্ধ করা যায়, সেই প্রতিযোগিতায় নেমেছে। বর্তমানে একটি অ্যান্ড্রয়েড ফোনের মাধ্যমে যেসব কাজ করা যায়, প্রায় সব কটিই স্মার্ট টিভির মাধ্যমেও করা সম্ভব। ফলে টেলিভিশনের আবেদনও দিন দিন বাড়ছে।

ওয়ালটন টেলিভিশনের ব্র্যান্ড ম্যানেজার খন্দকার আশিকুল হাসান বলেন, ‘আমাদের অধিকাংশ টিভিই স্মার্ট ধরনের। বিশ্বের আধুনিক সব প্রযুক্তি আমরা আমাদের টিভিতে ব্যবহার করেছি। প্রযুক্তির উৎকর্ষে সবটুকু সুবিধা আমরা টেলিভিশনের মাধ্যমে আমাদের দর্শকদের দিতে চাই।’

অর্থনৈতিক পরিধি

দেশের সামগ্রিক ইলেকট্রনিকস পণ্যের বাজারের মতোই টেলিভিশনের বাজারও ক্রমবর্ধমান। ২০২০ সালে টেলিভিশনের বাজারের আকার ছিল ৬৩৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২৫ সালে বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৯৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। বাংলাদেশে টেলিভিশনশিল্পের ওপর গবেষণা কার্যক্রম নিয়ে করা এক জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশে মোট বিক্রীত ইলেকট্রনিকস পণ্যের মধ্যে টেলিভিশনের বাজারের আকার ৩০ দশমিক ০৩ শতাংশ।

টেলিভিশনের বাজারসংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, দেশে বছরে কম–বেশি ১৮ থেকে ২০ লাখ টেলিভিশন বিক্রি হয়। এর একটা বড় অংশই স্মার্ট টিভি। টিভি বিক্রিটা সাধারণত উৎসবকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। বিশেষ করে বিশ্বকাপের মতো বড় আয়োজনের সময় টিভি বিক্রি অনেক বেড়ে যায়। আগামী মাস থেকে শুরু হচ্ছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট। ধারণা করা হচ্ছে, এই উপলক্ষে বাড়বে টেলিভিশনের বিক্রি।

বাজারে দেশীয় শেয়ার বাড়ছে

দেশে টেলিভিশন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। এতে ধীরে ধীরে টেলিভিশনের আমদানিনির্ভরতা কমছে। টিভি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে যুক্ত উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে ওয়ালটন, ইলেকট্রো মার্ট, ট্রান্সকম ইলেকট্রনিকস, সনি, ইলেকট্রো ইন্টারন্যাশনাল, মিনিস্টার, ভিশন, এসকোয়্যার ইলেকট্রনিকস, র‍্যাগ্স প্রভৃতি।

ভিশন ইলেকট্রনিকসের হেড অব মার্কেটিং শেখ মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘ইলেকট্রনিকস পণ্যের বিকাশ ঘটাতে সরকার দেশে কারখানা স্থাপন ও পণ্য উৎপাদনে শুল্ক সুবিধা দিচ্ছে। অন্যদিকে বিদেশ থেকে সম্পূর্ণ তৈরি পণ্য আমদানিতে বেশি পরিমাণে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ফলে দেশীয় কোম্পানি হোক কিংবা বিদেশি—বাজারে প্রতিযোগিতামূলক দামে পণ্য দিতে হলে দেশের অভ্যন্তরে কারখানা স্থাপন করে পণ্য তৈরি করতে হবে।’

দেশে উৎপাদিত টিভি বিদেশে রপ্তানি

বেশ কয়েকটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে কারখানা তৈরি করে টিভি উৎপাদন করছে। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি স্যামসাং, সিঙ্গারসহ বিদেশি একাধিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে কারখানা স্থাপন করেছে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের চাহিদা পূরণ করে বিশ্বে বিভিন্ন দেশে টিভি রপ্তানি করছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ওয়ালটন।

ওয়ালটন টেলিভিশনের ব্র্যান্ড ম্যানেজার খন্দকার আশিকুল হাসান বলেন, ‘ওয়ালটন টেলিভিশন সুনামের সঙ্গে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। সেই সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।’ তিনি বলেন, বর্তমানে বিশ্বের মোট ৩৫টি দেশে ওয়ালটনের টিভি রপ্তানি করা হচ্ছে। রপ্তানিকারক দেশগুলো মধ্যে ইউরোপ ও আমেরিকার মহাদেশের বিভিন্ন দেশ রয়েছে। ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’লেখা টিভিগুলো বাংলাদেশে সুনাম বিদেশের মাটিতে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

হুমকি ‘গ্রে মার্কেট’

বাংলাদেশের টিভি বাজারের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি বিদেশ থেকে অবৈধ উপায়ে আনা টেলিভিশন। এসব টেলিভিশন কিনে যেমন ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছেন, তেমনি সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব এবং নষ্ট হচ্ছে দেশের টেলিভিশন বাজার। এলিফ্যান্ট রোড, মিরপুর, স্টেডিয়াম মার্কেটসহ রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গড়ে উঠেছে ‘গ্রে মার্কেট’। এলিফ্যান্ট রোডের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গ্রে মার্কেটের টিভি বিক্রেতা বলেন, ‘নানা উপায়ে আমাদের কাছে আসে টেলিভিশনগুলো। এগুলো দেশের বাজারে আনতে সরকারকে কোনো রাজস্ব দেওয়া হয় না। বিক্রয়োত্তর সেবাসহ কোনো কিছুই আমরা দিই না ক্রেতাদের। এরপরও আমাদের ক্রেতার সংখ্যা বেশ ভালো।’ এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গ্রে মার্কেটে পণ্যের দাম তুলনামূলক কম। তাই গ্রে মার্কেটে ক্রেতাও রয়েছে।’

এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, বিভিন্ন অননুমোদিত মাধ্যমে দেশে যে টেলিভিশন আনা হয়, সেটি টেলিভিশন বাজারের ১০ থেকে ১২ শতাংশ দখল করে আছে। আর ৮ থেকে ১০ শতাংশ রয়েছে স্টিকারভিত্তিক। অর্থাৎ মোট ২০ শতাংশ নকল বা অননুমোদিত টেলিভিশন বাজারে রয়েছে।