ধৈর্য নিয়ে চেষ্টা করলে অভাবকে জয় করা যায়

অনেক লড়াইয়ের পর অভাবকে জয় করতে পেরেছেন খুলনার প্রমীলা মিস্ত্রিছবি: খোরশেদ আলম
দৃঢ় মনোবল আর প্রচেষ্টা থাকলে কোনো বাধা পেরোনোই কঠিন নয়। দরকার ইচ্ছাশক্তি, আত্মবিশ্বাস আর কঠোর পরিশ্রম। আমাদের আশপাশে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নিজেদের জীবনগাথায় লিখে চলেছেন অদম্য জয়ের গল্প। তাঁদের সেই সাফল্য ব্যক্তিগত অর্জনের সীমানা পেরিয়ে সমাজের নানাবিধ প্রতিবন্ধকতাকেও চ্যালেঞ্জ করেছে। তেমনই কয়েকজনের গল্প নিয়ে ধারাবাহিক এ আয়োজন। আজ জানব খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার হাটবাটি গ্রামের বাসিন্দা প্রমীলা মিস্ত্রির জীবনগল্প।

আমি প্রমীলা মিস্ত্রি, খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার হাটবাটি গ্রামের অতিদরিদ্র অঞ্চলে আমার জন্ম। অভাব-অনটনের মধ্যেই বড় হয়েছি। স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিলাম কিন্তু শেষ করতে পারিনি। কারণ, লেখাপড়ার চেয়ে ক্ষুধা মেটানোই ছিল আমার পরিবারে সবচেয়ে বড় লড়াই। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি, এরপর আমার পরিবার আর কুলাতে পারছিল না। বাধ্য হয়ে মায়ের সঙ্গে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে যেতাম।

আমার ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয়। খেলাধুলা করার বয়সে সংসার শুরু করি। কিন্তু সেই সংসারেও ছিল অভাব। স্বামী খেতখামারে কাজ করেন। কোনোরকমে জীবন চলছিল। দিন পার করছিলাম একটু সুখের আশায়। বয়স বাড়ল কিন্তু অবস্থার কোনো বদল হলো না। সংসারের ভালো-মন্দ বুঝতে বুঝতে বয়স ১৮ হলো। এমন সময় আমার গর্ভে সন্তান আসে। কন্যা পাপিয়ার জন্ম হলো। তার আগমনে ঘরে আনন্দ এল, সঙ্গে দুশ্চিন্তাও।

আমার মেয়ের জীবনও কি আমার মতো হবে? আমি তো স্কুলের গণ্ডিই পার হতে পারিনি। তখনই মনে মনে শপথ নিলাম, যে করেই হোক মেয়েকে লেখাপড়া করাব। মানুষের অবহেলা আর গঞ্জনায় যাতে সে বড় না হয়। মেয়ে বড় হতে থাকল। একসময় লেখাপড়া শুরু করল। একটু বাড়তি আয়ের আশায় ঘরসংসার সামলে মানুষের বাড়ি গিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিই। লক্ষ্য একটাই—মেয়ের লেখাপড়ায় যেন বাধা না পড়ে।

সেই দিনগুলো এখনো ভুলতে পারিনি। আমার মেয়ে সারা দিন বাসায় একা একা থাকত। সন্ধ্যায় যখন বাড়ি ফিরতাম, আমাকে দেখলেই কান্না করত, অভিমান করত। আমি সব বুঝেও কষ্ট চাপা দিয়ে রাখতাম। সংসারে স্বামীসহ আমরা দুজনই অভাবের সঙ্গে লড়ছি আর পাপিয়াকে বড় করছি। ও যখন এসএসসি পাস করল, আমাদের তখন কী যে আনন্দ! আমাদের তো লেখাপড়া করার সুযোগ হয়নি। কিন্তু মেয়ে আমাদের স্বপ্ন পূরণ করছে। পাপিয়া লেখাপড়ায় মনোযোগ দেয়, পাশাপাশি সংসারের কাজেও আমাকে সাহায্য করে। আমার অল্প সঞ্চয় দিয়ে ওকে প্রাইভেট পড়াই। কোনোরকমে সংসারকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলাম।

২০১৮ সালে আমাদের জীবনে নেমে এল এক গভীর বেদনা। আমার স্বামী বিমল খেতে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে দুর্ঘটনায় পড়ে। প্রাথমিক চিকিৎসার পর কিছুদিন না যেতেই ক্ষতস্থানে পচন ধরে। অবস্থা এতটাই বেগতিক হয় যে তার পা কেটে ফেলতে হয়। আমি যেন গভীর সমুদ্রে পড়ে গেলাম। স্বামীর সঙ্গে এত দিন অভাবকে জয় করতে একসঙ্গে লড়াই করেছি, এখন কী করি? আমার স্বামী তো কোনো কাজই করতে পারবে না। আমি মানুষের বাসায় কাজ করে কীভাবে স্বামীর যত্ন নেব? তবু হাল ছাড়লাম না।

মা আর মেয়ে মিলে কাজ ভাগ করে নিলাম। স্বামীকে গোসল করিয়ে দিই। জিনিসপত্র এগিয়ে দিই। পাপিয়াও নিজের লেখাপড়ার ফাঁকে বাবাকে সহযোগিতা করে। কিন্তু এভাবে সময় কেটে গেলেও নানা সমস্যা দেখা দিল। কর্মক্ষম মানুষ কতক্ষণ বাসায় বসে থাকতে পারে। সারাক্ষণ মলিন চেহারা নিয়ে স্বামী বাসায় বসে থাকে। আর দুঃখ করে বলে, আমি তোমাদের বোঝা হয়ে গেলাম। কিছুই করতে পারছি না। আমরা সান্ত্বনা দিই। বলি, অপেক্ষা করো, দিন বদলাবে। আমি মানুষের বাসায় কাজ করি আর মেয়ে টিউশনি শুরু করে। দুজনের আয়েও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল।

একদিন অন্যের বাসায় কাজ করতে গিয়ে শুনি, অনেকেই ব্র্যাকের সাহায্য নিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছে। ঋণ নিয়ে গরু কিনেছে। ছোট ব্যবসা করছে। আমিও আশা নিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে ব্র্যাকের ‘উঠান বৈঠক’-এ অংশগ্রহণ করি। ‘ব্র্যাক আপার’ সঙ্গে আমার জীবনের দুর্দশার গল্প বলি। অভাব-অনটনের সঙ্গে আমার লড়াইয়ের কথা শুনে আপা ভরসা দিলেন। বললেন, ‘ঋণ নিয়ে কিছু একটা শুরু করতে পারেন।’

প্রমীলা মিস্ত্রির (বাঁয়ে) মেয়ে পাপিয়া (ডানে) বাংলায় অনার্স পড়ছেন। মেয়ে লেখাপড়া শেষ করে স্বাবলম্বী হবেন—এটাই স্বপ্ন প্রমীলার
ছবি: খোরশেদ আলম

ব্র্যাকের প্রকল্প থেকে ঋণ নিয়ে আমি প্রথমে একটা গরু কিনলাম। তারপর হাঁস-মুরগিও কিনলাম। ব্র্যাকের ভাই-আপাদের কাছে পশুপালনের প্রশিক্ষণ নিলাম। গরু পালন করে বিক্রি করি। বাছুর বড় করি। মুরগি থেকে ডিম আসে। নিজে খাই আবার বাজারে বিক্রি করি। এভাবে আমার কিছু সঞ্চয় হয়।

মনে সাহস পাই যে কিছু একটা করতে পেরেছি। জমানো টাকা দিয়ে স্বামীকে ভ্যান কিনে দিই। বাড়তি আয় শুরু হয়। স্বামীর মনে যে হতাশা, তা দূর করার চেষ্টা করি। তাকেও তো আত্মবিশ্বাসী করতে হবে। অল্প কয়েক বছরে আমাদের জীবনের মোড় ঘুরে গেল। গরু আর মুরগির খামার বড় হলো। এবার ঘরের দিকে নজর দিই। ঘর মেরামত শুরু করি। আনন্দ লাগল এই ভেবে, অনেক লড়াইয়ের পর অভাবকে জয় করতে পেরেছি। আসলে ধৈর্য নিয়ে চেষ্টা করলে অভাবকে জয় করা যায়।

আরও পড়ুন

জীবনে শুধু অভাবের সঙ্গে লড়াই করিনি, বিভিন্ন ঘটনা থেকে শিক্ষাও নিয়েছি। এখন আমি সচেতন। বুঝলাম, শিক্ষা না থাকায় আমাকে কঠিন লড়াই করতে হয়েছে। আমার মেয়েকে যাতে এ রকম লড়াই করতে না হয়, সেই চেষ্টা করছি।

আমাদের মেয়ে পাপিয়া এখন বাংলায় অনার্স পড়ছে। অনেকেই মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার কথা বললেও আমি রাজি হই না। তার লেখাপড়া শেষ হবে, সে স্বাবলম্বী হবে, আয়রোজগার করবে, তারপর বিয়ে। একটা সময় ইনকাম না করলে মানুষের আত্মবিশ্বাস আসে না। আর দরিদ্র মানুষের এই সমাজে কোনো মর্যাদা নেই।

আমার জীবনে সচ্ছলতা ফিরে আসার পর এখন আশপাশের মানুষ সম্মান করে। আমার সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করে। অথচ এই আমিই অন্যের বাসায় কাজ করে জীবন কাটিয়েছি। মূলত জীবনে সুযোগ সবাই পায়, কিন্তু কাজে লাগাতে পারে না। আমি সব চেষ্টা দিয়ে সুযোগকে কাজে লাগিয়েছি।

আরও পড়ুন